http://www.m.mzamin.com/article.php?mzamin=144942
‘আসন্ন নির্বাচনকে কঠিনভাবে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র’ (ভিডিও)
মার্কিন স্কলার ও ঢাকায় দায়িত্বপালনকারী যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি মাইলাম বলেছেন, বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনকে বেশ কঠিনভাবে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ট্রাম্প প্রশাসন চায় নির্বাচনটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং সবার অংশগ্রহণে হোক। এতে জনগণের ইচ্ছার সত্যিকারের প্রতিফলন ঘটুক। তিনি বলেন, আমি আশা করিÑ বৈশ্বিক কতৃত্ববাদের যে ছায়া বাংলাদেশের ওপর পড়েছে সেটি পরাজিত হবে, বাংলাদেশের জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল সংসদ এবং সামগ্রিকভাবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার পুন:প্রবর্তন হবে। বোস্টনের হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে শনিবার এক সেমিনারে মাইলাম বক্তৃতা করছিলেন। ‘ইমপ্লিকেশন্স অব টার্গেটিং মিডিয়া এন্ড জার্নালিস্টস অন হিউম্যান রাইটস এন্ড ডেমোক্রেসি’ শীর্ষক ওই সেমিনারের আয়োজন করেছিল বাংলাদেশ প্রগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স অব নর্থ আমেরিকা (বিডিপিএএনএ)। যার সহায়তা ও সমর্থনে ছিল হার্ভার্ড ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন কাউন্সিল (আইআরসি)।
রাষ্ট্রদূত মাইলাম তার দীর্ঘ বক্তৃতায় বাংলাদেশের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছাড়াও বিশ্বব্যাপী কতৃত্ববাদের উত্থান, মিডিয়ার সঙ্গে মার্কিন প্রশাসনের বৈরিতা, বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মিডিয়ার স্বাধীনতা, এখানকার প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে পড়া, বিচার ব্যবস্থা, ২০১৪ সালে ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন এবং বিএনপির অংশ না নেয়ার ‘ভুল সিদ্ধান্ত’ এবং আওয়ামী লীগ তথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের সর্বত্র ‘একচ্ছত্র কতৃত্ব’ প্রতিষ্ঠা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া এবং আসন্ন নির্বাচনের জন্য ভিন্নমত সত্বেও বিএনপির সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বৃহত্তর ঐক্য এবং জোট গঠন নিয়ে খোলামেলা কথা বলেন। তার ওই বক্তৃতার ভিডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইউটিউব-এ ব্যাপক প্রচার পায়। প্রচারিত বক্তৃতায় মাইলাম বলেন, আমি এখানে আসার আগে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। আমি বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের বিষয়ে খোঁজ-খবর নেয়ার চেষ্টা করেছি। তারা আমাকে যেটা বলেছেন তা হলÑ এ নির্বাচন প্রশ্নে অত্যন্ত শক্ত অবস্থানে থাকবে যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে জনগণের অংশগ্রহণের বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকার উল্লেখ করে তিনি বলেন, আশা করি নির্বাচনটি একতরফা হবে না, যদি হয় তবে তা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। কতৃত্ববাদের বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট টেনে বিশ্বের দেশে দেশে দূতিয়ালী করা জ্যেষ্ঠ ওই কূটনীতিক বলেন, বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বেই কতৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে।
বাংলাদেশের গত ১০ বছর ধরে এমন শাসন ব্যবস্থা প্রসারিত হতে চলেছে। বিশ্বব্যাপী এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটানো জরুরি বলে মন্তব্য করেন তিনি। এ সময় গণমাধ্যমের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের আচরণের কড়া সমালোচনা করে তিনি বলেন, অতীতেও মিডিয়ার সঙ্গে মার্কিন প্রশাসনের বৈরি আচরণ হয়েছে। অন্য প্রেসিডেন্টরাও করেছেন। কিন্তু ট্রাম্পের মত কেউ করেননি। ঢাকায় দায়িত্ব পালন এবং দক্ষিণ এশিয়া নিয়ে বর্তমানে গবেষণাকারী উইলিয়াম বি মাইলাম বলেন, বাংলাদেশে একটি ভয়ের সংস্কৃতি চালু হয়েছে। এ দেশের অনেকের সঙ্গে তার ঘণিষ্ঠ যোগাযোগ এবং ব্যক্তিগতভাবে তিনি অনেককে চিনেন জানিয়ে বলেন, এখানে অনেকে সরকারের দমন নীতির কারণে নীরব ভূমিকা পালন করছেন অথবা আপস করে চলছেন। অনেকে জেল থেকে বেরিয়েছেন রাজনীতি না করার মুচলেকা দিয়ে। তারা রাজনীতি থেকে দূরে থাকছেন। আর মিডিয়া, পরিস্থিতি এমন যে তারা নিজেরাই সেন্সরশিপ করে ফেলে (সেল্ফ সেন্সরশিপ)। এভাবেই চলছে। বাংলাদেশের রাজনীতি এবং শাসন পরিচালনায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির অনেক ভুল ছিল মন্তব্য করে মার্কিন ওই কূটনীতিক বলেন, তারা তাদের শাসনামলে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালীকরণে ব্যর্থ হয়েছে। আমি মনে করি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে পড়ার জন্য তারাও দায়ী। তবে এখন যেটি হচ্ছে তার অবস্থা আরও খারাপ, এটি দিনে দিনে খারাপের দিকে যাচ্ছে। মার্কিন ওই কূটনীতিক ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের অংশ না নেয়ার তীব্র সমালোচনা করেন। বলেন, এটিও বিএনপি জোটের বড় ভুল ছিল। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যতই প্রভাব বিস্তারিত করুক না কেন, তারপরও বিএনপি এটি বর্জন না করে অংশ নিলে অন্তত ১০০ আসনে জয়ী হতো। সরকারী দল একতরফাভাবে কিছুই করতে পারতো না। অন্তত একচ্ছত্র কতৃত্ব প্রতিষ্ঠার পথে যেতে পারতো না। বিশেষ করে মিডিয়া ও সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণে সরকার যে ডিজিটাল আইন করেছে এমন জনবিরোধী আইনগুলো প্রণয়নে বিরোধীরা সংসদে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারতো।
যুদ্ধাপরাধীর বিচার প্রশ্নে মার্কিন ওই জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক বলেন, একাত্তরে এদের কী ভূমিকা ছিল তা সবাই জানে। আমি তাদের বিচারের বিরোধিতা করছি না। আমার প্রশ্ন হচ্ছে বিচারের প্রক্রিয়া নিয়ে। জামায়াতের ওই নেতাদের যে প্রক্রিয়ায় ফাঁসি দিয়ে দেয়া হয়েছে তা নিয়ে। মাইলাম বলেন, আমি বাংলাদেশে গিয়েছিলাম। সেখানে দেখেছি, কিভাবে এনজিও, গণমাধ্যম ভয়ের মধ্যে রয়েছে। কিভাবে শেখ হাসিনার সরকার বিরোধীদের পুরোপুরিভাবে দমনের চেষ্টা করছেন। তার সমালোচনাকারী যে বা যারাই হোক তাকে দমিয়ে দেয়া হচ্ছে নানা কায়দায়। এ অবস্থার অবসানের জন্য বিশেষ করে সরকারের বিরুদ্ধে এক সুরে প্রতিবাদের জন্য মধ্যম ডান ও মধ্যম বাম দলগুলোর সঙ্গে বিএনপির ঐক্য হয়েছে। ওই জোটের মধ্যে ভিন্নমত ও ভিন্ন ধারা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কিন্তু তারপরও তারা ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। মাইলাম কারও নাম না নিয়ে বলেন, এটা ভাল খবর ওই জোটে আমি অনেককে দেখছি যারা একাত্তরে বাংলাদেশের জন্মের সময় এগিয়ে এসেছিলেন। বাংলাদেশ সৃষ্টিতে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আমি দেখেছি। সেখানে অনেকে আমার বয়সী, অনেকে আমারে চেয়েও বয়োজ্যেষ্ঠ। শুধু তাই নয় ’৯০-এ গণতন্ত্র পূণঃপ্রতিষ্ঠায় তাদের ভূমিকা ছিল। এবারও তারা এগিয়ে এসেছেন। মাঠে নেমেছেন। আমি তাদের দেখেছি- তারা জোটবদ্ধ হয়েছে একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য। বক্তৃতায় বেগম খালেদা জিয়ার নাম না নিয়ে মাইলাম বলেন, বাংলাদেশের একজন রাজনীতিবিদের মামলায় আইনজীবি হিসাবে আমার এক বৃটিশ বন্ধু যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি যে পারেননি। অনুষ্ঠানে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক শ্যারমেন বিশ্বব্যাপী পরিচিত ফটোসাংবাদিক ড. শহীদুল আলমের দীর্ঘ কারাবাস নিয়ে কথা বলেন। তিনি তার আটকের নিন্দা এবং দ্রুত মুক্তি দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, তিন মাস ধরে ড. আলমের মতো খ্যাতিমান ফটোসাংবাদিককে আটক করে রাখা হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা একটি সভ্য গণতান্ত্রিক সমাজে চিন্তাও করা যায় না।
বক্তৃতায় সৌদি কনস্যুলেটে বর্বর হত্যাকান্ডের শিকার সাংবাদিক জামাল খাশোগির ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান। সেমিনারে রোহিঙ্গাদের ওপর বার্মা সরকারের ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরে জাতিসংঘের বার্মা বিষয়ক টাস্কফোর্স প্রধান এডেম ক্যারল বলেন, মিয়ানমার সরকার বর্বরতা ইতিহাসে বিরল। নৃশংস ওই হত্যাযজ্ঞ বিশ্ববিবেককে নাড়া দিলেও নোবেল বিজয়ী অং সান সুচিকে স্পর্শ করতে পারেনি। এ সময় প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয়ার জন্য বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারের উদারতার ভূয়সী প্রশংসা করে ক্যারল। অনুষ্ঠানে কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট’র এশিয়া বিষয়ক গবেষক আলিয়া ইফতেখার বলেন, মুক্ত মত প্রকাশের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত নিম্নমূখী। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছাড়াও সরকার সমর্থক কর্মীবাহিনীদের হাতে সাংবাদিকরা নির্যাতিত হচ্ছেন। সাংবাদিক নির্যাতনের সকল ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানায় সিপিজে। অনুষ্ঠানে সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারী বলেন, বিশ্বের দেশে দেশে ক্ষমতাকে প্রলম্বিত করতে সরকারগুলো মিডিয়াকেই প্রথম টার্গেট করে। বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা অনেকটা এরকম- আপনি অবাধে কথা বলতে পারবেন কিন্তু সব কথা হতে হবে শাসক দলের পক্ষে। এখানে ভিন্নমতের কোনো জায়গা অবশিষ্ট নেই বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
অনুষ্ঠানে সাংবাদিক শফিক রেহমান, মাহমুদুর রহমান, শওকত মাহমুদ, প্রবীর শিকদার, একুশে টিভির সিইও আব্দুস সালাম, সংস্কৃতিকর্মী নওশাবাসহ মুক্তমতের অসংখ্য মানুষের ওপর বিভিন্নভাবে নির্যাতনের এবং সর্বশেষ জেলে আটক হয়েছেন নিউ নেশন পত্রিকার প্রকাশক ব্যরিস্টার মইনুল হোসেনের প্রসঙ্গও ওঠে। অনুষ্ঠানে বিডিপিএএনএ সাধারণ সম্পাদক ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সদস্য ইঞ্জিনিয়ার তানভীর নেওয়াজ বলেন, পৃথিবীর দেশে দেশে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটে চলেছে। সাংবাদিক জামাল খাশোগির হত্যাকান্ড সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বর্বরতম উল্লেখ করেন তিনি। বিডিপিএএনএ প্রেসিডেন্ট মোজাম্মেল আল হোসাইনি এবং আইআরসি প্রেসিডেন্ট এলিসা এনিস যৌথ সঞ্চালনায় অন্যান্যের মধ্য ব্রান্ডিজ ইউনিভার্সিটির প্রফেসর সাদেক কামাল (কবি সুফিয়া কামালের বড় ছেলে) এবং আজাদ খান বক্তৃতা করেন।