মোদির অতি আত্মবিশ্বাসেই তাকে ডুবাবে

মোদির অতি আত্মবিশ্বাসেই তাকে ডুবাবে

মনি শংকর আয়ার

যখন ভোট গণনার পর নির্বাচনে প্রকৃত ফলাফল বুথ ফেরত জরিপের পূর্বাভাসকে পুরো পাল্টে দিল, তখন আমাদের ভাবনায় এক সপ্তাহব্যাপী এই উচ্ছ্বাস ছিল যে, “আমরা জনগণ” গণতন্ত্র উদ্ধার করে ফেলেছি; কর্তৃত্ববাদকে কিছুটা হলেও হটিয়েছি; ক্রমশ স্বৈরশাসক হয়ে ওঠা শাসকের লাগাম টানতে পেরেছি। আমরা আমাদের সংবিধান রক্ষা; গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুনরুজ্জীবিত হয়েছে; আইন প্রয়োগকারী এবং তদন্তকারী সংস্থাগুলোর অপব্যবহারের ইতি টানা হয়েছে। ‘গদি মিডিয়ার যুগ শেষ করেছি; যেসব মিডিয়ায় অমানবিক হুমকির ব্যাপারে ইসলামবিরোধী সাম্প্রদায়িকতা দেখানো হয়েছে।  আমাদের মৌলিক অধিকারগুলোতে যা বলা হয়েছে তা পুনরুদ্ধার করেছি।

মোদির এই আত্মগরিমাকে এস্কিলাসের নাটক ‘দ্য পার্সিয়ানস’-এর পারস্য সম্রাট জারক্সেসের সঙ্গে তুলনা করেছেন দর্শনের একজন ইমেরিটাস অধ্যাপক। ওই নাটকে জারজিসের আত্মগরিমা ও মুর্খতার মিশ্রণে ভুলভাবে গ্রিস আক্রমণের বিষয়টি চিত্রিত হয়। এই আক্রমণের পর দেখা গেল দেশের জনগণকে নিপীড়ন চালালে তারা আর মুখ বুঝে তা সহ্য করছে না। বরং তীব্র প্রতিবাদ করছে।

গত দুই সপ্তাহে দেখা গেছে, নির্বাচনের এই ফলাফলকে মোদি সেভাবে দেখছেন না। তার জন্য, কিছুই পরিবর্তন হয়নি। ভয়ংকর অমিত শাহসহ কার্যত আগের মন্ত্রীদের নিয়েই তিনি শপথ নিয়েছেন। তিনি প্রধান জোটের অংশীদারদের মধ্যে অগুরুত্বপূর্ণ পদগুলি বিতরণ করেছেন এবং জোট সদস্যদের স্পিকারের পদ দেওয়ার অনুরোধে কান দেননি। এর মাধ্যমে স্পষ্টই তিনি এই বার্তা দিয়েছেন, সরকার পরিচালনায় এবং নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের দীর্ঘ আয়ুর নিয়ন্ত্রণ তিনি হারাতে চান না।  দীর্ঘায়ুতে তার লৌহদৃষ্টি শিথিল করার কোনো ইচ্ছা তার নেই।

শুধু তাই নয়, তিনি এই সত্যকেও মানতে চান না যে তাকে এখন পুনরুজ্জীবিত একটি বিরোধী দলকে মোকাবিলা করতে হবে, যারা সংসদে একটি সুযোগের অপেক্ষায় আছেন। কারণ মোদির সরকার গঠনের এই সংখ্যাগরিষ্ঠতা ‘খুবই ভঙ্গুর’ এবং জোট সরকার গঠনের ফলে সেই সুযোগ বিরোধীদের রয়েছে—যেমনটা কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী বলেছেন।

অন্যদিকে কেজরিওয়ালকে জামিন দেওয়া হয়েছে, শুধু বিষয়টিকে অতি দ্রুততার সঙ্গে পাশে সরিয়ে রাখার জন্য। আট বছর অব্যাহত কারাবাসের মধ্যে থাকা প্রকৌশলী শেখ আব্দুল রশিদ নির্বাচনে জিতেও এখনও জানেন না শপথ নেওয়ার জন্য তিনি জামিন পাবেন কিনা; কারাগারে থেকে কিংবা মুক্ত মানুষ হিসেবে তিনি উত্তর কাশ্মীরে তার নির্বাচনী এলাকায় দয়িত্ব পালন করতে পারবেন কিনা।

দানবীয়ভাবে, অরুন্ধতী রায়কে ড্রাকোনিয়ান (অতি কঠোর) ইউএপিএ আইনে অভিযুক্ত করা হয়েছে। দশ বছর আগে দেওয়া এক বক্তব্যের জন্য বিনা জামিনে কারাবন্দী করার হুমকি দেওয়া হয়েছে। দুজন ফরাসী সাংবাদিককে ‘দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে’। তারা দীর্ঘ সময় ধরে ভারতীয় নাগরিকের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে থাকলেও তাদের ভারতের বিদেশি নাগরিক মর্যাদা কেড়ে নেওয়া হয়েছে।

অতি সংষ্কৃতময় নামের তিনটি নতুন ফৌজদাবি আইন করা হয়েছে ‘ঔপনিবেশিক চিন্তাকাঠামার’ দাগ দূর করবে। যদিও উপনিবেশকালের নিপীড়ন বহাল রাখা হয়েছে; যেমন পার্লামেন্টে পর্যালোচনার সুযোগ না দিয়েই ‘রাষ্ট্রদ্রোহের’ বিধান বাস্তবায়ন করা যাবে।

নির্বাচনী এলাকার মুসলমানদের জন্য কিছু করবেন না, তারা তাকে ভোট দেয়নি, তারা গাজওয়া-ই-হিন্দ এনে ভারতে হিন্দুত্ববাদ দুর্বল করেছে -এমন বক্তব্যের জন্য পুনর্নিয়োগ পাওয়া কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গিরিরাজ সিংকে সরানো হয়নি। এ সব কিছুই ঘটেছে মাত্র ১৪ দিনে! বুরবন রাজাদের মতো মোদি ‘কিছুই শেখেননি এবং কিছুই ভোলেননি’।

এটাই মোদির ধ্বংস আনবে। ২০২৬ সালের জনশুমারির পর যখন সীমানারেখা টানার বিষয় উঠবে তখন জাতীয় ঐক্যের কী হবে? দক্ষিণাঞ্চলের কঠোর হুঁশিয়ারি সামলানোর দক্ষতা মোদির আছে? নীতিশ কুমার ও চন্দ্রবাবু নাইড়ু ততদিন সঙ্গে থাকবেন যতদিন তাদের স্বার্থ হাসিল হবে। তাদের উদ্দেশ্য হলো- কেন্দ্র থেকে সুবিধা নেওয়া এবং সংখ্যালঘুদের আনুগত্য অর্জন করা। তাহলে আর্থিক বিকেন্দ্রীকরণ, সহযোগিতামূলক ফেডারেশন গঠন এবং সবখানে সমান  বিধিবিধান তৈরির কী হবে?

‘এক জাতি, এক নির্বাচন’ আর নয়, ‘বর্ণ শুমারি’ আর নয়? আরএসএস কি তাদের এসব প্রধান দাবিগুলোর পরিত্যাগ নীরবে মেনে নিয়েছে? তাহলে মোদি কিভাবে আরএসএসের আক্রমণ সামলাবেন, যার ইঙ্গিত এরই মধ্যে মোহন ভগত দিয়ে রেখেছেন? আরএসএসের সহযোগিতায় কোনো গড়করি ক্ষমতারোহণ হবে কি?

একদা পার্লামেন্টে মোদি আমাকে সতর্ক করেছিলেন, খুব শিগগিরই আমি বিস্মৃতির সাগরে হারিয়ে যাব। খুব দ্রুতেই মোদি সেখানে আমার সঙ্গে যোগ দেবেন।

(দি উইক থেকে অনূদিত)
মনি শংকর আয়ার, ভারতের সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী

Bangla Outlook

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here