পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংকের কর্তৃত্ব নিয়ে সিকদার পরিবারের মধ্যেই বিরোধ দেখা দিয়েছে। প্রয়াত জয়নুল হক সিকদারের মেয়ে পারভীন হক সিকদার আছেন একদিকে, অন্যদিকে তাঁর দুই ভাই রিক হক সিকদার ও রন হক সিকদার। ভার্চুয়াল এজিএমে পাতানো ভোটের মাধ্যমে তাঁকে পর্ষদ থেকে বাদ দেওয়া হতে পারে– এমন শঙ্কায় পারভীন হক সিকদারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আগামীকাল ২১ ডিসেম্বর নির্ধারিত বার্ষিক সাধারণ সভার (এজিএম) ওপর স্থিতাবস্থা দিয়েছেন আদালত। এর আগে একই শঙ্কা জানিয়ে এজিএম বন্ধের উদ্যোগ নিতে শেয়ারবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির চেয়ারম্যান বরাবর চিঠি লিখেছেন তিনি।
ব্যাংকটির দীর্ঘদিনের চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদার মারা যান ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে। এর পর চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আছেন তাঁর স্ত্রী মনোয়ারা সিকদার। তাদের মেয়ে পারভীন হক সিকদার, ছেলে রিক হক সিকদার ও রন হক সিকদার ব্যাংকটির পরিচালক। ৯ সদস্যের পরিচালনা পর্ষদে সিকদার ইন্স্যুরেন্সের প্রতিনিধি হিসেবে আছেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. সফিকুর রহমান। সব মিলিয়ে ন্যাশনাল ব্যাংকে সিকদার পরিবারের শেয়ার রয়েছে ১৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ।
ন্যাশনাল ব্যাংকের এজিএমের ওপর আগামী ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত স্থিতাবস্থা জারি করেছেন চেম্বার আদালত। ব্যাংকটির নির্বাহী কমিটির চেয়ারপারসন পারভীন হক সিকদারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম গতকাল এ আদেশ দেন। আগামী ১৬ জানুয়ারি আপিল বিভাগে এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ শুনানি হবে। আদালতে পারভীন হক সিকদারের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন, অ্যাডভোকেট মোমতাজ উদ্দিন ফকির, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ মেহেদী হাসান চৌধুরী ও অ্যাডভোকেট আবদুন নূর দুলাল। ব্যাংকের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার তানজীবুল আলম ও অ্যাডভোকেট আহসানুল করিম।
আদালতে যাওয়ার বিষয়ে পারভীন হক সিকদার টেলিফোনে সমকালকে বলেন, এখানে অনেক অনিয়ম চলছে। এজিএমের তারিখ বা এজেন্ডা নিয়ে পর্ষদ থেকে কিছু অনুমোদন করা হয়নি। কীভাবে এসব হচ্ছে তা স্বাধীন কোনো পক্ষ পর্যবেক্ষণ করছে না। সুতরাং, এটা সন্দেহজনক কার্যক্রম। গত বছরের এজিএমে অনেক কিছু ঘটেছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নিয়ম না মেনে এজিএম আয়োজনের পেছনে আছে তাঁর দুই ভাই। এখন তিনি কোনো পদক্ষেপ না নিলে মনে হবে এই অনিয়মে তিনিও তাদের সঙ্গে যুক্ত। কোনো বিকল্প না থাকায় তিনি আদালতে গেছেন। ব্যাংকের এমডি মেহমুদ হোসেনকে কয়েক দফা টেলিফোন করেও পাওয়া যায়নি। রন হক সিকদারের টেলিফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।
অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন সমকালকে বলেন, এজিএম বিষয়ে দু’পক্ষের মধ্যে ঝামেলার কারণে বিষয়টি আদালতে এসেছে। অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ মেহেদী হাসান চৌধুরী সমকালকে বলেন, ২১ ডিসেম্বরের এজিএমের ওপর স্থিতাবস্থা দিয়েছেন আদালত। বিষয়টি কেন আদালতে এলো, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘একটি পক্ষ এজিএম করতে চেয়েছে ভার্চুয়ালি। পারভীন হক সিকদার চেয়েছেন এটা ফিজিক্যালি হোক। তিনি চান, ব্যাংকটি যেন আইন অনুযায়ী চলে। আমরা আদালতে বলেছি, এখন সারাদেশের সব ফিজিক্যালি হচ্ছে। এটা কেন ভার্চুয়ালি হবে।’
ব্যারিস্টার তানজীবুল আলম সমকালকে বলেন, পারভীন হক সিকদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত পরিচালনা পর্ষদের সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল, ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে এজিএম অনুষ্ঠিত হবে। এখন তিনি নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই চ্যালেঞ্জ করে কোম্পানি বেঞ্চে একটি মামলা করেছেন। তিনি বলেন, সভা যে ভার্চুয়ালি হবে, তা তো রন কিংবা রিক হক সিকদার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। পুরো পর্ষদ মিলে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিএসইসিতে দেওয়া আবেদনে যা আছে
এজিএম মুলতবির আবেদন জানিয়ে এর আগে ১৭ ডিসেম্বর বিএসইসি চেয়ারম্যান বরাবর চিঠি লেখেন পারভীন হক সিকদার। চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, ৬ ডিসেম্বর ব্যাংকের কোম্পানি সচিবের মাধ্যমে ২১ ডিসেম্বর ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে এজিএম আয়োজনের বিষয়টি তিনি জানতে পারেন। যদিও এজিএমের এজেন্ডা পরিচালনা পর্ষদ থেকে অনুমোদন হয়নি। এর আগে গত বছর ৩৯তম এজিএমে কোম্পানি আইনের বিধান অনুযায়ী (প্রতি বছর এক-তৃতীয়াংশ পরিচালক পদত্যাগের বাধ্যবাধকতা) উদ্যোক্তা পরিচালক মোয়াজ্জেম হোসেন, মাবরুর হোসেন ও রন হক সিকদার পদত্যাগ করেন। তবে পাতানো ভোটের মাধ্যমে মোয়াজ্জেম হোসেন ও মাবরুর হোসেনকে বাদ দেওয়া হয়। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী রন হক সিকদারকে পুনর্নির্বাচিত দেখানো হয়। এবার এজিএম সামনে রেখে একই পরিকল্পনা হচ্ছে বলে তিনি মনে করছেন।
চিঠিতে দুই ভাইয়ের নাম উল্লেখ না করে আরও বলেন, কতিপয় পরিচালক অনলাইনে পাতানো ভোটাভুটির মাধ্যমে একাধিক পরিচালককে বাদ দেওয়ার পরিকল্পনা করেছেন। তিনি আশঙ্কা করছেন, প্রহসনমূলক ভোটের মাধ্যমে একই প্রক্রিয়ায় পরিচালক পদ থেকে তাঁকে বাদ দেওয়া হবে। অতএব, কিছু পরিচালকের পুনর্নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অধিকতর স্বচ্ছতা আনার জন্য ৪০তম এজিএমে বিএসইসির সরাসরি তত্ত্বাবধানে আয়োজনের নির্দেশ দেওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি।
ব্যাংকের কী অবস্থা
আমানতকারীদের স্বার্থে প্রতিটি ব্যাংকের মোট আমানতের ১৭ শতাংশ বাধ্যতামূলকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকে রাখতে হয়। বেসরকারি ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের (এনবিএল) অবস্থা এতই খারাপ, টানা ১৪ মাস ধরে বিধিবদ্ধ এ তারল্য সংরক্ষণ করতে পারছে না। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৩৩৭ কোটি টাকা জরিমানা করলেও ব্যাংকটি তা পরিশোধ করার মতো অবস্থায় নেই। গ্রাহক চাহিদা মেটাতে এনবিএল তার সব বিল-বন্ড বন্ধক রেখে যতটুকু সম্ভব ধার নিয়ে ফেলেছে। এখন আর নতুন করে ধার করার মতো উপকরণ নেই।
ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এনবিএলের মোট ঋণের মধ্যে ২৪ হাজার ৭১৭ কোটি টাকা বা ৫৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ রয়েছে শীর্ষ ৩০ গ্রাহকের কাছে। কমিশন নিয়ে কিংবা ভুয়া ঋণ দেওয়ার অনেক নজির রয়েছে ব্যাংকটিতে। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এনবিএলের শ্রেণিকৃত খেলাপি ১৩ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা এবং অবলোপন করা খেলাপি ১ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা। এর বাইরে ৭ হাজার ৬৯৪ কোটি টাকা নিয়মিত দেখানো হলেও এর বিপরীতে কোনো আয় নেই। সব মিলিয়ে আয় আসছে না ২২ হাজার ৮৮১ কোটি টাকা বা ৫৩ দশমিক ৭৩ শতাংশ ঋণের বিপরীতে।
ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, যেখানে একক পরিবার, ব্যক্তি বা মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ শেয়ার ধারণ করতে পারে। তবে এনবিএলে সিকদার পরিবারের শেয়ার রয়েছে ১৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ। সীমার অতিরিক্ত শেয়ার তিন মাসের মধ্যে বিক্রির নির্দেশনা দিয়ে গত ১৩ জুলাই ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে চিঠি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে তা না করায় আইনের ১৪ক(৫) ধারায় সরকারের অনুকূলে কেন অতিরিক্ত শেয়ার বাজেয়াপ্ত করা হবে না, তা ১৪ দিনের মধ্যে ব্যাখ্যা চেয়ে গত ২১ নভেম্বর চিঠি দেওয়া হয়েছে।