বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম কয়েক মাস ধরেই ঊর্ধ্বমুখী। প্রায় সাড়ে ১২ শতাংশ ছুঁয়েছে খাদ্য মূল্যস্ফীতি। বিশেষ করে ডিম, আলু ও পেঁয়াজের দাম সাম্প্রতিক সময়ে বেশ অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে দেখা গেছে। সংকট দেখিয়ে দাম বাড়ানো হয় ডিমের। এ পরিস্থিতিতে সরকার পণ্যটি আমদানির অনুমতি দেয়ার পর দাম কিছুটা স্থিতিশীল হয়। আমদানির অনুমতি দেয়ায় কমতে শুরু করেছে আলুর দামও। তবে ভারতে মূল্যবৃদ্ধি, রফতানির সর্বনিম্ন মূল্য নির্ধারণের কারণে পেঁয়াজ আমদানিতেও এখন ব্যয় বেড়ে গেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে নিত্যপণ্যটির দাম নিয়ন্ত্রণই এখন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন বাজারসংশ্লিষ্টরা।
রাজধানীর খুচরা বাজারে গত সোমবার আলুর কেজিপ্রতি দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৬৫-৭০ টাকায়। বাজার নিয়ন্ত্রণে ওইদিনই পণ্যটি আমদানির অনুমতি দেয় সরকার। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল প্রথম দিনে দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে সাতটি ট্রাকে ১৭৮ টন আলু দেশে এসেছে। এ খবরে দেশের বাজারে দাম কমতে শুরু করেছে। একদিনের ব্যবধানে কেজিপ্রতি কমেছে অন্তত ৫-১০ টাকা। বর্তমানে রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতি কেজি আলু ৫৫-৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে হিমাগার পর্যায়ে প্রতি কেজি আলু ২৬-২৭ টাকা দরে বিক্রি নিশ্চিতে কঠোর অবস্থান গ্রহণের কথা জানিয়েছে সরকার।
আমদানিকারকরা জানিয়েছেন, ভারত থেকে প্রতি কেজি আলু ১৩-১৫ রুপি দরে কেনা হচ্ছে। এর সঙ্গে পরিবহন খরচ ও শুল্কসহ প্রায় ২৬-২৭ টাকা পড়ছে আমদানি খরচ। তবে কাস্টমসে শুল্ক বাড়লে আরো ২-৩ টাকা যোগ হতে পারে বলে জানান তারা। হিলি স্থলবন্দরের আলু আমদানিকারক শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘এখন যে দাম তাতে আমরা ৩০ টাকায় প্রতি কেজি আলু বিক্রি করতে পারব। তবে কাস্টমসে শুল্ক বাড়লে কিছুটা দাম বাড়বে। ভারত থেকে আলু আমদানির ফলে এরই মধ্যে দাম কমে এসেছে। তাতে করে বাজার নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।’
এদিকে আমদানির খবরে হিলি স্থলবন্দরে একদিনের ব্যবধানে আলুর দাম ৬-৮ টাকা কমেছে। একদিন আগে যে কাটিনাল জাতের আলু ৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল সেটি কমে গতকাল ৪৪ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। এছাড়া গুটি আলু বিক্রি হচ্ছে ৫০-৫২ টাকা, যা ৫৫-৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছিল।
হিলি স্থলবন্দর উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রের উপসহকারী সংগনিরোধ কর্মকর্তা ইউসুফ আলী বলেন, ‘এ পর্যন্ত হিলি স্থলবন্দরের ৩০ আমদানিকারক ২৫ হাজার টন আলু আমদানির অনুমতি পেয়েছেন। এরই মধ্যে ভারত থেকে আলু আমদানি শুরু হয়েছে। আইপি দেখে মান যাচাইপূর্বক সার্টিফিকেট দিয়ে আলু ছাড় করা হবে।’
এদিকে দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম বাড়ছেই। বর্তমানে দেশী পেঁয়াজ প্রতি কেজি ১৪০ টাকা ও আমদানি হওয়া পেঁয়াজ ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আমদানিকারকরা বলছেন, ভারতের পেঁয়াজের দাম কয়েকদিন ধরে বেড়েছে। পাশাপাশি রফতানিতে সর্বনিম্ন মূল্য নির্ধারণ করেছে ভারত। ফলে ড্যামেজসহ সার্বিকভাবে পেঁয়াজ আমদানি করতে প্রতি কেজির খরচ হয় প্রায় ৮৫-৯০ টাকা।
হিলি স্থলবন্দর আমদানি-রফতানিকারক গ্রুপের সভাপতি হারুন উর রশীদ বলেন, ‘পেঁয়াজের আমদানি খরচ বেশি। ভয়ে ভয়ে আমদানিকারকরাও খুব বেশি আমদানি করছেন না। কারণ যদি লোকসানে পড়তে হয়। আমদানিকারকদের হাত থেকে গিয়ে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে পেঁয়াজের দাম বেড়ে যায়। এখন প্রায় ৮১ টাকা আমদানি খরচ হয়। এছাড়া ১০ শতাংশ পেঁয়াজ নষ্ট হয়। ফলে প্রতি কেজি পেঁয়াজে আমাদের খরচ গিয়ে পড়ে প্রায় ৯০ টাকা।’
দেশের বাজারে খুব সহসাই পেঁয়াজের দাম কমার সম্ভাবনা দেখছেন না কৃষি খাতসংশ্লিষ্টরাও। দেশে মূলত পেঁয়াজের আবাদ হয় শীতকালে। সে পেঁয়াজ মার্চে উত্তোলন করা হয়। আর গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের অল্প পরিমাণে চাষাবাদ হয়। এরই মধ্যে সেই পেঁয়াজের উত্তোলন শুরু হয়েছে। নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে তা বাজারে পাওয়া যাবে। তবে পরিমাণ কম হওয়ায় তা বাজারে খুব বেশি প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করছেন বাজারসংশ্লিষ্টরা।
কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে নতুন পেঁয়াজ আসবে। সে পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। মধ্যস্বত্বভোগীদের কারসাজি বন্ধ করা গেলে দাম কমানো যাবে। কিন্তু সে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ অল্প পরিমাণে উৎপাদন হয়। তা বাজারে তেমন প্রভাব ফেলবে না। তবে পচনশীল হওয়ায় আমদানির পেঁয়াজে ঝুঁকি রয়েছে। তাই বিক্রি কমে গেলে দাম কমে যেতে পারে।’
দেশে পেঁয়াজের চাহিদা প্রায় ৩০ লাখ টন। সর্বশেষ অর্থবছরে ৩৪ লাখ টনের বেশি পেঁয়াজ উৎপাদন হয়। তবে মাঠপর্যায় থেকে ভোক্তা পর্যন্ত যেতে এক-চতুর্থাংশ পেঁয়াজ নষ্ট হয় কিংবা শুকিয়ে কমে যায়। চলতি বছরের মার্চে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৩০-৩৫ টাকায় বিক্রি হয়। তবে গত এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকেই নিত্যপণ্যটির দাম বাড়তে শুরু করে। গত ৫ জুন থেকে এ পর্যন্ত মোট ৬ লাখ ১৫ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়েছে।
যদিও উৎপাদন মৌসুমে কৃষকের কাছ থেকে খুব অল্প দামেই পেঁয়াজ ও আলু কিনে নেন ব্যবসায়ীরা। চলতি বছর মৌসুমের শুরুতে অর্থাৎ মার্চে কৃষকরা প্রতি কেজি আলু বিক্রি করেন ১০-১২ টাকায়। কিন্তু জুলাই থেকে অস্থির হওয়া শুরু করে এ পণ্যের বাজার। বাজার মনিটরিংয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতি বছর আলুর দাম নিয়ে মূলত কারসাজি হয় হিমাগার পর্যায়ে। এতে ভূমিকা রাখেন ফড়িয়া, হিমাগার (কোল্ড স্টোরেজ) মালিক ও আড়তদাররা।
এ বছর ১ কোটি ৪ লাখ টনের বেশি আলু উৎপাদন হয়। দেশে আলুর চাহিদা রয়েছে ৭০-৭৫ লাখ টন। আর ২০-২৫ শতাংশ উৎপাদন পরবর্তী সময়ে নষ্ট হয়। সে হিসেবে মোট চাহিদা দাঁড়ায় প্রায় ৯০ লাখ টন। আবার কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে সার্বিক খরচ বিবেচনায় নিলে প্রতি কেজি আলু উৎপাদনে খরচ হয় সাড়ে ১১-১২ টাকা। আর হিমাগারে রাখতে প্রতি কেজি আলুর জন্য খরচ হয় ৫-৬ টাকা। উদ্বৃত্ত থাকলেও নিয়ন্ত্রণে নেই আলুর বাজার।
কৃষি সম্প্রসারণে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাজারে আলু ও পেঁয়াজ পর্যাপ্ত। মুনাফা রেখে বিক্রি করলেও এত দাম হয় না। অতিমুনাফার কারণেই মূলত বাজারে আলু ও পেঁয়াজের দাম বেশি। এখানে ব্যবসার নীতি-নৈতিকতা নষ্ট হয়েছে। সিন্ডিকেশন করে দাম বাড়ানো হয়েছে।’
এর আগে দেশের বাজারে ডিমের দাম অস্থিতিশীল হয়ে পড়লে গত ১৭ সেপ্টেম্বর ডিম আমদানির অনুমতি দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এরপর তিন দফায় ১৫টি প্রতিষ্ঠানকে এক কোটি করে ডিম আমদানির অনুমতি দেয়া হয়। তবে প্রায় দেড় মাস হয়ে গেলেও কোনো ডিম আমদানি করতে পারেননি ব্যবসায়ীরা। ডিম আমদানিতে ৩৩ শতাংশ শুল্কারোপের কারণে আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় লোকসানের শঙ্কায় ব্যবসায়ীরা ডিম আমদানি করছেন না। তবে আমদানির খবরে কিছুটা স্থিতিশীল হয়েছে ডিমের বাজার। বর্তমানে এক হালি ডিম ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বনিক বার্তা