বোঝার ভুলে ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ: অধ্যাপক ইমতিয়াজ
এই অধ্যাপকের বিরুদ্ধে ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের।
অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ।
ফাইল ছবি
bdnews24.com 5 april 2023
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের ‘ইতিহাস বিকৃতির’ যে অভিযোগ উঠেছে, সেই বিষয়ে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এই শিক্ষক।
রোববার রাতে এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, “যে বইটি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে সংঘটিত জেনোসাইডের বিচার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জেনোসাইড স্টাডিজ সেন্টার প্রতিষ্ঠার আবেদন জানিয়ে রচিত, তাতে ১৯৭১ সালের জেনোসাইডকেই অস্বীকার কিংবা এর গুরুত্ব কমিয়ে দেখানো কীভাবে সম্ভব?
“প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের অভিযোগ ওঠায় আমি আশ্চর্য হয়েছি। আমি মনে করি, কোথাও বইয়ের কোনো কোনো অংশ বুঝতে ভুল হয়েছে কিংবা ভুল ব্যাখ্যা হয়েছে।”
অধ্যাপক ইমতিয়াজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অপসারণ এবং একটি উচ্চ ক্ষমতার তদন্ত কমিটি গঠন করে তার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের দাবিতে রোববার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নামে একটি সংগঠন।
ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, “এটাও মনে রাখা দরকার যে এখন থেকে ১৪ বছর আগে জোনোসাইডের জন্য দায়ীদের বিচারের দাবি নিয়ে গবেষণালব্ধ তথ্য-পরিসংখ্যান ব্যবহার করে খুব বেশি লেখালেখি হত না। যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ গণহত্যার এপিসেন্টার হিসেবে পরিচিত, সেখানেও এ ধরনের গবেষণার আনুষ্ঠানিক আয়োজন ছিল না। আমার গ্রন্থ এবং অন্যান্য লেখালেখিতে জেনোসাইড-১৯৭১ নিয়ে ধারাবাহিক ও নিবিড় গবেষণার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়।”
সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে মতামত বিভাগে একটি কলাম লেখেন। ওই লেখায় তিনি সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক ইমতিয়াজের লেখা ‘হিস্টোরাইজিং ১৯৭১ জেনোসাইড: স্টেট ভার্সেস পারসন’ (২০০৯) বইয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অবমাননা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ তোলেন।
মানববন্ধনে বিষয়টি তুলে ধরে শামসুদ্দিন চৌধুরী বলেন, বইটির ৪০ পৃষ্ঠায় তিনি (অধ্যাপক ইমতিয়াজ) লিখেছেন- ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিজে হাজির হয়ে বঙ্গবন্ধুকে বক্তব্যের শেষে ‘জয় বাংলা’ বলার পর ‘জয় পাকিস্তান’ বলতে শুনেছেন।
“বইটিতে এমন কথাও লিখেছেন, যার অর্থ দাঁড়ায় এই যে, ১৯৭১-এ বাংলাদেশে যা ঘটেছে তা ১৯৪৮ সালের জেনোসাইড কনভেনশনের আওতায় পড়ে না।”
এ বিষয়ে বিবৃতিতে অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেছেন, “বইয়ের কোথাও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি অসম্মান বা অশ্রদ্ধা প্রদর্শন হতে পারে- এমন একটি শব্দও নেই। এমনটি হতে পারে যে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বিষয়ে আমার একটি মন্তব্যের সুযোগ নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা হয়েছে।
“তারা হয়ত আমার বক্তব্যের সারবস্তু উপলব্ধি করার চেষ্টা করেননি। বঙ্গবন্ধু তার ভাষণ কীভাবে শেষ করেছিলেন, সে বিষয়ে একটি বিতর্ক সে সময় চলছিল। আমি বলেছি- তিনি যেভাবেই শেষ করেছেন তা ছিল একজন বিচক্ষণ রাজনীতিকের ‘master stroke of a political genius’. আমি এটাও লিখেছি যে ৭ মার্চ স্বাধীনতার আহ্বান জানানো হয়েছিল এবং ২৬ মার্চ হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস। মুজিব নগর সরকার যথার্থভাবেই এ ঘোষণা দিয়েছিল।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এ শিক্ষক বলেন, “২০০৬ সালের ৭ মার্চ এক আলোচনা সভায় (যেখানে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা, সে সময়ে জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন) আমাকে বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। ১৪ বছর পর এখন আমার লেখাকে কেন্দ্র করে কেউ কেউ ভুল বুঝতে পারে।
“এটাও লক্ষণীয় যে বর্তমান সরকারবিরোধী একটি মহলও বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে বিতর্কিত করার অপপ্রয়াস ক্রমাগতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে ‘master stroke of a political genius’- আমার এ বক্তব্য গুলিয়ে ফেলা হবে, এটা ভাবতে পারিনি।”
এ অধ্যাপক মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি ‘চরম অবমাননা করে’ শহীদদের সংখ্যা নিয়ে বইটিতে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন বলে মানবন্ধনে অভিযোগ করেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী।
“এটা গবেষক ও সংশ্লিষ্টদের জানা যে, আমি বারবার বলেছি- ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ৩০ লাখ লোককে হত্যা করেছে বলে যে তথ্য রয়েছে, যা এমনকি আরও বেশি হতে পারে যদি আমরা শরণার্থী শিবিরে মৃত্যু ও গর্ভপাত বিবেচনায় নিই। স্বাধীনতা সংগ্রামের ৯ মাসে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যারা প্রাণের ভয়ে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে পালিয়ে থেকেছেন, তখনও অনেক নারীর গর্ভের সন্তান নষ্ট হয়েছে। এ বিষয়টিও আমাদের বিবেচনায় রাখা উচিত হবে।”
বইটি পাকিস্তান নিষিদ্ধ করতে চেয়েছিল এবং এর লেখক হিসেবে তাকে ২০১৪ সালে করাচি ইউনিভার্সিটিতে এক অনুষ্ঠানে যেতে বাধা দেওয়ার কথাও বিবৃতিতে উল্লেখ করেন অধ্যাপক ইমতিয়াজ।
তিনি বলেন, গত ১৪ বছর যাবত আমি জোনোসাইড বিষয়ে অনেক বই ও লেখা প্রকাশ করেছি ….তদুপরি আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ওয়াকিং মিউজিয়াম কর্মসূচির প্রধান উদ্যোক্তা। এ কর্মসূচির লক্ষ্যই হচ্ছে বিশ্বকে বাংলাদেশে জেনোইডের বিষয়ে অবহিত ও সচেতন করা, যাতে বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হয়।
“বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পাদিত গ্রন্থে আমার ‘Bangabandhu & World Peace’ শিরোনামে একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে। আমার পক্ষে কীভাবে বঙ্গবন্ধুর অসম্মান করা সম্ভব হতে পারে?”
এই বিবৃতির মধ্য দিয়ে ‘জেনোসাইড’ বিষয়ে তার সেই গ্রন্থ নিয়ে সৃষ্ট ‘ভুল বোঝাবুঝি’র অবসান ঘটবে বলে আশা করছেন এই অধ্যাপক।