এম এম মাসুদ, মানব জমিন ।। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা ভালো নেই। ডলার সংকটে আমদানি এখন নিয়ন্ত্রিত। রেমিট্যান্স প্রবাহ ও রপ্তানি আয়ে ধীরগতি। খেলাপি ঋণের ভারে বিশৃঙ্খল আর্থিক খাত। পুঁজিবাজারেও চলছে মন্দাভাব। বিনিয়োগে স্থবিরতা। অন্যদিকে দীর্ঘদিন ধরে চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেশের নির্দিষ্ট, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের জীবনযাপনকে ব্যয়বহুল করে তুলেছে। মূল্যস্ফীতির ক্রমবর্ধমান চাপে দিশাহারা সাধারণ মানুষ। ক্রমবর্ধমানভাবে এই চাপ অব্যাহত আছে। এতে সাধারণ মানুষ জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন।
সব মিলিয়ে কঠিন সময় পার করছে দেশের অর্থনীতি। এমন প্রেক্ষাপটে বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, চলতি অর্থবছর (২০২৩-২৪) বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৫.৬ শতাংশ।
বিশ্লেষকরা জানান, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক বাণিজ্যের চাপ, আর্থিক খাতের ঝুঁকি, দুর্বল মুদ্রানীতি ও বিনিময় হার, খেলাপি ঋণ, সুদহারের সীমা, অত্যাবশ্যকীয় আমদানির ওপর শুল্ক আরোপ, দুর্বল রাজস্ব আদায় ব্যবস্থাপনার কারণে চ্যালেঞ্জের মুখে দেশের অর্থনীতি। তাই দেশের অর্থনীতির ধারা বজায় রাখতে আর্থিক খাতসহ বিভিন্ন খাতে সংস্কারের পরামর্শ দিয়েছেন তারা। উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ।
রিজার্ভ কমছে: বাংলাদেশে সফরত আইএমএফ মিশন ৩০শে জুন পর্যন্ত নির্ধারিত ২৪.৪৬ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ মজুত রাখার ব্যর্থতার কারণও জানতে চেয়েছিল। আইএমএফ’র ঋণের দ্বিতীয় ধাপের অনুমোদন পেতে এটি একটি বাধ্যতামূলক শর্ত ছিল। জবাবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, প্রয়োজনীয় আমদানির পাশাপাশি বাধ্যবাধকতা মেনে ঋণের অর্থ পরিশোধ করায় রিজার্ভ কমেছে। তাই রিজার্ভ নিয়ে আইএমএফ’র শর্ত পূরণ এখন অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে। অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেছেন, নিট রিজার্ভ ১৮ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি থাকতে পারে।
দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, রিজার্ভ এখন কমে হয়েছে ২ হাজার ৬৮৬ কোটি (২৬.৮৬ বিলিয়ন) ডলার। অবশ্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবপদ্ধতি বিপিএম ৬ অনুযায়ী, রিজার্ভ বর্তমানে ২ হাজার ১০৫ কোটি (২১ বিলিয়ন) ডলার। এর বাইরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিট বা প্রকৃত রিজার্ভের আরেকটি হিসাব রয়েছে, যা শুধু আইএমএফকে দেয়া হয়। প্রকাশ করা হয় না।
অর্থনীতিবিদরাও দেশের রিজার্ভ পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানাচ্ছেন। গত বুধবার এক অনুষ্ঠানে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেছেন, দেশে যে পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা ঢুকছে এবং যা বেরিয়ে যাচ্ছে, তার প্রকৃত হিসাব মিলছে না। এখন যে রিজার্ভ আছে, তা বিপজ্জনক পর্যায়ে না গেলেও উদ্বেগজনক পর্যায়ে। প্রতি মাসে ১ বিলিয়ন ডলার কমছে। এই অবস্থায় চললে একসময় ফুরিয়ে যাবে। তখন ডলারের দাম বাজারে ছেড়ে দিয়ে বা অন্য কোনো উপায়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার কোনো উপায় থাকবে না।
খেলাপি ঋণ বাড়ছে: খেলাপি ঋণের পরিমাণ দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। আইএমএফ বাংলাদেশের খেলাপি ঋণের উচ্চহার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। জুন শেষে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ রেকর্ড ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা এই খাতের মোট ঋণের ১০.১১ শতাংশ। অথচ ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করেছিল তখন দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা।
রাজস্ব আদায়: ২০২২-২৩ অর্থবছরে ন্যূনতম ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা কর আদায়ে সরকারের ব্যর্থতার বিষয়েও জানতে চেয়েছে আইএমএফ। এটি দ্বিতীয় কিস্তির ঋণ অনুমোদনে ২০২৩ সালের প্রথমার্ধের জন্য নির্ধারিত ছয়টি শর্তের একটি। এনবিআরের সাময়িক হিসাবে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম দুই মাস জুলাই-আগস্টে ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আদায় ঘাটতি হয়েছে। জুলাই-আগস্ট মাসে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৪৬ হাজার ২৩৩ কোটি টাকা। এই সময়ে আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৫০ হাজার ৩২১ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে এনবিআরের জন্য সব মিলিয়ে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার শুল্ক-কর আদায়ের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে।
ডলার সংকট: দেশে ডলারের তীব্র সংকট সৃষ্টি হয়েছে। লাগামহীনভাবে বাড়ছে বৈদেশিক এ মুদ্রার দাম। নানা পদক্ষেপ নিয়েও দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে খোলাবাজারে ডলারের দাম গিয়ে ঠেকেছে ১২০ টাকায়। বৃহস্পতিবার কার্ব মার্কেট বা খোলাবাজারে নগদ এক ডলার কিনতে গ্রাহকদের গুনতে হচ্ছে ১১৯ থেকে ১২০ টাকা। যেখানে গত সপ্তাহে এক ডলার ছিল ১১৭-১১৮ টাকা। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত দাম অনুযায়ী খুচরা ডলারের দাম ১১৩ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। মানি চেঞ্জার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের মহাসচিব শেখ হেলাল সিকদার বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক মানি চেঞ্জারগুলোর ডলারের দাম বেঁধে দিয়েছে। এক্ষেত্রে কেনার রেট ১১১ টাকা ৮০ পয়সা এবং বিক্রির রেট ১১৩ টাকা ৩০ পয়সা। এ দামে কেউ ডলার পাচ্ছে না।
রেমিট্যান্স প্রবাহ: কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, সদ্যসমাপ্ত সেপ্টেম্বর মাসে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্সে বড় ধরনের ধস নেমেছে। এ মাসে বৈধ পথে ও ব্যাংকের মাধ্যমে মাত্র ১৩৪ কোটি ডলারের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। দেশের প্রবাসী আয়ের এ অঙ্ক গত ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে এর চেয়ে কম রেমিট্যান্স এসেছিল ১০৯ কোটি ডলার, যা বৈদেশিক মুদ্রা কমতে থাকা রিজার্ভের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বল ভূমিকা, ত্রুটিপূর্ণ বাজার ব্যবস্থাপনা এবং বাজারে মূল্য কারসাজির প্রবণতা অর্থাৎ নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর তদারকিতে ব্যর্থতার কারণেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের সর্বশেষ তথ্য খুবই উদ্বেগজনক। রপ্তানি ও রেমিট্যান্স অর্থনীতির দুটি প্রধান স্তম্ভ।
রপ্তানি কমছে: আগের মাসের চেয়ে সেপ্টেম্বরে রপ্তানি কম হয়েছে ৪৭ কোটি ডলার বা প্রায় ৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বরে পণ্য রপ্তানি থেকে এসেছে ৪৩১ কোটি ডলার। আগস্টে এর পরিমাণ ছিল ৪৭৮ কোটি ডলার।
এফডিআই কমেছে: বিদেশি মুদ্রার অন্যতম একটি উৎস বিদেশি উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ বা এফডিআই। গত জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে এফডিআই কমেছে ২৯.৪৯ শতাংশ। মোট ৬২ কোটি ৬৪ লাখ ডলারের এফডিআই এসেছে এ সময়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এফডিআইয়ের সার্বিক পরিস্থিতির সর্বশেষ প্রতিবেদনে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি: দীর্ঘদিন ধরে চলমান মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও কমেছে। ফলে তারা ব্যয় কমাতে বাধ্য হচ্ছেন, এমনকি দৈনন্দিন বাজারের জন্য নির্ধারিত বাজেট কমিয়েছেন। শুধু তাই নয় অনেকেই তাদের দীর্ঘদিনের সঞ্চয় ভাঙাতে বাধ্য হয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি দীর্ঘায়িত হওয়ায় মানুষ নিজেদের অবস্থান থেকে নিজের মতো করে সমন্বয় করে চলার চেষ্টা করছেন। যাদের সুযোগ আছে তারা অতিরিক্ত খরচ মেটাতে অতিরিক্ত কাজ করছেন। কিন্তু যাদের কাজ করার সুযোগ নেই, তারা খাদ্য ও অন্যান্য জিনিসের ব্যবহার কমিয়ে দিচ্ছেন। অর্থনৈতিক ও সামাজিক উভয়দিক থেকেই নির্দিষ্ট আয়ের মানুষগুলো চাপের মধ্যে আছে।
সিন্ডিকেট মানুষের টাকা শুষে নিচ্ছে, কিছুই করতে পারছি না: কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, কীভাবে সিন্ডিকেট করে কোল্ড স্টোরেজগুলো সাধারণ মানুষের টাকা শুষে নিচ্ছে। আমরা অসহায়, কিছুই করতে পারছি না। কী একটা অসহায় অবস্থা। আমরা বেশি চাপ দিলে তারা বাজার থেকে আলু তুলে নিয়ে যায়। এ সিন্ডিকেটের কারণে আমাদের মাঝেমধ্যে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। বৃহস্পতিবার ফরিদপুর সদর উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে এক কর্মশালায় মন্ত্রী এসব কথা বলেন।
কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) মতে, নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা খুব কষ্টে আছেন। আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে পারছেন না তারা। সরকার বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে বেঁধে রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলতি বছরের বাজেট ঘোষণা করলেও তা বাস্তবায়ন করা যায়নি। তবে গত আগস্টে খাদ্য মূল্যস্ফীতি উঠেছে ১২. ৫৪ শতাংশে; যা ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।