Minar Rashid
আমাদের এক সিনিয়র ভাই। যুক্তরাজ্যে পড়াশোনা করার সময় তার বাবার বাল্যবন্ধুর বাসায় বেড়াতে গিয়েছেন। সেই বেডানোটি বাহ্যত বাবা-মায়ের বিশেষ আগ্রহের কারণে। কারণ সেই চাচার একটি অবিবাহিত মেয়ে ছিল। যাকে বলে লন্ডনি মাইয়া। ফলে বাবা-মায়ের কিছু মতলব থাকতেই পারে। নিজের ভেতর থেকেও একেবারে কোনো তাগিদ ছিল না, সেটাও হলফ করে বলা যাবে না।
ভদ্রলোক অনেক আগেই বিলাতবাসী হয়েছেন। ছেলেমেয়ের জন্মও এখানে। সামান্য জোরাজুরি করাতেই বড় ভাইটি রাতে সেই চাচার বাসায় থেকে যান।
বেশ রাত করে ভদ্রলোকের মেয়েটি বাসায় ফিরেছে। তবে একা নয়। সঙ্গে এক সাদা নাগর। দেশী ভাষায় বলে ‘লাং’। নতুন আগন্তুককে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বাবাকে একটু ‘হাই’ বলে দুজনেই সোজা বেডরুমে চলে যায়। একটু পরেই দরজার ছিটকানি লাগানোর আওয়াজ পাওয়া যায়।
আমার সেই বড় ভাইটির কাছে জীবনের সবচেয়ে বাজে আওয়াজ। মেয়েটির বাবার কানেও তেমন করে বাজার কথা ছিল। কিন্তু এদের কিছু সেন্সর নষ্ট হয়ে পড়েছে বলে তেমন করে বাজে না।
বিষয়টি এই বাসার জন্য খুবই স্বাভাবিক হলেও নতুন আগন্তুকের কারণে একটু অস্বাভাবিক ঠেকেছে। কিছুটা লজ্জিত ভঙ্গিতে সেই চাচা বললেন, কী করব বাবা, এই হলো আমাদের এখানকার পরিস্থিতি !
সিনিয়র ভাইটির মুখে এই গল্প শুনে তার অপর এক বন্ধু টিপ্পনি কাটে, আরে ব্যাটা! সেই দিন তোদের চাচা-ভাতিজার ইজ্জত বেঁচেছে! ভাগ্যিস তোর চাচি অন্য আরেক সাদা বান্দরকে নিয়ে চাচা-ভাতিজার চোখের সামনে দিয়ে অন্য রুমে ঢুকে দরজা আটকে দেয়নি। একসময় এদেরকেই বলা হতো ‘ড্যাম কেয়ার ফ্যামিলি’।
নবজাতককে দেখতে হাসপাতালে গেলে এ দেশের এক স্ত্রী তার স্বামীকে নাকি বলেছেন, ‘ডিয়ার, তুমি এই সন্তানের বাবা নও- সন্তানের বাবা অমুক।’
এখন পুরো রাষ্ট্রটিই একই কিছিমের ‘ড্যাম কেয়ার রাষ্ট্র’ হয়ে পড়েছে। এখন এই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইনি কর্মকর্তা বা অ্যাটর্নি জেনারেল বলবেন, এটা সেই স্ত্রীর অফিসিয়াল কথা নয়, তার ব্যক্তিগত কথা। কারণ অফিসিয়ালি এটি তিনি তার স্বামীকে বলতে পারেন না। কাজেই স্ত্রীর এই স্বীকারোক্তির পরেও তাদের দাম্পত্য জীবনের ফসল এই সন্তান বৈধ। কারণ এটি বাংলাদেশ। এখানে বটম লাইনে বা শেষ লাইনে যা বলা হবে, সেটাই ঠিক।
প্রধান বিচারপতি হলেন একটি দেশের সর্বোচ্চ আইনি ব্যাখ্যাদাতা। বর্তমান প্রধান বিচারপতি অবসরের পর বিচারপতিদের রায় লেখাকে অসাংবিধানিক বলে উল্লেখ করেছেন। তার এই ব্যাখ্যার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলসংক্রান্ত রায়টিকে আর বৈধ বলার সুযোগ থাকে না। কিন্তু ড্যাম কেয়ার ফ্যামিলির মতো রাষ্ট্রটিও আজ ড্যাম কেয়ার হয়ে পড়েছে। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন, এটা প্রধান বিচারপতির অফিসিয়াল কথা নয়, এটি তার ব্যক্তিগত কথা। কাজেই অনেক কিছুই অবৈধ হয়ে পড়লেও এখানে কোনো কিছুই অবৈধ নয়।
সত্তর লাখ টাকা নিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়লেও রেলের কালো বিড়ালদের কিচ্ছু হয় না। বরং গলার আওয়াজ আগের চেয়ে অনেক বেড়ে যায়। নিজে কালো বিড়াল হয়েও দেশের প্রধান বিচারপতিকে মুখ সংযত করার নির্দেশ দেয়া যায়।
বিসিএস পরীক্ষায় কী ধরনের কুকর্ম করে লীগের ছেলেদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে, তা নিজের মুখে প্রকাশ্যে বলে ফেললেও এইচ টি ইমামদের কিচ্ছু হয় না। পদ্মা সেতুতে মহাঘাপলা করলেও কারো টিকিটিও ধরা যায়নি। আমরা সব ভুলে গেছি। অথচ অতিরিক্ত পয়সাটি যাবে জনগণের পকেট থেকেই। মাঝখান থেকে আবুলরা আরো বড় দেশপ্রেমিক হিসেবে সার্টিফিকেট পেয়েছেন। এখানে জাতি অর্থ ও সম্মান কতটুকু খুইয়েছে তার কোনো হদিস নেই। ভাবসাবে মনে হয় কিচ্ছু হয়নি।
নেপোলিয়ন যথার্থই বলেছেন, অসৎ লোকের কর্মকাণ্ডে সমাজ ধ্বংস হয় না। সমাজ ধ্বংস হয় ভালো লোকের নিষ্ক্রিয়তায়। আমাদের ক্ষেত্রেও হুবহু তাই হয়েছে।
হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করলেও শেয়ারবাজারের দরবেশ বাবাজিদের প্রতি রাষ্ট্র ড্যাম কেয়ার। কুইক রেন্টাল- হু কেয়ারস? রুনি সাগর- হু ডেয়ারস (টু টক)। হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে, ব্যাংক খালি হয়ে যাচ্ছে- হু বদারস।
মোদ্দা কথা, সাত খুন করেও এই রাষ্ট্রে আরামদায়ক এসির বাতাস খাওয়া যায়।
গণতন্ত্র ধ্বংস হচ্ছে, জবাবদিহিতার সব প্রতিষ্ঠান মুখথুবড়ে পড়ছে, প্রতিবাদ না করে মিডিয়াগুলো দালালি শুরু করছে- দেখার কেউ নেই। ইয়াবা কেইসের ভয় দেখিয়ে পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় পডুয়া মেয়ের ইজ্জত লুটতে চাচ্ছে- বলার কেউ নেই। কারণ এই পুলিশকে দিয়েই সরকার সব কুকাম করাচ্ছে। সরকারের নফসের সেবায় নিয়োজিত পুলিশ নিজের নফসের একটু দেখভাল তো করবেই।
২.
প্রথম শ্রেণীর এক দৈনিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রফেসর মঈনুল ইসলাম ‘বিচারপতির ওপর বিএনপির অহেতুক আক্রমণ’ শিরোনামে একটি কলাম লিখেছেন। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়টি নিয়ে লিখেছেন দেখে একটু আগ্রহভরেই কলামটি পড়েছি।
লেখক ভদ্রলোক আইনের প্রফেসর নন। তিনি হলেন অর্থনীতির প্রফেসর। তবে এই মানের একজন প্রাজ্ঞ ব্যক্তি সমাজের যেকোনো বিষয় নিয়েই লিখতে পারেন। কোনো কোনো পাঠক অতি বিনয়ের সাথেই তাকে তার নিজ পরিধির মধ্যে থাকতেই পরামর্শ দিয়েছেন। পুরো রচনাটি পড়ার পর এ ধরনের পরামর্শ খুব অমূলক বা অহেতুক বলে মনে হয়নি।
এ দেশে অনেক কলামিস্ট আছেন, যাদের কলামের চেয়ে নিচে অন লাইন পাঠকদের মন্তব্য বেশি আকর্ষণীয় হয়ে পড়ে। এই লেখাটির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।
সিলেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য একজন প্রফেসর কথার শুরুতেই বলে নেন, রাজনীতি আমি বুঝি না। অথচ দেশের মানুষ তাকে সবচেয়ে চতুর পলিটিশিয়ান বলে জ্ঞান করেন। একই মতলবে অন্যরা বলেন, আমি কোনো পক্ষকে সমর্থন করে লিখছি না।
অথচ মানুষমাত্রই রাজনৈতিক জীব। সে হিসাবে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি সমাজের সবচেয়ে সচেতন অংশের এ ধরনের সমর্থন থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়, অন্যায় কিছু নয়। কিন্তু এই কথাটি স্বীকার করার মতো সৎ সাহসটি এই জ্ঞানীগুণীদের অনেকের নেই। এরা কখনোই কোনো রাজনৈতিক দলের কোনো দায় নিতে চায় না। কিন্তু ফায়দাটি ষোলো আনা নিতে চায়।
যা হোক, তার সেই লেখাটিতে ফিরে আসি। বিচারপতির প্রতি বিএনপির আক্রমণ নিয়ে কথা শুরু করলেও লেখাটির ছত্রে ছত্রে বিএনপির প্রতি লেখকের আক্রমণ স্পষ্ট হয়েছে। সেই আক্রমণে সাপোর্টিং ডকুমেন্টের চেয়ে প্রিয় দলটির মনের মাধুরীই বেশি ফুটে উঠেছে।
সেই লেখার এক জায়গায় লিখেছেন, প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের ব্যাপারে আমি পক্ষে-বিপক্ষে কিছু বলতে চাই না। তবে সংক্ষিপ্ত রায় যেহেতু শপথের অধীনে থাকাকালীনই দেয়া হয়েছে, অতএব পরে এর পূর্ণাঙ্গ লিখিত ব্যাখ্যাসংবলিত রায়ে ওই সংক্ষিপ্ত রায়ের কোনো ব্যত্যয় না করা হলে সেটা অসাংবিধানিক কেন হবে, সেটা বোঝা যাচ্ছে না।
তার এই যুক্তিটি অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। এখন রায়টিকে আরেকবার তলিয়ে দেখা যায়।
আমরা সবাই জানি, বিচারপতি খায়রুল হক তার সংক্ষিপ্ত রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতিকে আরো দুই মেয়াদে অব্যাহত রাখার কথাটি উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু অবসরের পর যে পূর্ণাঙ্গ রায়টি লেখা হয়েছে, তাতে এই দুই মেয়াদ অব্যাহত রাখার কথাটি উঠিয়ে দেয়া হয়। কাজেই সংক্ষিপ্ত রায় ও পূর্ণাঙ্গ রায়ের মধ্যে স্পষ্টতই ব্যত্যয় ঘটেছে, আকাশ পাতাল পার্থক্য সৃষ্টি হয়ে পড়েছে। সংক্ষিপ্ত রায় বহাল থাকলে আরো দুই মেয়াদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হতো। পূর্ণাঙ্গ রায়ের কারণে তা হয়নি।
আদালতের এই কাঁধটিতে বন্দুক রেখেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করা হয়। যদিও ড্যাম কেয়ার রাষ্ট্রে বৈধতা অবৈধতার মধ্যে সব ফারাক মুছে গেছে।
Well written. Keep it up