বাংলাদেশের জন্য চীনা ঋণের অর্থ ছাড় কমে গেছে। আবার সাম্প্রতিক সময়ে কোনো প্রকল্পে অর্থায়নের নতুন কোনো প্রতিশ্রুতিও দেয়নি দেশটি।
গত দুই অর্থবছরে চীনা ঋণের অর্থ ছাড়ে বেশ গতি ছিল। এ সময় বেইজিং থেকে পাওয়া ঋণে বড় বড় প্রকল্পও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) আগের অর্থবছরের পুরো সময়ের তুলনায় অর্থ ছাড় হয়েছে তিন ভাগের এক ভাগ।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা গেছে, গত জুলাই-ডিসেম্বরে সব মিলিয়ে ৩৬ কোটি মার্কিন ডলার ছাড় করেছে চীন। বর্তমান বাজারদরে টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে চীন ছাড় করেছিল ৫৪ কোটি ডলার বা প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা। সেই হিসাবে অর্থ ছাড় কমেছে ১৮ কোটি ডলার বা ২ হাজার কোটি টাকা।
অন্যদিকে চীন সরকার গত জুলাই-ডিসেম্বরে কোনো প্রকল্পে ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়নি। তবে জাহাজ কেনার একটি প্রকল্পে অর্থায়নের দর-কষাকষি বর্তমানে চলমান। সব মিলিয়ে চীনা ঋণের ক্ষেত্রে ‘প্রতিশ্রুতিশূন্য’ ছয় মাস পার হয়েছে এবং ঋণের অর্থছাড় ৩২ শতাংশ কমেছে।
তবে চীনের আগ্রহের ঘাটতি নাকি চীনা ঋণে প্রকল্প বাস্তবায়নের ধীরগতির কারণে অর্থছাড় কমে গেছে, তা বিস্তারিত জানা যায়নি। নিয়ম অনুযায়ী, ঋণচুক্তির ক্ষেত্রে চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত সময় পরপর ঋণের অর্থ ছাড় করতে হয়।
সেই হিসাবে গত জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে চুক্তি অনুযায়ী চীনের পক্ষ থেকে কত ঋণ ছাড় করার কথা ছিল, সেই বিষয়ে বিস্তারিত কোনো তথ্য জানাতে পারেনি ইআরডি-সংশ্লিষ্ট সূত্র। তবে ঋণ ছাড়ের বিষয়টি অনেক সময় প্রকল্প বাস্তবায়নের গতির ওপরও নির্ভর করে। ইআরডির একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, চীন ডলারের বদলে এখন তাদের নিজস্ব মুদ্রা ইউয়ানে ঋণ দিতে বেশি আগ্রহী। তাই কর্মকর্তাদের কেউ কেউ মনে করছেন, বাংলাদেশ যাতে ইউয়ানে ঋণ নিতে আগ্রহী হয়, সে জন্য ডলারে ঋণ ছাড় কমিয়ে দেওয়ার কৌশল নিয়েছে চীন।
সর্বশেষ গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে চীন সব মিলিয়ে ১১৩ কোটি ডলার ছাড় করেছিল।
ইআরডির কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে,ডলার ও ইউয়ান—দুই ধরনের মুদ্রায় বাংলাদেশকে ঋণ দেয় চীন। তবে ইউয়ানে দেওয়া ঋণের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে অনেক কম। কারণ, বাংলাদেশের আগ্রহ বেশি ডলারে ঋণ নেওয়ার প্রতি।
চীন তার মুদ্রাকে শক্তিশালী করতে চাইছে, এ কথা জানিয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘চীনের সঙ্গে ঋণের চুক্তি হয়ে গেছে। তাহলে চলমান প্রকল্পে অর্থ ছাড়ে কেন বিলম্ব হবে? চুক্তি অনুযায়ী, অর্থ ছাড়ের আইনি বাধ্যবাধকতা আছে। চীনের অর্থের অভাব নেই। চীন কি মনে করছে, আমরা ঋণ পরিশোধ করতে পারব না? এমন হলে তা “রহস্যজনক”।’ তাঁর মতে, চীনের ঋণের প্রকল্পে চীনা ঠিকাদার কাজ করে। ঠিকাদারদের বিল পরিশোধ ইউয়ানে করা যেতে পারে। তবু অর্থ ছাড় গতি কমানো ঠিক হবে না।
সব মিলিয়ে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, রেল, সড়কসহ বর্তমানে ১৪টি প্রকল্প চীনা ঋণে বাস্তবায়ন হচ্ছে। এসব প্রকল্পে চীনা ঋণের অবদান এক হাজার কোটি ডলারের মতো। ইআরডি সূত্র জানায়, রাজশাহী ওয়াসা ও সরকারের জাহাজ কেনার আলাদা দুটি প্রকল্পে চীনের ঋণ ছাড় কম হয়েছে। এ কারণে প্রকল্প দুটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কিছুটা ধীরগতি ছিল।
ইতিমধ্যে বাংলাদেশের শীর্ষ ঋণদাতাদের তালিকায় ঢুকে গেছে চীন। বাংলাদেশকে ঋণ দেয়, এমন ৩২টি দেশ ও সংস্থার মধ্যে চীনের অবস্থান এখন চতুর্থ। চীনের ওপরে আছে শুধু জাপান, বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)।
ইউয়ানে ঋণ দিতে আগ্রহী চীন
গত মঙ্গলবার পরিকল্পনামন্ত্রী আবদুস সালামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনা মুদ্রা ইউয়ানে লেনদেনের বিষয়ে আগ্রহের কথা জানান ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন। বৈঠক শেষে ওই দিন চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন সাংবাদিকদের বলেন, ডলারের সমস্যা বর্তমানে বিশ্বব্যাপী বিরাজমান। যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রানীতির কারণে ডলারের দাম ওঠানামা করছে। চীনসহ প্রায় সব উন্নয়নশীল দেশই এ নিয়ে ভুগছে।
অন্যদিকে অর্থ ছাড় কমে যাওয়া সম্পর্কে ওই দিন পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, এই ধরনের ছোটখাটো সমস্যা আলোচনা করে সমাধান করা হবে।
ইআরডির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, ‘চীনা ঋণ মার্কিন ডলারে নিলে ঋণের খরচ ইউয়ানের তুলনায় কিছুটা বেশি পড়ে। তাই চীন ডলারের বদলে ইউয়ানে ঋণ দিতে বেশি আগ্রহী। আমরা ইতিমধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে এ বিষয়ে মতামত জানতে চেয়েছি।’ তিনি আরও বলেন, চীনা ঋণের গতি খুব বেশি কমেনি। তাদের অর্থায়নে বড় প্রকল্পগুলো চলমান রয়েছে।
তিন বছরে ঋণ ছাড় দ্বিগুণ
বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি আসার সঙ্গে সঙ্গে সাধারণত অর্থ ছাড়ও বাড়ে। তাই ২০১৯-২০ অর্থবছরের তুলনায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে এসে চীনের অর্থ ছাড় প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছিল। ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে চীনের ছাড় করা ঋণের পরিমাণ ছিল ৬০ কোটি ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা বেড়ে হয় ১১৩ কোটি ডলার। এর মধ্যে অবশ্য কোভিডের কারণে ২০২০-২১ অর্থবছরে ছাড় করা ঋণ কমে দাঁড়িয়েছিল ২৪ কোটি ডলারে। ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো ঋণ ছাড়ে বিলিয়ন ডলার ক্লাব বা শতকোটি ডলারের ক্লাবে প্রবেশ করে চীন।
স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালে চীন প্রথমবারের মতো বাংলাদেশকে ঋণ দেয়। পরে বহু বছর চীনের ঋণ তেমন একটা পাওয়া যায়নি। ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বাংলাদেশ সফর করেন। তখন বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রকল্পে ঋণসহায়তা বাড়ানোর ঘোষণা দেন তিনি। এর পর থেকেই চীনের ঋণে গতি আসে।
চীনা ঋণের একটি প্রধান অসুবিধা হলো, এটি পুরোটাই সরবরাহকারী ঋণ। চীনা কর্তৃপক্ষই ঠিকাদার নির্দিষ্ট করে দেয়। আবার ঋণ নিয়ে দর-কষাকষির পর্যায়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানই দামদর চূড়ান্ত করে থাকে। এতে কাজের মান ও খরচ নিয়ে অনেক সময় প্রশ্ন ওঠে। চীনা ঋণের ক্ষেত্রে দরপত্রের মাধ্যমে একাধিক দরদাতার দর দেখার সুযোগ থাকে না।
চীনা ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময়সীমাও বেশ কম। গ্রেস পিরিয়ড বাদ দিলে ১০-১৫ বছরে এ ঋণ পরিশোধ করতে হয়। এতে প্রতিটি কিস্তিতে অর্থের পরিমাণ বেশি হয়, যা সার্বিক ঋণ পরিশোধে চাপ সৃষ্টি করে।
সূত্র : প্রথম আলো