প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন ভারতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে লস অ্যাঞ্জেলেসের সাবেক মেয়র এরিক গারসেটিকে নতুন করে মনোনয়ন দিয়েছে। সাম্প্রতিক এই ঘোষণা দুই দেশের সম্পর্কের বিদ্যমান অদ্ভুত অবস্থাকে তুলে ধরেছে।
বাইডেন দুই বছর আগে যখন দায়িত্ব নেন, এর পর থেকে নয়াদিল্লিতে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো রাষ্ট্রদূত নেই এবং এ অবস্থা চলছে এমন একটি সময়ে, যখন ভারতীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের সম্ভাব্য পাল্টা শক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। এ অঞ্চলে ক্ষমতার ভারসাম্য ধরে রাখার ক্ষেত্রে কোয়াডের সহযোগী দেশ অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের ভূমিকা অপরিহার্য।
কৌশলগত দিক থেকে ভারতের এত গুরুত্ব থাকার পরও হোয়াইট হাউস কেন দিল্লিতে তাদের রাষ্ট্রদূতের পদটি দুই বছর ধরে খালি রেখেছিল?
২০২১ সালের জুলাইয়ে, অর্থাৎ নতুন প্রশাসন দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক মাস পরই গারসেটিকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। সে সময় সিনেটে তাঁর মনোনয়নের বিষয়টি পাস হয়নি। ওই সময় তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, মেয়র হিসেবে তিনি তাঁর একজন সহযোগীর বিরুদ্ধে ওঠা যৌন হয়রানির অভিযোগ এড়িয়ে গিয়েছিলেন।
গারসেটি তাঁর সহযোগীর অসদাচরণ সম্পর্কে জানতেন এবং সেই সহযোগীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন—এমন অভিযোগ সামনে আসার পর গারসেটির নিজের দল ডেমোক্রেটিক পার্টির সদস্যরাও বিরোধী রিপাবলিকান পার্টির সদস্যদের সঙ্গে তাঁর নিয়োগে ভোট দিতে অস্বীকার করেন। তাঁর মনোনয়ন ঘোষণার ৯ মাস পরে গত এপ্রিলে সিনেটের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা চাক শুমার রাষ্ট্রদূতের অবস্থানের একটি দোদুল্যমান অবস্থায় থাকার কথা স্বীকার করে বলেছিলেন, গারসেটির নিয়োগ সিনেটে অনুমোদন করানোর মতো ভোট তাঁর কাছে না–ও থাকতে পারে। এতে ভারতীয় কর্মকর্তারা প্রথমে অপ্রস্তুত ও পরে বিরক্ত হয়ে ওঠেন।
এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম বাজার হলো ভারত। কিন্তু গারসেটির নিয়োগ নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হওয়াটা এই পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট সম্পর্ককে ক্ষুণ্ন করেছে। তাঁর নিয়োগ নিশ্চিতকরণের বিষয়টি এক পাশে সরিয়ে রাখলেও এটি বোঝা যাচ্ছে, নয়াদিল্লিতে গোরসেটিকে যে পদে নিয়োগ করার জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে, তা ভারতের জন্য অনেক ভালো হবে। কারণ, বাইডেনের সঙ্গে তাঁর সরাসরি যোগাযোগ আছে।
২০ মাস ধরে বেশ কয়েকজন আমেরিকান দূত নয়াদিল্লি দূতাবাসে চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স হিসেবে কাজ করেছেন। তাদের নিজেদের সাফল্যের জন্য যে বিষয়টি অত্যাবশ্যকীয় ছিল, তা হলো স্থানীয় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করা এবং স্থানীয় পরিবেশ বুঝে ওঠা। কিন্তু তাঁদের সবাইকেই স্থানীয় পরিবেশ বুঝে ওঠার আগেই দিল্লি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং আগেরজনের জায়গায় নতুন কাউকে চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে। সম্প্রতি এই পদের জন্য ঝানু কূটনীতিক এলিজাবেথ জোনসের নাম চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। তবে তাঁর নিয়োগও অস্থায়ী এবং পূর্ণকালীন রাষ্ট্রদূতের নিয়োগ নিশ্চিত হওয়ার পর তাঁর পদত্যাগ করার কথা।
দিল্লিতে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের অনুপস্থিতি ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করার বিষয়ে আমেরিকার দেওয়া প্রতিশ্রুতির বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছে। বাইডেন মার্কিন-ভারত অংশীদারিকে ‘আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কগুলোর একটি’ বলে অভিহিত করেছেন এবং ভারতকে তিনি ‘অপরিহার্য’ অংশীদার হিসেবে স্বাগত জানিয়েছেন। কিন্তু সেই অংশীদারের জন্য একজন রাষ্ট্রদূতের নাম দিতে বাইডেন প্রশাসনের অক্ষমতা অনেক ভারতীয়কে এটি ভাবতে বাধ্য করছে যে যুক্তরাষ্ট্র দিল্লির মতো এত দিন ধরে লন্ডন বা প্যারিসে এই পদটি খালি রাখতে পারত কি না।
অথচ যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যকার কৌশলগত সম্পর্ক এর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আগে কখনোই ছিল না। চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পক্ষ নেওয়ায় ভারতকে কয়েক বছর ধরে বাড়তি চাপ সামলাতে হচ্ছে। এখন চাপ আরও বেড়েছে। বিশেষ করে হিমালয় এলাকায় ভারতীয় ভূখণ্ডে চীনের সাম্প্রতিক দখলদারি ভারতকে এখন চীনা সম্প্রসারণবাদকে চ্যালেঞ্জ করতে বাধ্য করেছে। চীন–সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ভারত সহযোগিতা চায়; একই সঙ্গে নিরাপত্তা, প্রযুক্তি এবং জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়েও সহযোগিতা চায়।
ভারতকেও যুক্তরাষ্ট্রের ভীষণ দরকার। কারণ, ভারত আমেরিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক অংশীদারও বটে। এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম বাজার হলো ভারত। কিন্তু গারসেটির নিয়োগ নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হওয়াটা এই পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট সম্পর্ককে ক্ষুণ্ন করেছে। তাঁর নিয়োগ নিশ্চিতকরণের বিষয়টি এক পাশে সরিয়ে রাখলেও এটি বোঝা যাচ্ছে, নয়াদিল্লিতে গোরসেটিকে যে পদে নিয়োগ করার জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে, তা ভারতের জন্য অনেক ভালো হবে। কারণ, বাইডেনের সঙ্গে তাঁর সরাসরি যোগাযোগ আছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ আছে, এমন একজন রাষ্ট্রদূত থাকা যেকোনো স্বাগতিক দেশের জন্য সুবিধাজনক। নয়াদিল্লিতে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসভবন ‘রুজভেল্ট হাউস’-এ অতীতে অর্থনীতিবিদ জন কেনেথ গালব্রেথের মতো মানুষ থেকেছেন।
কেনেথ চীন-ভারত লড়াইয়ের সময় মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আমলাতান্ত্রিক জটিলতাকে পাশ কাটিয়ে সরাসরি তাঁর বন্ধু প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির কাছে যেতেন। হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারাও এখন বলছেন, দিল্লি যদি ওয়াশিংটনের কাছে এতই গুরুত্বপূর্ণ, তাহলে কেন মার্কিন প্রশাসন তার মনোনীত প্রার্থীকে নিশ্চিত করার জন্য আরও জোরের সঙ্গে কাজ করেনি? এসব কারণে বাইডেন প্রশাসনের উচিত, নিয়োগের সব প্রক্রিয়া শেষ করে গারসেটিকে আর দেরি না করে দিল্লিগামী বিমানে তুলে দেওয়া।
ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
- শশী থারুর ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও জাতিসংঘের সাবেক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল। বর্তমানে তিনি ভারতের কংগ্রেস পার্টির একজন এমপি