সরকারের সঙ্গে বিচার বিভাগের দ্বন্দ্বের শুরু ২২ বছর আগে
৬ প্রধান বিচারপতিই রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাতিল চেয়েছিলেন
অনুসন্ধান * অধস্তন বিচারকদের তদারকি ক্ষমতা
উচ্চ আদালতের অনধিক এক শ বিচারকের অপসারণ পদ্ধতির রায় নিয়ে বিতর্ক চলছে। কিন্তু চাপা পড়ে আছে অধস্তন আদালতের দেড় হাজার বিচারকের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিচার বিভাগের সঙ্গে সরকারের বিরোধ
নিম্ন আদালতের বিচারক নিয়ন্ত্রণ প্রশ্নে বিচার বিভাগের সঙ্গে মূল দ্বন্দ্ব সরকারের, সংসদের নয় এবং এর শুরু ১৯৯৯ সালে মাসদার হোসেন মামলারও আগে। ১৯৯৫ সালে, অর্থাৎ প্রায় ২২ বছর আগে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ ছাড়া তিনজন বিচারককে যুগ্ম সচিব নিয়োগ দেওয়ার ঘটনাতেই নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত। তা ছাড়া প্রশ্নটি রাষ্ট্রপতির হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার নয়। কেননা রাষ্ট্রপতির নামে আইন মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগ ওই ক্ষমতা প্রয়োগ করে আসছে।
বর্তমান সরকার বাহাত্তরের সংবিধানে ফেরার কথা বললেও ২০১১ সালের পঞ্চদশ সংশোধনীতে নিম্ন আদালতের নিয়ন্ত্রণ কার্যত পাকিস্তান আমলের প্রচলিত ব্যবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থাই পাকাপোক্ত করেছে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, দুই দশকের বেশি সময় ধরে প্রত্যেক প্রধান বিচারপতি এবং উভয় বিভাগের বিচারকেরা বারবার মত দিয়েছেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষায় অধস্তন আদালতের বিচারকের নিয়োগ, নিয়ন্ত্রণ ও অপসারণসংক্রান্ত রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাতিল হওয়া দরকার। সংবিধানের ১১৪ অনুচ্ছেদ থেকে ১১৬ ক অনুচ্ছেদ এই চারটিতে অধস্তন আদালত পরিচালনার পদ্ধতি বলা আছে। ১১৪ বলেছে, আইনের দ্বারা নিম্ন আদালত গঠিত হবে। বর্তমানে তাতে ১৫০০ বিচারক আছেন। তাঁদের আদালতে এখন প্রায় ৩০ লাখ মামলা বিচারাধীন। তাঁরা সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের (বর্তমানে ৯৪ জন) চেয়ে বছরে ৭ গুণ বেশি মামলা নিষ্পত্তি করেন। ১১৫ বলেছে, রাষ্ট্রপতি বিচারক নিয়োগবিধি করবেন। ১১৬ অনুচ্ছদ বলেছে, ওই বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শে রাষ্ট্রপতি করবেন। ১১৬ (ক) বলেছে, বিচারকেরা বিচারকার্য পালনে স্বাধীন থাকবেন। এর বাইরে ১০৯ অনুচ্ছেদ বলেছে, নিম্ন আদালতের বিচারকদের তদারকি করবেন হাইকোর্ট। বাহাত্তরের সংবিধানে ১১৫ ও ১১৬-তে রাষ্ট্রপতির কোনো উল্লেখ ছিল না, যা ১৯৭৫ সালে একদলীয় বাকশাল ব্যবস্থায় যুক্ত করা হয়। বাহাত্তরে বিচারক নিয়ন্ত্রণের পুরো দায়িত্ব সুপ্রিম কোর্টর ওপর ছিল। এরপর জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে এক ফরমান দিয়ে ১১৬-তে সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শের বিধান যুক্ত করে অবস্থার কিছুটা উন্নতি ঘটান। গত ৩১ জুলাই দেওয়া ষোড়শ সংশোধনীর পূর্ণাঙ্গ রায়ে প্রধান বিচারপতি তাঁর পর্যবেক্ষণে বিদ্যমান ১১৬ অনুচ্ছেদকে সংবিধানপরিপন্থী হিসেবে মত দেন। এটি রায়ের অংশ নয়। তাঁর এই মতের বিষয়ে অন্য চারজন বিচারক অবশ্য বলেন, এই মামলায় এই বিষয়টি প্রাসঙ্গিক নয়।
বিচারক বদলি ও শৃঙ্খলামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ নিয়ে সাম্প্রতিককালে বর্তমান সরকারের সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের তিক্ততা চরম রূপ নিয়েছে। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মতো এখানেও প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে হাইকোর্টের তিন বিচারক নিয়ে একটি জিএ কমিটি রয়েছে। কখনো সিদ্ধান্ত নেন ফুলকোর্ট।
১৯৯৯ সালে মাসদার হোসেন মামলার রায়ে বলা হয়, বিচারকদের বদলি বা শৃঙ্খলা বিষয়ে কখনো দুই মত দেখা দিলে সুপ্রিম কোর্টর মত প্রাধান্য পাবে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে তা পাচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। ছয় মাসের বেশি সময় ধরে সারা দেশে অর্ধশত জেলা জজ সমমর্যাদার বিচারকের পদ শূন্য এবং জেলা জজ হতে ১৪০ জন অতিরিক্ত জেলা জজের পদোন্নতির প্যানেলটি থমকে আছে।
২০০৮ সালের পরে আপিল বিভাগের বিভিন্ন মামলার রায় বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রধান বিচারপতি হয়েছেন এমন অন্তত ৬ জন জ্যেষ্ঠ বিচারপতি স্পষ্ট ভাষায় রাষ্ট্রপতির হাতে ওই ক্ষমতা থাকা উচিত নয় বলে মত দিয়েছেন। এই প্রধান বিচারপতিরা হলেন, এম এম রহুল আমিন (১ জুন ২০০৮ থেকে ২২ ডিসেম্বর ২০০৯), তাফাজ্জাল ইসলাম (২৩ ডিসেম্বর ২০০৯ থেক ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১০), মোহাম্মদ ফজলুল করিম (৮ ফেব্রুয়ারি ২০১০ থেকে ৩০ সেপ্টম্বর ২০১০), এ বি এম খায়রুল হক (১ অক্টোরবর ২০১০ থেকে ১৭ মে ২০১১), মো. মোজাম্মেল হোসেন (১৮ মে ২০১১ থেকে ১৬ জানুয়ারি ২০১৫) এবং বর্তমান প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা (১৭ জানুয়ারি ২০১৫—)।
তবে উল্লিখিত বিচারকদের মধ্যে বিচারপতি খায়রুল হকই একমাত্র ব্যতিক্রম, যিনি অবসরে এসে তাঁর নিজের অভিমত থেকে সরে এসেছেন। সম্প্রতি প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি অধস্তন আদালত নিয়ন্ত্রণে দ্বৈত শাসনের (যেমন সরকারই প্রথম প্রস্তাব দেবে ঢাকায় কর্মরত কোনো বিচারককে বরিশালে বদলি করা হোক, সুপ্রিম কোর্ট তখন তার ওপর পরামর্শ দেবেন) পক্ষে মত দেন। তাঁর কথায়, বিচারক নিয়ন্ত্রণে সরকারকে বাদ দিয়ে শুধু সুপ্রিম কোর্টের কাছে ক্ষমতা ন্যস্ত করা হলে ভারসাম্যহীনতা দেখা দেবে।
বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের ওই অবস্থান ২০০৭ সালের ৫ জুন শাহদীন মালিক বনাম সরকার মামলায় তাঁর দেওয়া রায়ের পরিপন্থী। ওই রায়ে তিনি লিখেছিলেন, ১১৪, ১১৫, ১১৬ ও ১১৬ (ক) অনুচ্ছেদে অধস্তন আদালতের প্রতিষ্ঠা, নিয়োগ, নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা এবং বিচার বিভাগীয় কর্মচারীগণ বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে যে স্বাধীন, তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি ঘোষণা করা হয়েছে।
বিচারপতি খায়রুল হক ১৯৯৯ সালের মাসদার হোসেন মামলার বরাতে ২০০৭ সালের ওই রায়ে আরও উল্লেখ করেছিলেন, ‘নির্বাহী বিভাগ ও সংসদ অধস্তন আদালতের বিধিবিধান কার্যকর করতে ব্যর্থ হয়েছে। বিচার বিভাগের প্রতি ঔপনিবেশিক রীতিনীতি ও মনমানসিকতার প্রতিফলন ঘটাচ্ছে সংসদ ও সরকার।’ এখন তিনি উল্টো কথা বলছেন।
এছাড়া ২০১২ সালের ১০ মে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলসংক্রান্ত ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায়ে বিচারপতি খায়রুল হক পুনরায় মাসদার হোসেন মামলার রায়ের বরাতে লিখেছেন, ‘বিচারক নিয়োগের বিধি তৈরিতে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমতা ন্যস্ত আছে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, রাষ্ট্রপতি কিংবা সংসদ কোনো অধীনস্থ আইন বা বিধি দিয়ে তারা নিম্ন আদালতের স্বাধীনতা খর্ব বা হ্রাস করতে পারবে, যা প্রত্যক্ষভাবে করা যায় না, তা পরোক্ষভাবেও করা যায় না।’
উল্লেখ্য যে, নিম্ন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলাসংক্রান্ত বিধি, যা আপিল বিভাগ সর্বসম্মতভাবে অনুমোদন দিয়েছেন, এখন তা রাষ্ট্রপতি আমলে নিচ্ছেন না। আর বিচারপতি খায়রুল হক এখন বিস্ময়করভাবে মনে করেন, বিধি হবে কি হবে না, তা নির্ধারণের একান্ত এখতিয়ার রাষ্ট্রপতির।
এর আগে মাসদার হোসেন মামলার আওতায় ১১৫ ও ১১৬ অনুচ্ছেদের অধীনে শৃঙ্খলাবিধি করেছেন আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ। কোনো বিচারকই এর কোনো আদেশ বা খসড়ার সঙ্গে এ পর্যন্ত কখনো দ্বিমত করেননি। কিন্তু সরকার এখন তা মানতে চাইছে না। আদালতের কাছ থেকে এ পর্যন্ত ২০ বারের বেশি সময় নিয়েছে সরকার।
২১ আগস্ট ঢাকায় এক আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী অভিযোগ করেছেন, ‘প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা নিয়ে নিতে চাইছেন।’ প্রধানমন্ত্রী আরও প্রশ্ন রেখেছেন, ‘আমার এখানে একটা প্রশ্ন, আদালতের সব পরিচালনা উনার হাতে দিতে হবে? তিনি কী করবেন? রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাটাও হাতিয়ে নেওয়া এটা কোন ধরনের দাবি? …যে ক্ষমতা সংবিধান রাষ্ট্রপতিকে দিয়েছে, সে ক্ষমতা তিনি কেড়ে নেন কীভাবে? এটা দেওয়া হয়নি বলে তাঁর যত রাগ ও গোস্সা।’
অতীতের বিভিন্ন মামলার রায় পর্যালোচনা করে দেখা যায়, উচ্চ আদালতের বিচারকেরা অন্তত দুই দশক আগে থেকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগসংক্রান্ত ৯৫ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তে প্রধান বিচারপতির পরামর্শ যুক্ত করা এবং সংবিধানের ১১৫ ও ১১৬ অনুচ্ছেদের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতি বা সরকারের পরিবর্তে সুপ্রিম কোর্টের কাছে ন্যস্ত করানোর পক্ষে রায় দেওয়া শুরু করেন।
এর মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগে প্রধান বিচারপতির পরামর্শের বাহাত্তরের বিধান ৩৬ বছরের ব্যবধানে ২০১১ সালে সংবিধানে ফিরিয়ে আনা হয়।
‘হরবোলা পাখি’
১৯৯৫ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট বিভাগের এক রায়ে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ ছাড়া রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তিনজন জেলা জজকে আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব হিসেবে পদোন্নতি প্রদানকে অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হয়েছিল। আফতাব উদ্দিন বনাম বাংলাদেশ মামলায় বিচারপতি নঈম উদ্দিন আহমেদ ও বিচারপতি মো. রুহুল আমিনের (পরে প্রধান বিচারপতি) সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ লিখেছিলেন, ‘বিচারকদের শৃঙ্খলা বিধানের বিষয়গুলোর ক্ষমতা প্রয়োগে প্রেসিডেন্টকে অবশ্যই সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হবে।’
মাসদার হোসেন মামলায় সরকার থেকে বিচার বিভাগ পৃথক্করণকে ‘অর্থপূর্ণ, স্পষ্ট, কার্যকর ও সম্পূর্ণ’ করতে সংবিধানে সংশোধনী আনতে সংসদের প্রতি নির্দেশনা (১১ নম্বর দফা) দেওয়া হয়। তখনকার প্রধান বিচারপতি মোস্তাফা কামালসহ এ মামলায় আপিল বিভাগের বিচারক ছিলেন ৫ জন। অন্য চারজন হলেন লতিফুর রহমান, বিমলেন্দু বিকাশ রায় চৌধুরী, মোহাম্মদ রুহুল আমীন এবং মাহমুদুল আমীন চৌধুরী। যাঁদের মধ্যে বিবি রায় চৌধুরী বাদে সবাই পর্যায়ক্রমে প্রধান বিচারপতি হয়েছেন।
৭ জনে ৬ জন
এ রকমই অধস্তন আদালতের প্রশাসনসংক্রান্ত আরেকটি দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী রায় হয় ২০১৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বনাম সন্তোষ কুমার সাহা মামলায়। ওই রায়ে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা নির্দিষ্টভাবে ১১৬ অনুচ্ছেদসংক্রান্ত যে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, তার সঙ্গে শর্তহীনভাবে একমত হয়েছিলেন আপিল বিভাগের বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি মো. ইমান আলী ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। অর্থাৎ ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায় প্রদানকারী সাতজন বিচারপতির ছয়জনই দুবছর আগে অধস্তন আদালতের নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে একমত হয়েছিলেন। অপর বিচারপতি মির্জা হোসেন হায়দার তখনো আপিল বিভাগে আসেননি।
২০১৫ সালের সন্তোষ কুমার সাহা মামলায় প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের উল্লেখিত ৬ বিচারপতিই সর্বসম্মতভাবে লিখেছিলেন, ‘১৮৬১ সাল থেকে হাইকোর্ট বিচারক নিয়ন্ত্রণে সরকারকে পরামর্শ দিয়ে চলছেন।’ ওই রায়ে আরও বলা হয়েছিল, ‘১১৬ ও ১১৬(ক) অনুচ্ছেদকে যদি ১০৯ অনুচ্ছেদের সঙ্গে মিলিয়ে পড়া হয়, তাহলে এটা দেখা যাবে যে নিম্ন আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণে সুপ্রিম কোর্টের “এক্সক্লুসিভ পাওয়ার” রয়েছে।’ ওই রায়ের পর সরকারের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার অভিযোগ ওঠেনি।
এখানে উল্লেখ্য ওই ছয় বিচারকই তাঁদের সর্বসম্মত রায়ে ২০১০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি পঞ্চম সংশোধনী মামলায় (খন্দকার দেলোয়ার হোসেন বনাম বাংলাদেশ ইটালিয়ান মার্বেল ওয়ার্কস লি.) আপিল বিভাগের দেওয়া রায়েরও বরাত দেন।
পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায় দেন আপিল বিভাগের ছয়জন। তখন প্রধান বিচারপতি ছিলেন মো. তাফাজ্জল ইসলাম। তাঁর নেতৃত্বে গঠিত আপিল বিভাগের ওই বেঞ্চে ছিলেন বিচারপতি মো. ফজলুল করিম, বিচারপতি মো. আবদুল মতিন, বিচারপতি বিজন কুমার দাস, বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন ও বিচারপতি এস কে সিনহা। আপিল বিভাগ তাঁর রায়ে বলেন, ‘আমরা মনে করি, সংবিধানের ১১৫ ও ১১৬ অনুচ্ছেদকে বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরিয়ে না নেওয়া পর্যন্ত বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সম্পূর্ণরূপে অর্জিত হবে না।’’
লক্ষণীয় যে, ২০১০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি পঞ্চম সংশোধনীর রায় প্রদানকারী ওই ছয় বিচারকের মধ্যে বর্তমান প্রধান বিচারপতি ছাড়া পাঁচজনই অবসরে গেছেন। সেই পাঁচজনের মধ্যে তিনজনই বর্তমান সরকারের আমলে প্রধান বিচারপতি হয়েছেন। তাঁরা হলেন বিচারপতি মো. ফজলুল করিম, বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন এবং বর্তমান প্রধান বিচারপতি।
২০০৯ সালের জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। এরপর জিয়াউর রহমানের সেনাশাসনকে অবৈধ বলাসংক্রান্ত পঞ্চম সংশোধনী, কথিতমতে আওয়ামী লীগ-সমর্থক বিবেচনায় বিএনপি আমলে বাদ পড়া ১০ বিচারকের মামলা এবং চুয়াডাঙ্গার তৎকালীন সিনিয়র সহকারী জজ সন্তোষ কুমার সাহার মামলায় আপিল বিভাগ অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় জোরালো ও নির্দিষ্টভাবে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাতিলের কথা বলেছেন। যেসব বিচারপতি এই অভিমত দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়দানকারী চার বিচারকও রয়েছেন। এই চারজন অধস্তন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলাবিষয়ক ১১৬ অনুচ্ছেদ ষোড়শ সংশোধনীর মামলায় প্রাসঙ্গিক নয় বলে মত দিয়েছেন। ওই চারজন হলেন বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি মো. ইমান আলী ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। আবার এটাও সত্য, ১১৬ অনুচ্ছেদকে আলোচ্য মামলায় প্রাসিঙ্গক নয় বলে উল্লেখ করেও বিচারপতি মো. ইমান আলী তাঁর রায়ে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাতিলে তাঁর সমর্থন ব্যক্ত করেন। কারণ তিনি এ বিষয়ে তাঁর পর্যবেক্ষণে এর আগে আপিল বিভাগের দেওয়া পর্যবেক্ষণ পুনর্ব্যক্ত করেন।
২০১৫ সালের ডিসেম্বরে সন্তোষ সাহার মামলায় ষোড়শ সংশোধনীর সাত বিচারকের ছয়জনই সর্বসম্মতভাবে বলেছিলেন, ‘আমরা আশা করছি যে ভবিষ্যতে কোনো বিতর্ক এড়াতে মূল ১১৬ অনুচ্ছেদ পুনরুজ্জীবিত করা সমীচীন হবে। যথাযথভাবে বিচার প্রশাসন পরিচালনার জন্য এটাই হবে স্বাস্থ্যকর।’ তাঁরা প্রত্যেকে ১৯৭২ সালে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ ফিরে পাওয়ার কথাই বলেছিলেন, যেখানে রাষ্ট্রপতির কোনো ক্ষমতা ছিল না। এই বিচারকেরা হলেন বিচারপতি এস কে সিনহা, বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিয়া, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি ইমান আলী ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দীকী। অধস্তন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলাবিষয়ক ১১৬ অনুচ্ছেদ বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরিয়ে নিলে নিম্ন আদালতের ১৫০০ বিচারকের অপসারণের ক্ষমতা পুরোপুরি সুপ্রিম কোর্টের কাছে চলে যাবে। আর ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের মাধ্যমে পুনরুজ্জীবিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের মাত্র শখানেক বিচারকের অপসারণের প্রশ্ন জড়িত। অথচ বিস্ময়কর হলো যে, নয়জন এমিকাস কিউরির কেউ অধস্তন আদালতের স্বাধীনতার বিষয়ে মত দেননি।
আওয়ামী লীগ আমলে (১৯৯৬-২০০১) অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে নিয়োগ পাওয়া এবং বিএনপি আমলে প্রধান বিচারপতির সুপারিশ সত্ত্বেও স্থায়ী হতে না পারা ১০ বিচারকের মামলায় প্রধান বিচারপতির পরামর্শের কার্যকারিতা সরকার স্বীকার করেছিল। এর প্রমাণ হলো সরকার তাদের সবার নিয়োগ নিশ্চিত করেছিল। বিএনপি আমলের রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতিকে উপেক্ষা করেছিলেন বলে বিরাট প্রতিবাদ উঠেছিল। আওয়ামী লীগের আমলে (২০০০ সালে) হাইকোর্টে নিয়োগ পাওয়া ওই ১০ জন বিচারপতিকে স্থায়ী না করার সিদ্ধান্ত পরে চ্যালেঞ্জ করা হয়। এই মামলায় আপিল বিভাগের রায়ে ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি তাফাজ্জাল ইসলাম (পরে প্রধান বিচারপতি) লিখেছেন, ‘এমনকি বিদ্যমান সাংবিধানিক অবস্থাতেও রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী সুপ্রিম কোর্টের মতের বাইরে কোনো পরামর্শ দেওয়ার অধিকার রাখেন না। কারণ, প্রধানমন্ত্রী বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ধ্বংস করতে পারেন না।’ এই মামলাতেই প্রধান বিচারপতি এম এম রুহুল আমীনের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের আপিল বিভাগ সর্বসম্মত পর্যবেক্ষণ দেন, ১১৫ ও ১১৬কে বাহাত্তরে ফিরিয়ে না নিলে ‘বিচারের স্বাধীনতা দূরবর্তী কান্না ও ঢোলের শব্দ’ হয়ে থাকবে। এই বেঞ্চের আরেক বিচারক বিচারপতি মো. ফজলুল করিম পরে প্রধান বিচারপতি হন।
বিচারপতি মো. আবদুর রশীদের (পরে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান) নেতৃত্বাধীন বৃহত্তর বেঞ্চ ২০০৮ সালে ওই ১০ বিচারকের মামলায় প্রধান বিচারপতির সুপারিশ প্রত্যাখ্যান করার কারণে ১০ বিচারককে বাদ দেওয়া অসাংবিধানিক ঘোষণা দেন। এই রায়েও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ওপর সুপ্রিম কোর্টের মতামত প্রাধান্য পায়। বিচারপতি আবদুর রশীদ লিখেছেন, ‘অধস্তন আদালতের জন্য নিয়োগবিধি তৈরির ক্ষেত্রে সংবিধানের ১১৫ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমতা দেওয়া থাকলেও মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পর রাষ্ট্রপতি সেই বিধি জারির আগে সুপ্রিম কোর্টের অনুমোদন নিয়েছিলেন। কিন্তু ১১৬ অনুচ্ছেদে শৃঙ্খলা বিধানের বিষয়টিতে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শেই রাষ্ট্রপতি তা প্রয়োগ করবেন।’
২০০৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বনাম আফতাব উদ্দীন মামলার রায়ে প্রধান বিচারপতি তাফাজ্জাল ইসলামের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ মত দেন, ২২ অনুচ্ছেদমতে বিচার বিভাগ পৃথক্করণের নীতি অবশ্যই সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হতে হবে। এর অর্থ ১১৫ ও ১১৬ বাহাত্তরে ফিরিয়ে নেওয়া। রায়ে বিচারপতি এম এ মতিন লিখেছেন, ১১৫ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতিকে বিধি তৈরির যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তার আওতায় সংসদ কখনো বিধি বা আইন করতে পারবে না। সে সময়ে সাত সদস্যের আপিল বিভাগে বিচারপতি খায়রুল হকও ছিলেন এবং তিনি ওই মত সমর্থন করেন।
উল্লেখ্য, ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন লিখেছেন, রাষ্ট্রপতি বিচারকদের জন্য আলাদা বিধি করার উদ্যোগ না নেওয়ার কারণেই আপিল বিভাগ চাকরিবিধি তৈরি করে দিয়েছিলেন।
এর সবটাই স্পষ্ট করে যে, অধস্তন আদালত নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা রহিত না করা বরং তা আরও জোরালোভাবে নিয়ন্ত্রণের নীতি অনুসরণ করার অর্থই হলো বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ধারণা প্রত্যাখ্যান করা। সরকারের বিরুদ্ধে এখন সেই অভিযোগও উঠেছে।
এর আগে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক প্রথম আলোকে ‘পর্যায়ক্রমে’ বিচার বিভাগ পৃথক্করণ এবং আরও সময় নিয়ে মূল ১১৬ অনুচ্ছেদ ফিরিয়ে আনার দিকে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।
তবে বাহাত্তরের সংবিধানেই সুপ্রিম কোর্টের কাছে নিম্ন আদালতের নিয়ন্ত্রণ দেওয়া হলেও ১৫০ অনুচ্ছেদের ক্রান্তিকালীন বিধানাবলিতে বলা হয়েছিল, এসব বিষয় ‘যথাশীঘ্র’ বাস্তবায়িত হবে। তার আগে সংবিধান কার্যকর হওয়ার আগের মতো অর্থাৎ পাকিস্তানি রীতিতে চলবে বলে উল্লেখ করা হয়। বিষয়টি এত দিন সবারই নজর এড়িয়ে গেছে। ২০১১ সালে সংবিধানে বড় পরিবর্তন আনা হলেও বিচার বিভাগের স্বাধীনতাবিধ্বংসী এই বিধান কেন বাতিল হলো না, জানতে চাইলে সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে নিজের “অজ্ঞতা” প্রকাশ করছি।’ রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাতিলে গত ছয় প্রধান বিচারপতির অভিন্ন মত সম্পর্কে মন্তব্য চাইলে ১১৬ অনুচ্ছেদের বৈধতা আদালতে ‘বিচারাধীন’ বিবেচনায় মত দিতে শফিক আহমেদ অপারগতা জানান। সাবেক আইনমন্ত্রী এবং জাতীয় সংসদে আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সভাপতি আবদুল মতিন খসরু প্রধান বিচারপতিদের মতামতের প্রতি তিনি শ্রদ্ধাশীল উল্লেখ করলেও কোনো মত দেননি। এর আগে মাসদার মামলার অন্যতম রায়দানকারী ও সাবেক প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমীন চৌধুরী (১ মার্চ ২০০১-১৭ জুন ২০০২) প্রথম আলোকে বলেন, আইনজীবীরা যদি নিবেদন করতেন, তাহলে ১১৬ অনুচ্ছেদকে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোবিরোধী বলে বাতিল করা সম্ভব ছিল। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার স্বার্থে এখনো তা হওয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন।