ঝিলপাড়ের শেষ মাথায় পিপিইগুলো (ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম) থেকে টিমটিমে আগুনে জ্বলছে । দাফন শেষে কয়েকজন হাঁটা ধরেছেন কবরস্থানের আরেক মাথায় মূল গেটের দিকে। সারি সারি রডলাইটের আলোর সঙ্গে তাঁদের ছায়াও যেন হাঁটছে।
গতকাল মঙ্গলবার দিবাগত রাত দেড়টার দিকে রাজধানীর খিলগাঁও তালতলা কবরস্থানের দৃশ্য এটি। সেখানেই গভীর রাতে করোনাভাইরাসে সন্দেহজনক মৃত্যু হিসেবে এক ব্যক্তিকে দাফন করা হয়েছে। করোনা ভাইরাসে তিনি আক্রান্ত ছিলেন কিনা জানতে ওই ব্যক্তির নমুনা নেওয়া হয়েছে। সেই পরীক্ষার ফল আসেনি। অবশ্য, পরিবারের সদস্যরা বলছেন, তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ছিলেন না। হাসপাতাল থেকে মৃত্যুর প্রমাণপত্রেও লেখা, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।
গতকাল রাতে ও আজ দুপুরে খিলগাঁও তালতলা কবরস্থানে যাদের দাফন করা হয়েছে তাদের দুজনকেই ‘করোনা নির্ধারিত স্থানে’ কবর দেওয়া হয়েছে। প্রসঙ্গত, খিলগাঁও তালতলা কবরস্থানে করোনা রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের কবর দেওয়ার জন্য স্থান নির্ধারিত করা হয়েছে।
এক পরিবার লকডাউন
জানা গেছে, মঙ্গলবার রাতে দাফন করা ওই ব্যক্তির ডেমরার বাড়িটি লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। বাড়িটি থেকে কাউকে বের হতে ও প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন পরিবারের সদস্যরা। তাঁরা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে বের হতে পারছেন না। মৃত ব্যক্তির বয়স ৬০ বছর। তিনি পেশায় নৈশকর্মী ছিলেন। এই ব্যক্তি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের বাসিন্দা। তবে থাকতেন ডেমরায়।
মৃত ব্যক্তির স্বজনেরা প্রথম আলোকে জানান, ওই ব্যক্তির জ্বর, সর্দি বা কাশির কোনো উপসর্গ ছিল না। তিনি গত সোমবার রাত দশটার দিকে কাজে যান। ভোরবেলায় অসুস্থ বোধ করায় তাঁকে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে তাঁকে রাজধানীর কুর্মিটোলা হাসপাতালে নেওয়া হয় গতকাল মঙ্গলবার দুপুর বারোটার দিকে। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসকেরা ওই ব্যক্তির শারীরিক অবস্থা পরীক্ষা করে করোনার লক্ষণ না পাওয়ার ছাড়পত্র দেন। পরে স্বজনেরা দুপুরেই ওই ব্যক্তিকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সন্ধ্যার দিকে সেখানে তিনি মারা যান।
মৃতের সন্তান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর বাবাকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে তিনি মারা যান। সেখান থেকে তাঁরা মৃতদেহ নিয়ে বের হতে চাইলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ করোনাভাইরাস আক্রান্তদের মৃত ব্যক্তির লাশ পরিবহণ ও দাফনের দায়িত্বে থাকা আল মারকাজুল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে খবর দেয়।
জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হামজা শহীদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাদের খবর দেয়, হাসপাতালে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহে একটি মৃতদেহ সেখানে আছে। হটলাইনে আমরা ফোন পেয়ে ওই লাশ নিয়ে তালতলা কবরস্থানে দাফন করি। আমরা জানতে পেরেছি, ব্যক্তিটির করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কিনা তা পরীক্ষা করতে আইইডিসিআরে পাঠানো হয়েছে।’
‘বেওয়ারিশ’ একজনকে দাফন
এদিকে আজ বুধবার বিকেল সোয়া পাঁচটার দিকে ৬৫ বছর বয়সী এক ব্যক্তিকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহজনক মৃত্যু হিসেবে দাফন করা হয়। মৃতদেহ দাফনের সময় পরিবারের কোনো সদস্য কবরস্থানে উপস্থিত ছিলেন না। আটজন পিপিই পরা ব্যক্তি তাঁর দাফন কাজ সম্পন্ন করেন। এই দেহটি রাজধানীর কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল থেকে আনা হয়েছে। পরিবহণ ও দাফনের দায়িত্বে থাকা মারকাজুল হাসপাতালের কর্মকর্তারা জানান, কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে উত্তরার ১৩ সেক্টর নিবাসী ওই ব্যক্তিকে এক ছেলে অসুস্থাবস্থায় আজ সকালে নিয়ে আসেন। এরপর ওই ব্যক্তির সন্তান পরিচয় দেওয়া ছেলেটি তাঁকে হাসপাতালে রেখেই চলে যান।
হাসপাতালে আনার পর বেলা সোয়া এগারোটার দিকে তিনি মারা যান বলে কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল থেকে দেওয়া মৃত্যুর প্রমাণপত্রে লেখা আছে। মৃত্যু সনদে কারণ ঘরে লেখা, হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনি মারা গেছেন। এর পাশেই একটি ‘প্রশ্নবোধক’ চিহ্ন দেওয়া।
প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক উত্তরার এই ব্যক্তির ওই কথিত ছেলের মুঠোফোনের নম্বর জোগাড় আজ বিকেল পর্যন্ত অন্তত আটবার ফোন করলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। আল মারকাজুল হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হামজা শহীদুল ইসলাম প্রথম আলোকে এ বিষয়ে বলেন, ‘ওই ছেলেটি এই ব্যক্তিকে রেখে উধাও হয়ে যান। আমরাও ফোন করে তাঁকে পাচ্ছি না।’