গুঞ্জন সিং
দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের বাড়বাড়ন্ত প্রভাব ভারতকে প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্কচর্চায় পিছিয়ে দিয়েছে। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং তাঁর বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) কারণে দক্ষিণ এশিয়া নতুন মনোযোগ পেয়েছে। ভারতের সব প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে আগ্রহী চীন। এটি ভারতের কূটনৈতিক বুদ্ধিমত্তা ও অভিযোজনকে পরীক্ষায় ফেলছে। এটি ভারতকেন্দ্রিকতার ধারণাকে নতুন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের প্রভাবকেও চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।
শুরুতেই পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের সুবিদিত সম্পর্কের ইতিহাস বলা যায়। বেইজিংয়ের সঙ্গে ইসলামাবাদ দৃঢ় সম্পর্ক অব্যাহত রাখছে। তবে ভারতের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ এসেছে মালদ্বীপ থেকে। ‘ইন্ডিয়া আউট’ বা ভারত খেদাও স্লোগানের প্রচারণাকে গুরুত্ব দিয়ে মোহাম্মদ মুইজ্জু মালদ্বীপে ক্ষমতায় আসেন। তাঁর ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে।
শ্রীলঙ্কায় মাহিন্দা রাজাপাকসের সরকার চীনা বিনিয়োগকে স্বাগত জানায় এবং এই প্রক্রিয়ায় ভারত দূরে সরে যায়। ২০১৭ সালে কলম্বো বিআরআই উদ্যোগে যুক্ত হয়। সবাই জানেন, বিনিয়োগ ও অবকাঠামোর প্রলোভনের কারণে চীনা ঋণে জর্জরিত শ্রীলঙ্কা হাম্বানটোটা বন্দরকে চীনের কাছে ৯৯ বছরের জন্য লিজ দেয়। শ্রীলঙ্কা যে ঋণের ফাঁদে আটকে পড়েছে, তা দেশটির অর্থনীতি ও রাজনীতিকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। দেশটির এই দুরবস্থা বেইজিংকে ভারত মহাসাগরে শক্তিশালী অবস্থানের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে এবং চীনা জাহাজের অবস্থান সেখানে অব্যাহত রয়েছে। যদিও ভারতের কথা মাথায় রেখে কলম্বো চীনা জাহাজের জন্য এক বছরের স্থগিতাদেশ দিয়েছে; তবে এটি শ্রীলঙ্কায় চীনা উপস্থিতি কমাচ্ছে না।
অন্যদিকে নেপালেও বাড়ছে চীনের প্রভাব। ২০১৭ সালে কাঠমান্ডু বিআরআইতে যোগ দেয়; নেপালে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি প্রকল্প চলমান। নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্পকমল দহল প্রচণ্ড ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে চীন সফর করেন। তিনি বেশ কয়েকটি যৌথ সীমান্ত অবকাঠামো প্রকল্পে স্বাক্ষর করেন এবং বিআরআইর প্রতি তাঁর সমর্থন ব্যক্ত করেন। গত কয়েক বছরে ভারত-নেপাল সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। এর সুফল পেয়েছে বেইজিং। চীন বেশ কয়েকটি মেগা অবকাঠামো প্রকল্পের প্রতিশ্রুতি দেয়। এমনকি চীনের পিপল’স লিবারেশন আর্মিতে গোর্খাদের নিয়োগের ঘোষণা দেয়। এতে নেপালি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সংবাদমাধ্যম এবং চীনা মালিকানাধীন হোটেলগুলোয় চীনা ভাষা মান্দারিনের প্রচলন হয় এবং নেপালের বাঁধ নির্মাণ, রেলপথ ও সড়ক নির্মাণের মতো বিশাল অবকাঠামো প্রকল্পে চীন প্রবেশাধিকার পায়।
ঢাকা ২০১৬ সালে চীনের বিআরআই তথা বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে যুক্ত হয়। এর পর থেকে বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ ব্যাপকভাবে বাড়তে থাকে। ২০১৮ সালে যেখানে বাংলাদেশ ৯৯৪ মিলিয়ন ডলার চীনের সাহায্য পেয়েছিল; সেটা ২০২১ সালে বেড়ে হয় ৩.৪ বিলিয়ন ডলার। বিআরআই এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো প্রকল্পে বর্তমানে বাংলাদেশে চীনের ১০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ রয়েছে। এসবই হয়েছে শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে। সেখানে শেখ হাসিনা গত মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে টানা চতুর্থবারের মতো নির্বাচিত হয়েছেন। ভারত এ কারণে উদ্বিগ্ন যে, অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে শিলিগুড়ি করিডোরে গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশাধিকার পেতে পারে চীন।
কেবল ভুটানেই মনে হচ্ছে ভারতের প্রভাব বেশি। তবে সেখানেও সীমান্ত সমস্যা সমাধানে চীনের চাপ বাড়ছে। দেশটিতে চীনের দ্বিপক্ষীয় সফর উদ্বেগের কারণ হতে পারে। ভুটানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দরকার এবং চীনও এ ক্ষেত্রে সহায়তা করতে অতি আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে।
দক্ষিণ এশিয়ার বাস্তবতায় ভারতের এই চিত্র ভয়াবহ। দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের খেলায় নয়াদিল্লি ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছে।
এই উপসংহার টানা ভুল হবে না যে, চীনের অর্থনৈতিক সক্ষমতার সঙ্গে ভারত তাল মেলাতে পারছে না। সে জন্য এ অঞ্চলে চীনের প্রভাব মোকাবিলায় তাকে নতুন কিছু আবিষ্কার করতে হবে।
ড. গুঞ্জন সিং: সহকারী অধ্যাপক, জিন্দাল ল স্কুল, জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটি, ভারত; দ্য কুইন্ট থেকে ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক
samakal