বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) গভীর রাতে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের প্রবেশ ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে দাবি করে এর প্রতিবাদে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে গতকাল শুক্রবার উত্তাল ছিল বুয়েট ক্যাম্পাস।
শিক্ষার্থীদের দাবি, আবরার ফাহাদ হত্যার পর বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ থাকার পরও গত বুধবার মধ্যরাতের পর বহিরাগত কিছু নেতা–কর্মী বুয়েট ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে রাজনৈতিক কার্যক্রম চালান।
এর প্রতিবাদে পাঁচ দফা দাবিতে গতকাল বেলা আড়াইটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত টানা বিক্ষোভ শেষে আজ শনিবার আবারও বিক্ষোভের ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। তাঁদের ভাষ্য, বুধবার মধ্যরাতের পর ক্যাম্পাসে ‘বহিরাগতদের’ প্রবেশ ও রাজনৈতিক সমাগমের মূল সংগঠক পুরকৌশল বিভাগের ছাত্র ইমতিয়াজ হোসেন; যিনি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। তাই তাঁকে বুয়েট থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার ও তাঁর হলের সিট বাতিলসহ তাঁর সহযোগীদেরও বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কারের দাবি জানান বিক্ষোভকারীরা।
এ ছাড়া ‘বহিরাগত রাজনৈতিক ব্যক্তিরা’ কেন কীভাবে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করার অনুমতি পেলেন, সে ব্যাপারে বুয়েট প্রশাসনের সুস্পষ্ট জবাব, ছাত্রকল্যাণ পরিদপ্তরের পরিচালকের (ডিএসডব্লিউ) পদত্যাগ এবং আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে কোনোরকম হয়রানিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়ার লিখিত প্রতিশ্রুতি চেয়েছেন বিক্ষোভকারীরা।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ছাত্রলীগের নেতারা প্রায়ই বুয়েট ক্যাম্পাসে আসেন এবং রাতে ক্যাফেটেরিয়ার সামনে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালান। বুধবার মধ্যরাতের পর মোটরসাইকেলযোগে বেশ কজন নেতা–কর্মী ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেছেন—এমন একটি ভিডিও শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রচার পায়। বহিরাগত নেতা–কর্মীদের বুয়েট ক্যাম্পাসে প্রবেশের সুযোগ করে দেওয়া শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিতে গতকাল বেলা আড়াইটার দিকে বুয়েটের শহীদ মিনারের সামনে বিক্ষোভ শুরু করেন এক দল শিক্ষার্থী। বিকেল নাগাদ জমায়েত বড় হয়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে ক্যাম্পাসে।
এরপর বিকেলে বুয়েট শহীদ মিনারে সংবাদ সম্মেলন করে শিক্ষার্থীরা পাঁচ দফা দাবি তুলে ধরেন। তাঁরা দাবি আদায়ে শনিবার ও রোববারের (৩০ ও ৩১ মার্চ) পরীক্ষাসহ সব একাডেমিক কার্যক্রম বর্জনের ঘোষণা দেন।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, রাত সাড়ে ১০টার পর নিরাপত্তার কারণে বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীদেরই ক্যাম্পাসে ঢোকার অনুমতি নেই। অথচ বুধবার দিবাগত রাত একটার দিকে ‘একটি বিশেষ রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের’ বেশ কজন শীর্ষস্থানীয় নেতা বুয়েট ক্যাম্পাসের প্রধান ফটক দিয়ে ভেতরে ঢোকেন। শুধু তাঁরাই নন, রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একের পর এক বহিরাগত রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর মোটরসাইকেল ও প্রাইভেট কার ক্যাম্পাসের প্রধান ফটকের সামনে আসতে থাকে। রাত দুইটার পর মিছিলের মতো করে বিশাল একটি বহর ফুলের তোড়া নিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে। সেই জনবহরের সবাই বহিরাগত এবং তাঁদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ছিল।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বুয়েটের নীতিমালা অনুযায়ী, এখানে সাংগঠনিক রাজনীতি নিষিদ্ধ। সেখানে রাতের আঁধারে এত বড় একটি রাজনৈতিক সমাগম এবং বহিরাগতদের আগমনের ঘটনা ক্যাম্পাসের নিরাপত্তাব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এর দায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ও ছাত্রকল্যাণ পরিদপ্তর কোনোভাবে এড়াতে পারে না।
সংবাদ সম্মেলনের পর শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে বুয়েটের ড. এম এ রশীদ প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান নেন। সেখানে সন্ধ্যা পর্যন্ত তাঁদের বিক্ষোভ চলে। সেখানেই তাঁরা ইফতার করেন। ইফতারের পর সন্ধ্যা সাতটার দিকে বুয়েটের উপাচার্য সত্যপ্রসাদ মজুমদার সেখানে আসেন। এ সময় সহ-উপাচার্য আবদুল জব্বার খান ও ডিএসডব্লিউ মিজানুর রহমানও তাঁর সঙ্গে ছিলেন।
এ সময় উপাচার্য শিক্ষার্থীদের দাবি মানার বিষয়ে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেন এবং সময় চান। শিক্ষার্থীরা তাতে রাজি হননি। পরে উপাচার্য চলে যান।
এরপর বিক্ষোভকারীদের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়, দাবি আদায়ে তাঁরা শনিবার সকাল আটটায় আবারও বুয়েট শহীদ মিনারে সমবেত হবেন।
২০১৯ সালে আবরার ফাহাদ নামের এক শিক্ষার্থীকে বুয়েটের হলে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে। এরপর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়।
আবরার ফাহাদকে হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত সবাই ছিলেন ছাত্রলীগের বুয়েট শাখার নেতা–কর্মী। এই ঘটনায় করা মামলার রায় হয় ২০২১ সালে। রায়ে ২০ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।
গতকাল বুয়েটের ক্যাম্পাসে বিক্ষোভে শিক্ষার্থীদের হাতে ছিল ‘আবরার ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে দেব না’ লেখা প্ল্যাকার্ড। তাঁদের বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্লোগান দিতে দেখা যায়।
রাতে বুয়েটের বিজ্ঞপ্তি
এদিকে গতকাল রাতে এক বিজ্ঞপ্তিতে বুয়েট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ২৭ মার্চ (বুধবার) দিবাগত রাত একটার দিকে বুয়েট ক্যাম্পাসে সংঘটিত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ২১ ব্যাচের পুরকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ হোসেনের হলের সিট বাতিলসহ কর্তৃপক্ষ কয়েকটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ ছাড়া সার্বিক বিষয়ে তদন্তপূর্বক সুপারিশ প্রদান করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হবে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর বুয়েটের নিয়মানুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর টার্ম, সেমিস্টার ফাইনালসহ সব একাডেমিক কার্যক্রম চলমান থাকবে।
রেজিস্ট্রার অধ্যাপক মো. ফোরকান উদ্দিনের সই করা এই বিজ্ঞপ্তি গতকাল রাত ১০টার দিকে বুয়েটের নোটিশ বোর্ডে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় বলে জানা গেছে। নোটিশটি রাতে বুয়েটের ওয়েবসাইটেও দেওয়া হয়।
prothom alo