২০২৩-২৪ অর্থবছর: শীর্ষ দুই গন্তব্য থেকে দেশে রেমিট্যান্স আসা কমেছে

রোহান রাজিব : সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত বাংলাদেশি প্রবাসীরা সবসময় রেমিট্যান্স পাঠানোয় শীর্ষে থাকেন। কয়েক বছর ধরেই এ দুই দেশ শীর্ষ অবস্থান ধরে রাখলেও ২০২৩-২৪ অর্থবছর তার ব্যতিক্রম চিত্র দেখা গেছে। সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে এ দুই দেশ থেকে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স কমেছে। এতে গত অর্থবছর আরব আমিরাত রেমিট্যান্স পাঠানো শীর্ষে উঠে এসেছে। আগের অর্থবছরে শীর্ষে থাকা সৌদি আরব নেমে এসেছে তৃতীয় অবস্থানে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমলেও দেশটি দ্বিতীয় অবস্থানেই রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছর সৌদি আরব থেকে রেমিট্যান্স এসেছে ২৭৪ কোটি ডলার। তার আগের অর্থবছর এসেছিল ৩৭৭ কোটি ডলার। অর্থাৎ দেশটি থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরের তুলনায় ২০২৩-২৪ অর্থবছর রেমিট্যান্স আসা কমেছে ১০৩ কোটি ডলার বা ২৭ দশমিক ৩২ শতাংশ। গত অর্থবছর দেশটি থেকে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসা কমেছে।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে গত অর্থবছর রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে ৫৬ কোটি ডলার বা ১৫ দশমিক ৯১ শতাংশ। সদ্য বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছর দেশটি থেকে রেমিট্যান্স এসেছে ২৯৬ কোটি ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছর এসেছিল ৩৫২ কোটি ডলার।

খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, সৌদি আরবে সাম্প্রতিক সময়ে অভিবাসন নীতি কঠোর করায় বৈধ ভিসায় যাওয়া অনেক প্রবাসীও শ্রমিক চাকরি পাচ্ছেন না; তাদের অনেকেই কাজ না পেয়ে দেশে ফিরে আসছেন। এছাড়া দেশটি ওয়ার্ক পারমিট নবায়নও কঠিন করায় অনেকে ভিসা নবায়ন করতে না পেরে দেশে ফিরছেন। এসব কারণে সৌদি আরব থেকে প্রবাসী আয় কমে গেছে। আর গত দুই বছরে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারেÑএ আশঙ্কায় সেখান থেকে দেশে অর্থ আসা বেড়ে গিয়েছিল। সে কারণে গত কয়েক বছর দেশটি থেকে প্রবাসী আয় অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। তবে জাতীয় নির্বাচনের পর নিষেধাজ্ঞার শঙ্কা কেটে যাওয়ায় এখন আবার প্রবাসী আয় আসা কমে গেছে।

২০২৩-২৪ অর্থবছর এ দুই দেশ ছাড়াও কুয়েত ও কাতার থেকে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স আসা কমেছে। গত অর্থবছর কুয়েত থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ ৪ দশমিক ৪৯ শতাংশ কমেছে। কাতার থেকে কমেছে ২১ দশমিক ৩৮ শতাংশ।

এদিকে গত অর্থবছর সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স এসেছে বাংলাদেশে, যার পরিমাণ ৪৬০ কোটি ডলার। তার আগের অর্থবছর দেশটি থেকে রেমিট্যান্স এসেছিল ৩০৩ কোটি ডলার। অর্থাৎ বিদায়ী অর্থবছর দেশটি থেকে রেমিট্যান্স বেড়েছে ৫১ দশমিক ৮১ শতাংশ।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমানে দেশের ধনী গোষ্ঠী, ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের অন্যতম পছন্দের গন্তব্য হয়ে উঠেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)। দেশটিতে বাংলাদেশিদের ব্যবসা, বিনিয়োগ ও সম্পত্তি কেনা বাড়ছে। এ কারণে বিশ্লেষকদের কেউ কেউ ধারণা করছেন, দেশ থেকে দুবাইয়ের পাচার হওয়া অর্থের একটি অংশ হয়তো পাচারকারীরা ফেরত আনছেন প্রণোদনার সুবিধা নিতে। প্রণোদনার সুবিধা নেয়ার পর সেই অর্থ হয়তো আবারও অবৈধপথে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে ইউএই থেকে প্রবাসী আয় আসা হঠাৎ করে বেড়ে গেছে।

সম্প্রতি রাজধানীর মিরপুরে বিআইবিএমের এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনও এমন কথা বলেছেন। ফরাসউদ্দিন ওই অনুষ্ঠানে বলেন, সরকার প্রবাসী আয়ে যে প্রণোদনা দিচ্ছে, তার বড় অংশ রাঘববোয়াল ও মধ্যস্বত্বভোগীদের পেটে যাচ্ছে। তারা প্রণোদনার কিছু অংশ প্রবাসী আয় যারা পাঠাচ্ছে তাদের দিচ্ছে, বাকিটা নিজেরা নিয়ে চোরাই পথে অর্থ আনছে।

ইউএইর পাশাপাশি গত অর্থবছরে যুক্তরাজ্য থেকেও প্রবাসী আয় আসা বেড়েছে। সদ্যবিদায়ী অর্থবছর দেশটি থেকে প্রবাসীরা ২৭৯ কোটি ডলার প্রবাসী আয় পাঠিয়েছেন। আর তার আগের অর্থবছর দেশটি থেকে এসেছিল ২০৮ কোটি ডলার। ফলে গত অর্থবছরে আয় বেড়েছে ৩৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। এছাড়া গত অর্থবছর মালয়েশিয়া থেকে রেমিট্যান্স ৪১ দশমিক ৫৯ শতাংশ, ওমান ৪১ দশমিক ৭৭ শতাংশ, ইতালি ২২ দশমিক ৬৯ শতাংশ এবং সিঙ্গাপুর থেকে প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সদ্যবিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় এসেছে দুই হাজার ৩৯১ কোটি ডলার। এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরে এসেছিল দুই হাজার ১৬১ কোটি ডলার। সে হিসেবে গত অর্থবছর প্রবাসী আয় বেড়েছে প্রায় ১০ দশমিক ৬৬ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল প্রায় তিন শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রবাসী আয়ে ১২ দশমিক ৭৮ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়।

বিদায়ী অর্থবছর রেমিট্যান্স আহরণকারী শীর্ষ পাঁচ ব্যাংকের মাধ্যমে মোট রেমিট্যান্সের ৪৫ দশমিক ৩২ শতাংশ এসেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, গেল অর্থবছর সবচেয়ে রেমিট্যান্স আহরণকারী ব্যাংক হলো ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ। ব্যাংকটির মাধ্যমে এসেছে ৬১২ কোটি ডলার। এরপর সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে ১৬৬ কোটি ডলার, জনতা ব্যাংকে ১০৭ কোটি, ব্র্যাক ব্যাংকে ১০৩ কোটি এবং অগ্রণী ব্যাংকের মাধ্যমে ৯২ কোটি ডলার এসেছে।

প্রবাসী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করে রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট (রামরু)। সংস্থাটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার তাসনিম সিদ্দিকী শেয়ার বিজকে বলেন, সৌদি আরব থেকে বেশকিছু দিন ধরে রেমিট্যান্স আসা কমেছে। মূলত যারা দেশটিতে যাচ্ছে অনেকে কাজ পাচ্ছে না; যাদের অনেকেই দেশে ফিরে আসছেন। আবার অনেকে কাজ পেলেও বেতন কম পাচ্ছে। এসব কারণে সৌদি থেকে রেমিট্যান্স কমতে পারে।

তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে গত কয়েক বছর অস্বাভাবিক রেমিট্যান্স বেড়েছিল। মূলত বাংলাদেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারেÑএ আশঙ্কায় সেখান থেকে দেশে অর্থ আসা বেড়ে গিয়েছিল। নিষেধাজ্ঞার শঙ্কা কেটে যাওয়ায় এখন আবার আয় আসা কমে গেছে।

তাসনিম সিদ্দিকী আরও বলেন, রেমিট্যান্স আসা একেক সময় একেক দেশ থেকে বাড়ে বা কমে, এটা স্বাভাবিক বিষয়। যদি রেমিট্যান্সের ওভারঅল প্রবৃদ্ধি ভালো হয়, তাহলে এটা খুশি হওয়ার বিষয়।

sharebiz