ভয়ভীতি, প্রলোভন, হামলা-মামলা আর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ জেনেও ঐক্যবদ্ধ বিএনপির নেতাকর্মী। কেউ দল ছেড়ে যাননি, দলও ভাঙেনি। এর ওপর ভরসা করেই আবারও রাজপথের আন্দোলনে ফিরতে চায় দলটি। শিগগির লক্ষ্য অর্জনে ‘ধীরে চলো নীতিতে’ চতুর্মুখী তৎপরতা শুরু করেছেন দলটির ‘সতর্ক’ হাইকমান্ড। নির্দলীয় সরকারের অধীনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি আদায়ে ব্যর্থ হলেও ‘দৃঢ় মনোবল’ রয়েছে দলটির মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীর। তৃণমূল থেকে শক্তির সঞ্চার করে সরকারবিরোধী এক দফা আন্দোলন শুরু করতে চাচ্ছেন তারা। এ প্রক্রিয়ায় প্রথমে সারাদেশে হামলা-মামলায় নির্যাতিত নেতাকর্মীকে আবারও সক্রিয় করতে নেওয়া হয়েছে নানাবিধ পরিকল্পনা। সারাদেশে সাংগঠনিক তৎপরতা জোরদার করা হচ্ছে। একই সঙ্গে দাবির সপক্ষে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়ে জোর তৎপরতাও শুরু করা হয়েছে।
দলের নেতাকর্মীরা জানান, রাজপথের আন্দোলন শুরু ও সরকার পতনের এক দফা দাবি আদায় করতে নিজেদের আরও শক্তিশালী ও সুসংহত করবেন। এ জন্য নেওয়া হয়েছে নানা পরিকল্পনা। লক্ষ্য অর্জনে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদ ছাড়াও সংসদ বাতিল আর ‘এক দফা’ দাবি আদায়ে কর্মসূচি অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত রয়েছে দলটির। এ জন্য তৃণমূল পর্যায়ে ইস্যুভিত্তিক ধারাবাহিক কর্মসূচি দেওয়া হবে। ওই আন্দোলনে জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর পাশাপাশি সংগঠনের দুর্বলতা চিহ্নিত করে তা মেরামত করা হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান সমকালকে বলেন, ‘আমাদের রাজপথের চলমান আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। এটা চালিয়ে যাব। কোন সময়ে, কোন ধরনের কর্মকাণ্ড চলবে, তা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে।’
দলের বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা জানান, ১৭ বছরের বেশি ক্ষমতার বাইরে থেকে সীমাহীন নির্যাতন, মামলা-হামলার পরও দলের মধ্যে কোনো বিভেদ তৈরি করতে পারেনি কেউ। কোনো ফাটলও আসেনি। লোভ-লালসা, প্ররোচনা, হুমকির মধ্যেও কেউ দল ছেড়ে যাননি। জিয়া পরিবারের নেতৃত্বের ওপর অবিচল রয়েছে একেবারে তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত। আর এটাকেই নিজেদের শক্তি হিসেবে বিবেচনা করছেন তারা। এটাকেই মূলমন্ত্র হিসেবে দেখছেন তারা। আর এ শক্তিকেই প্রাধান্য দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে নিজেদের কর্মপদ্ধতি ঠিক করতে চাচ্ছেন দলের হাইকমান্ড।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সমকালকে জানান, বিএনপির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এ দলকে ভাঙতে ও দুর্বল করতে নানা ষড়যন্ত্র হয়েছে। এ দলের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করে নেতাকর্মী আর সাধারণ জনগণের মন থেকে বিএনপিকে মুছে ফেলারও চেষ্টা হয়েছে। এখনও চলছে। তবে কোনো কালে তা সফল হয়নি। বরং যত নির্যাতন হয়েছে, দলটির নেতাকর্মীরা তত বেশি ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন, জিয়া পরিবারের প্রতি তত বেশি আস্থা রেখেছেন। এবারও এই ডামি সরকার অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু সফল হয়নি। দলের প্রত্যেক নেতাকর্মী যেমন ঐক্যবদ্ধ রয়েছেন, তেমনি জনগণের আস্থাও আগের চেয়ে আরও অনেক বেশি অবিচল রয়েছে বিএনপির ওপর। সেখান থেকেই তারা আবার ঘুরে দাঁড়াবেন।
নেতারা অভিযোগ করে জানান, দেশের ইউনিয়ন, গ্রাম ও ওয়ার্ড থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় বিএনপির এমন কোনো নেতা নেই, যার বিরুদ্ধে মামলা নেই। এমন কেউ নেই, যাকে কারাগারে যেতে হয়নি। দলের এমন কেউ নেই, যার রুটি-রুজিতে আঘাত আসেনি। অনেক নেতাকর্মী বছরের পর বছর বাড়িছাড়া, উদ্বাস্তুর মতো জীবন ধারণ করছেন। এমন পরিস্থিতিতেও কেউ দল ছেড়ে যাননি। অনেকে হয়তো নিষ্ক্রিয় হয়েছেন, অনেকে হয়তো পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এবার তাদেরও সক্রিয় করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। তাদেরও আবার মাঠের রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। তাদের সবাইকে এক কাতারে নিয়ে দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আর ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনার আন্দোলন জোরদার করা হবে বলে বিএনপির শীর্ষ নেতারা জানান।
একই সঙ্গে বৈশ্বিক রাজনীতির পরিবর্তিত পরিস্থিতির নিরিখে নিজেদের অবস্থান আরও স্পষ্ট করতে নানা পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলোর সঙ্গে যেমন ঘনিষ্ঠতা আরও বাড়াতে চাচ্ছেন, তেমনি মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গেও জোরদার করা হবে সম্পর্ক। বিশেষত, সৌদি আরবের সঙ্গে আগের পর্যায়ে সম্পর্ক স্থাপনে নজর দেবে বিএনপি। এর পাশাপাশি শক্তিশালী অন্য দেশগুলোকেও গুরুত্ব দেওয়া হবে এবার। এরই মধ্যে ‘একতরফা’ নির্বাচনসহ বিরোধী দলের ওপর সর্বোচ্চ নির্যাতন, ‘ফরমায়েশি’ রায় ছাড়াও চলমান পরিস্থিতি উল্লেখ করে ঢাকার বিদেশি দূতাবাস ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাকে অবহিত করেছে দলটি। তৈরি করা হচ্ছে নির্যাতনের প্রামাণ্যচিত্র। যেটা বিভিন্ন দূতাবাসে দেওয়া হবে বলে জানা গেছে।
তবে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে ভারতের অবস্থান নিয়ে এবার বিএনপিও পাল্টা অবস্থান হিসেবে ‘ভারতবিরোধী’ অবস্থানকে জোরালো করছে। দলের শীর্ষ পর্যায়ে থেকে এই অবস্থান যতটা না স্পষ্ট করা হবে, তার চেয়ে বেশি নেতাকর্মী আর সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হবে। এরই মধ্যে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘বয়কট’ আহ্বান জানিয়ে প্রচারণা শুরু করেছেন সরকারবিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা। যেটাকে আরও তীব্র করা হবে।
বিএনপির কয়েকজন সিনিয়র নেতা জানান, একদিকে দলকে যেমন আন্দোলনের জন্য উপযোগী করে গড়ে তোলা হবে, তেমনি আন্দোলনের মোক্ষম সময়ের জন্য তারা অপেক্ষা করবেন। নেতারা আশঙ্কা করছেন, সরকার রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে যেনতেন নির্বাচন করলেও তাদের শেষ রক্ষা হবে না। একদিকে আন্তর্জাতিক বিশ্ব ওই নির্বাচনকে যেমন বৈধতা দেয়নি, তেমনি দেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থায় বেহাল সরকার। আসন্ন রোজায় সেটা আরও তীব্র হবে। এমনিতেই জনগণ এই সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ, তার ওপর নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম যখন একেবারে নাগালের বাইরে যাবে, তখন পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সরকারের জন্য কষ্টসাধ্য হবে। আর সেটাকেই আন্দোলনের জন্য উপযুক্ত সময় মনে করছেন তারা।
দেশে গণতন্ত্র আর ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনতে ২০২২ সাল থেকে রাজপথের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন শুরু করে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। সরকারের বাধা, হামলা আর মামলার মধ্যে নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচি দিয়ে তারা জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে সব দলমত আর সংগঠনকে এক কাতারে নিয়ে আসে। তবে আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ পণ্ড হয়ে যায়। সেদিন থেকে শুরু হয় রাজপথের হরতাল-অবরোধ আর শেষ পর্যায়ে অসহযোগ আন্দোলন। অন্যদিকে, মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনায় দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর থেকে শুরু করে অনেক শীর্ষ নেতাসহ সারাদেশে ২৭ হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে নেওয়া হয়। চলে সাঁড়াশি অভিযান। গ্রেপ্তার এড়াতে দলের প্রতিটি স্তরের নেতাকর্মী ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। এ সময় টানা হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচিতে সারাদেশে ১ হাজার ১৮৪ মামলায় ১ লাখ ৫ হাজার ৬৮৪ জনকে আসামি করা হয়। একজন সাংবাদিকসহ মৃত্যুবরণ করেন ২৮ জন। ৯ হাজার ৭০৪ জন আহত হন বলে দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
নেতাকর্মীরা জানান, সারাদেশে দলটির ওপর দিয়ে বয়ে চলা নির্যাতনের এই সুনামির মধ্যেও কেউ দল ছেড়ে যাননি। আর এটাকেই আগামী দিনের আন্দোলন-সংগ্রামের প্রেরণার উৎস হিসেবে বিবেচনা করে শুরু করা হয়েছে কর্মপরিকল্পনা। সারাদেশে নির্যাতিত নেতাকর্মীর তালিকা তৈরির কাজ প্রায় শেষ করা হয়েছে। নিহত কিংবা আহত পরিবারের পাশে দাঁড়াতে দলের শীর্ষ নেতাদের দায়িত্ব বণ্টন করা হয়েছে। তারা প্রত্যেকের বাসাবাড়িতে যাবেন, সহযোগিতা করবেন, পাশে দাঁড়াবেন। যা গতকাল থেকে শুরু করেছেন নেতারা।
এর পাশাপাশি সারাদেশে কর্মী-সমর্থকদের সক্রিয় করতে, কর্মসূচিতে ফিরিয়ে আনতে ভার্চুয়াল আলোচনা শুরু করা হয়েছে। প্রতিটি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের নেতাকর্মীর সঙ্গে কেন্দ্রীয় নেতারা নিয়মিত সভা করছেন, মতবিনিময় করছেন। তাদের সুবিধা-অসুবিধা জানছেন, সমস্যার সমাধানও করছেন কেন্দ্রীয় বিএনপি থেকে শুরু করে এর অঙ্গসংগঠনের নেতারা। এরই মধ্যে জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের উদ্যোগে সারাদেশে এই মতবিনিময় সভা সম্পন্ন করা হয়েছে। ছাত্রদল ও যুবদলের উদ্যোগ চলমান রয়েছে। অন্যান্য অঙ্গসংগঠনের ব্যানারেও চলছে একই কর্মযজ্ঞ।
যুবদলের নেতাকর্মীরা জানান, সম্প্রতি আড়াই মাসের আন্দোলনে সারাদেশে তাদের যে ক্ষতি হয়েছে, তা পূরণ করতে কেন্দ্রীয় যুবদলের নেতারা উদ্যোগী হয়েছেন। তারা ক্ষতিগ্রস্ত নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলছেন, তাদের মামলা পরিচালনায় আইনজীবী নিয়োগ থেকে শুরু করে হামলায় আহতদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করছেন। বিগত আন্দোলনে দলের পক্ষ থেকে যুবদল সভাপতিকে যেমন সারাদেশের নেতাকর্মীকে মাঠে সক্রিয় রাখতে, আন্দোলন জোরদার করতে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, এবারও সে ভূমিকায় কাজ করছেন তিনি। একইভাবে স্বেচ্ছাসেবক ও ছাত্রদলের দুই শীর্ষ নেতা সারাদেশের নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলছেন, রাজনীতি আর কর্মসূচিতে সক্রিয় করতে উৎসাহিত করছেন।
যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু বলেন, বিএনপির নেতাকর্মীর হারানোর আর কিছু নেই। এখন হারানোর আতঙ্ক কাজ করছে ক্ষমতাসীনদের মধ্যে। এ অবস্থায় আবারও রাজপথের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এই সরকারের পতনকে নিশ্চিত করা হবে। দেশের গণতন্ত্র আর ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনা হবে।
samakal