বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁইজির ১৩০তম তিরোধান দিবস আজ
Farhad Mazhar    23 October 2022
যেহেতু ১ কার্তিকে ফকির লালন সাঁইজীর তিরোধান দিবস গেল তাই আরও কিছু কথা বলা জরুরি বোধ করছি।  যেন নদীয়ার ফকিরদের চর্চায় ইসলামের মহিমা ও তাৎপর্য কিভাবে ধরা পড়েছে সেটা আমরা সহজে বুঝতে পারি।
নৈতিক, অর্থনৈতিক এবং ভূ-রাজনৈতিক পালাবদলের দিক থেকে সারা দুনিয়া এক প্রবল ঝাঁকির মধ্যে রয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধ ইতোমধ্যেই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের রূপ নিচ্ছে।বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তন আসন্ন।এই সময় অন্য সকল সংগ্রামের চেয়েও নৈতিক, সাংস্কৃতিক বা সংক্ষেপে ভাবগত সংকট সমাধান ইতিহাসের দিক পরিবর্তনের প্রধান নির্ণায়ক হয়ে উঠবে বলে  আমি নিশ্চিত। সেই দিক থেকে ফকির লালন শাহ বা নদীয়ার ভাবান্দোলন স্রেফ কিছু বাউলের ডুগডুগি বাজানো আর মঞ্চে অশ্লীল ভাবে নেচেকুঁদে বেড়ানো না।এটা আদর্শিক, নৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিকভাবে আমাদের টিকে থাকা না থাকার প্রশ্নও বটে। তাই বাউলগিরি নাচুনু-কুঁদুনি বাদ দিয়ে লালন নিয়ে আমাদের আলাপ-আলোচনার স্তরকেও উন্নীত করা দরকার।
যাকে আমরা লালনের মাজার বলি তা আসলে মতিজান ও মওলানা মলম শাহের বাড়ি। রাষ্ট্র অন্যায় ভাবে জুলুম করে তা দখল করে নিয়েছে। লালনকে রাষ্ট্রীয়করণ বা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে। যা কার্যত ফকিরদের উৎখাত  ও লালনকে বিকৃত করবার রাজনৈতিক কৌশল।
অথচ মতিজান-মলম শাহের বাড়িটি  ফকিরদের সাধনার ক্ষেত্র, এখানেই লালন তাঁর জীবন কাটিয়েছেন। ফকিরদের ভাষায় এটাই ‘টাকশাল’ – অর্থাৎ ভাবচর্চার ভাষা ও ভাবের ব্যাকরণ উৎপাদনের প্রধান কারখানা। এখানে গাঁজা বা কোন প্রকার নেশাদ্রব্য ছিল না। কখনও ছিল না। থাকার প্রশ্নও ওঠে না।  অথচ প্রশাসনেরই ছত্রছায়ায় ছেঁউড়িয়া এখন গাঁজা ও নেশাদ্রব্যের বাজারে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রকে রাষ্ট্র, প্রশাসন ও দলীয় ক্ষমতাবাজী দূষিত করে চলেছে গত কয়েক যুগ ধরে। বাংলাদেশের আলেম-মওলানা হুজুর শ্রেণী সর্বগ্রাসী অবক্ষয়ের জন্য রাষ্ট্র বা প্রশাসনকে দায়ী না করে, লালনকে দায়ী করেন।
ফকির লালন কবর পূজায় বিশ্বাস করতেন না, তিনি জীবন্ত ‘মানুষ’ ভজনার কথা বলেছেন। অনুমান নয় বর্তমানেই তাঁর আস্থা। ফকিররা গুরুবাদী, তাই তাঁরা কোন মৃত জিনিস পূজা করেন না। তাঁরা নিজ নিজ গুরু ভজনা করেন, যে গুরু ‘বর্তমান’ থাকেন, কিম্বা যে গুরুর সঙ্গ তারা পেয়েছেন বা পাচ্ছেন। সে কারণে  নদীয়ায় গুরুশিষ্যপরম্পরা আছে, কিন্তু লালন পন্থা বা লালনপন্থী বলে কোন সুনির্দিষ্ট ধর্ম, আকিদা, পথ বা পন্থা নাই। কিন্তু আলেমদের একটা শ্রেণী ‘লালনবাদ’ নামে এক অদ্ভুত ‘বাদ’ আবিষ্কার করেছে। এইরকম কোন ভূতুড়ে ‘বাদ’ লালনে নাই।
এই ধারায় বরং সবাই প্রশ্ন করে, ‘আপনার গুরুপাট কই? কারন গুরুকে চিনলে আমরা বুঝি ইনি ভাবের কোন স্তরে আছেন। এতে কথোপকথনে সুবিধা। নদীয়ার ভাব যদি কারো ভাল লাগে তাহলে একজন যোগ্য গুরুর অধীনতা মানতে পারেন, কিম্বা নাও পারেন। নদীয়ার গুরু মানে গদিগিরি ব্যবসা, পীরমুর্শিদগিরি বা গুহ্য কোন ব্যাপার স্যাপার না। আপনি গুরুর ভাব ও ভাবচর্চার পথের পথিক, তাঁর প্রেম, ভালবাসা, সাহচর্যই লভ্য। কিছু নিয়মশৃংখলা ও সেবাবিধি আছে। ব্যস। কিন্তু এখন লালন মাজার হয়ে উঠেছে কবরপূজারি ও ‘মাজারি’-দের শক্তিশালী ক্ষেত্র। লালনের ভাব বা চিন্তাধারার সাথে যাদের কোন মিল নাই।
লালন মাজার বা মতিজান-মলম শাহের বাড়ি থাকা উচিত ছিল ফকিরদের হাতে। উলটা ফকিরদের কার্যত লালনের ধাম (বা মাজার) থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে। পাকিস্তান আমল থেকে রাষ্ট্রের বা প্রশাসনের উদ্যোগে ছেঁউড়িয়ার সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। লালন একাডেমির মূল দায়িত্বে আছেন জেলা প্রশাসক। তিনি স্থানীয় রাজনীতিবিদদের নিয়ে লালন একাডেমির কাজ পরিচলানা করেন এবং যে দল ক্ষমতায় থাকে সেই দলের স্থানীয় ক্ষমতাশালী নেতাদের নির্দেশের বাইরে তাঁর নিজের বিশেষ কিছু করবার ক্ষমতা নাই বললেই চলে। অথচ ছেঁউড়িয়াতে লালনের নামে যে সকল অপকর্ম ও কুকীর্তি হয় তার  জন্য আলেম_ওলেমাদের একটি শ্রেণী রাষ্ট্র, প্রশাসন বা রাজনোইতিক দলের দল্বাজিকে নয়, ফকির লালনকে দোষারোপ করেন।  দয়া করে ফকিরদের দোষারোপ করবেন না। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও ক্ষমতাসীনদের জিজ্ঞাসা করুন ছেঁউড়িয়ার এই দুর্দশা কেন?
তারপরও নদীয়ার ফকিরকুল বিনয়ের সঙ্গে সব সময়ই স্বীকার করেন লালনের চিন্তা বা নদীয়ার ভাব সম্পর্কে কারো বিশ্বাস কিম্বা আকিদার দিক থেকে আপত্তি থাকলে আলাপ হোক।  অবশ্যই।  লালন সৌদী আরব, ইরান, তুর্কিস্তান, কিম্বা আফগানিস্তানের কেউ নন। তিনি একদমই ষোল আনা বাঙালি এবং বাংলাভাষী। সুলতানি আমলের ইতিহাস আমাদের বিশেষ জানা নাই, যাদের শাসনামলে বাংলা ভাষার বিপুল বিকাশ ঘটেছিল। হোসেন শাহের আমলে শ্রীচৈতন্যের জাতপাত বিরোধী আন্দোলন এক নতুন যুগের সূচনা করে। এরপর নিত্যানন্দ, মাধব বিবি, বীরভদ্রের ধারাবাহিকতায় ফকির লালন শাহের আবির্ভাব ঘটেছে। সেটা দীর্ঘ ইতিহাস। লালনকে বুঝতে হলে সেই ইতিহাস জানতে হবে।
আর ঠিক এখানেই ফকির লালন শাহের অপরিসীম গুরুত্ব। তিনি একান্তই নদীয়ায় তৈরি জিনিস। যার কাছে চৈতন্য নদীয়ার প্রথম ফকির।  কিন্তু  চৈতন্য নদীয়ার ফকিরদের গুরু নন।  নদীয়ার ভাবের গুরু নিত্যানন্দ। কেন তিনি সেইসব বললেন এবং বৈষ্ণব আন্দোলন থেকে নিজেকে আলাদা গণ্য করলেন সেইসব নিয়ে আসুন আমরা আলোচনা করি। কিন্তু যেসকল গণ্ডমূর্খ আলেম বা হুজুররা ইউটিউবে বাউলেরা গাঁজা খায়, ‘প্রেম ভাজা’ করে, ঐটা করে সেটা করে – তারা রীতিমতো চরম সামাজিক নুইসেন্স। নুইসেন্স হিশাবে ডিজিটাল যুগে তারা হাসির খোরাক হয়েছে। থাকবে। বাউলদের সম্পর্কে দুই একটা থার্ডক্লাস বই পড়ে ইউটিউব ভিউ বাড়াবার জন্য কিছু আলেম এইসব বলে বেড়ায়। এরাই আবার একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে সারাক্ষণই তাকফির করে। এই রকম উপদ্রব সব দেশেই থাকে। এরা জানে না, লালন কখনই নিজেকে ‘বাউল’ বলেন নি। কিন্তু এর জন্য কাউকেই আমি পুরাপুরি দোষ দেই না। লালনকে ‘ফকির’ না বানিয়ে ‘বাউল’ বানাবার জন্য রাষ্ট্র, প্রশাসন ও লালন একাডেমি দায়ী। এরাই লালনকে বাউল হিশাবে প্রতিষ্ঠিত করতে বদ্ধ পরিকর। লালনকে এরাই খেয়ে না খেয়ে ‘বাউল সম্রাট’ বানিয়েছে।
এবার Munirul Islam Ibn Jakir-এর কথার সূত্র ধরে দুই একটি কথা বলব। তিনি বলেছেন, আমার “মসজিদে মাথা ঠেকাতে লজ্জা লাগে,কিন্তু মাথা তো ঠেকাতে হবে কোথাও না কোথাও”। তো আমি মাথা ঠেকিয়েছি লালনে।
মসজিদে মাথা ঠেকাতে হবে এই ঘোর পৌত্তলিক নির্দেশ আমি একজন তরুণ আলেমের কাছে শুনে হতভম্ব হয়ে রয়েছি। বাংলাদেশে ইসলাম সম্পর্কে ধারণা এতো নিম্ন স্তরে ঠেকেছে,  এটা বিশ্বাসই করা যায় না। মসজিদ বানানো আর সেখানে মাথা ঠেকানোই তাহলে ইসলাম? অথচ ইসলামে মসজিদ পূজা নাই। এবাদতের কথা আছে, সালাত কায়েম করবার কথা আছে, ওয়াক্তি সালাতেরও নির্দেশ দিয়েছেন রাসুলে করিম (সা), ইত্যাদি।  কিন্তু মসজিদে গিয়ে মাথা ঠেকাতে হবে – এই প্রকট কুফরি ইসলামের কোত্থাও নাই।
বুঝুন, এরা কি বলে আর তার মানে কি দাঁড়ায় সেটা তারা নিজেরাও জানে না। মাথা ঠেকালে সেটা শুধু মসজিদেই ঠেকাতে হবে?  তাঁর মানে কি আল্লাহ শুধু মসজিদে থাকেন ! তিনি কি তাহলে আর কোত্থাও নাই? ঘরে কি সালাত কায়েম হয় না?  লালন নিয়ে তর্ক তো কে কোথায় মাথা ঠেকাচ্ছে বা ঠেকাচ্ছে না সেই  তর্ক না। য়ারও বড় ও গভীর তর্ক। কিন্তু এই যে বালসুলভ বলদগিরি মেরে ভাবলাম  – দিলাম ফরহাদ মজহারকে একটা — অতঃপর পুলক বোধ করা – এদের সংখ্যাই বেশী দেখি।  ইসলাম মাথা ঠেকাঠেকির  ধর্ম না, যারা আল্লার আশেকান শরিয়ত হোক কিম্বা মারেফত হোক আল্লার নিকটবর্তী হওয়াই তাদের সাধনা।
যাঁরা লালনের ঘরের সাধক তাঁরা জানেন গুরু প্রথম যে শিক্ষাটা দিয়ে থাকেন সেটা হোল  মাথা কোত্থাও ঠেকানো যাবে না। এমন কি গুরুর পায়েও না। তাই ভক্তি দেবার সময় গুরুর চোখের দিকে তাকাতে হবে সরাসরি, যেন সেজদা ও ভক্তির পার্থক্য পরিষ্কার হয়। কিন্তু ভজনা করতে হবে ‘মানুষ’। যে ‘মানুষ’-কে সৃষ্টির পর পরপরই আল্লা ফেরেশতাদের ‘সেজদা’ দিতে বলেছিলেন।   দুনিয়ায় আর কোন ধর্ম মানুষকে এতো উচ্চ মহিমায় প্রতিষ্ঠিত করে নি। সেই জন্য নদীয়ার ফকিরদের কাছে ইসলাম অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এটা শুধু ধর্ম পালন, কিম্বা কোন বিশেষ সম্প্রদায়ের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলা ও সাম্প্রদায়িক হয়ে ওঠা নয়। মানুষ সম্পর্কে সার্বজনীন ও শাশ্বত জিজ্ঞাসা জারি রাখা। কি আছে ‘মানুষ’ নামক ব্যাপারটির মধ্যে যাকে সেজদা দেবার জন্য খোদ ফেরেশতাদের বাধ্য করা হয়েছিল!!  নদীয়ার ফকির এই গোড়ার জিজ্ঞাসা ভোলে না।
‘মানুষ’ ব্যাপারটা  শুধু ইসলাম নয়, সকল ধর্মতত্ত্ব, জ্ঞানতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব ও রাজনীতির গোড়ার জিজ্ঞাসা। এই বিশাল জিজ্ঞাসা ফেরেশতাদের আদমকে সেজদা দেবার নির্দেশের মধ্যে ব্যক্ত । যতক্ষণ আমরা এই নির্দেশের মানে না বুঝব এবং মানুষের সম্ভাবনা ও তাপর্য বোঝার চেষ্টা না করব  ততক্ষণ ইসলাম নিয়ে কোন কথা বলার অধিকার কি আমাদের থাকা উচিত? এইগুলো তো গোড়ার কথা।
নদীয়ার ‘মানুষ ভজনা’  ফেরেশতাদের মানুষ সেজদা দেবার নির্দেশের সঙ্গে যুক্ত। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আর কোত্থাও মাথা ঠেকিয়ে লাভ নাই, কারণ সব জায়গায় শয়তান মাথা ঠেকিয়েছে। শয়তান ফেরেশতাদের সর্দার ছিলেন, কিন্তু মানুষ সেজদা করতে অস্বীকার করায় ‘শয়তান’ হয়েছে। কিন্তু যেটা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হোল শয়তান তো আল্লার এবাদত ত্যাগ করে নি। সে নামাজ-কালাম পড়ে, আল্লার এবাদত করে। খ্রিস্টিয়ানিটিতে ‘এন্টি-ক্রাইস্ট’ ও ‘ইভিল’-এর ধারণা আছে। ইসলামে এইসব নাই। ইবলিস একবারও বলে নি, আল্লা তার প্রভু নয়, সে শুধু মানুষকে সেজদা দিতে  অস্বীকার করেছে। তাহলে মানুষের কম্পিটিশান শয়তানের সঙ্গে। মানুষকে বুঝতে হবে শয়তান কোথায় সেজদা দেওয়া বাকি রেখেছে। সেখানেই ভজনা করতে হবে। নদীয়ার ফকিরিতে ‘মানুষ ভজনা’-র ধারণ  এখান থেকেই এসেছে। নামাজ কালাম পড়লেই কে শয়তান আর কে মানুষ সেটা বোঝা যায় না। শয়তানের চেয়ে বড় নামাজী  ত্রিভূবনে নাই। এই ক্ষেত্রে একমাত্র নির্ণায়ক হচ্ছে মানুষ ভজনা।
এটা পরিষ্কার থাকা দরকার ইসলাম নিয়ে লালনের কোন মাথাব্যথা ছিল না। ঠিক তেমনি ছিল না সনাতন, খ্রিস্টান,ইহুদি বা অন্য কোন ধর্ম নিয়ে। তাঁকে কোন ধর্মের ভেতর পাওয়া যাবে না। আবার তিনি ধর্মের বাইরেও নাই। কারন তিনি মানুষ ভজনা করেন। আর মানুষই ধর্ম করে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে লালন বিমূর্ত মানুষ নিয়ে কারবার করেন নি, ’মানবধর্ম’ নামক তাঁর কোন ধর্ম নাই। লালন  বুর্জোয়া  ‘মানবতাবাদী’ ছিলেন না। তাঁর সাধনার বিষয় ছিল খুবই সিম্পল,অতিশয় সরল বা যারপরনাই সহজ। মানুষ তাঁর নিজেরই সামনে ‘বর্তমান’ বা হাজির। রক্তমাংসের এই ইহলৌকিক অস্তিত্বের অপার মহিমা ও সম্ভাবনা মানুষ বুঝতে পারে কিনা যা ফেরেশতা বা দেবতাদের পক্ষেও বোঝা সম্ভব না।  মানুষের এই সুরত আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। এই মানুষ কোন কাল্পনিক মানুষ বা মানবতাবাদ না। এই মানুষ হাওয়ায় ভাসে না। এই মানুষ বস্তুময় ও ইহলৌকিক। কিন্তু ফেরেশতাদের কাছে রহস্য। কারন তারা জানে না, কেন আল্লাহ আদম সৃষ্টি করলেন। এই মানুষ বানিয়ে সেই শরীরী মানুষকে  সেজদা দিতে আল্লাহ ফেরেশতাদের নির্দেশ দিয়েছেন। মানুষের শরীর আছে,তার জন্মমৃত্যু আছে, মানুষ এই নশ্বর শরীরেই বাস করে। ইসলাম অনেক গভীর ব্যাপার। লালনকে গায়ের জোরে ইসলামের বাইরে ঠেলা দিলে নিজেরাই ছিটকে বাইরে পড়ে যাবার সম্ভাবনা। ধর্ম তামাশা করার জিনিস না।
তাই ‘সহজ মানুষ ভজে দেখনারে মন দিব্যজ্ঞানে’ । ইসলামের নবী যে ‘দিব্য জ্ঞান’ লাভ করে মানুষের মহিমা কায়েমের জন্য দুনিয়ায় এসেছিলেন,সেই জায়গা থেকে — অর্থাৎ মানুষের মহিমা কায়েমের বাইরে ফকির লালন নতুন কিছুই বলেন না। ‘মানুষ ভজনা’-ই অতএব নদীয়ার রাজনীতি।
ইসলাম নিয়ে মুসলমানেরা কি করবে না করবে সেটা তাদের নিজস্ব ব্যাপার। লালন ইসলামের কোন সংস্কারক নন। তিনি ইসলাম উদ্ধার করতে আসেন নি। তিনি সুফি,দরবেশ নন। নিজেকে তিনি ‘ফকির’ বলেছেন। নদীয়ার ফকির। অর্থাৎ তিনি একান্তই বাংলার। বাংলার ইতিহাস ও ভাবের জগত থেকেই তাঁর আবির্ভাব ঘটেছে। লালন কোন আলেম ওলেমা ওয়াজিয়ান না। যার ভাল লাগে তিনি তাঁর ‘কালাম’ শুনতে পারেন । কিম্বা তাঁকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করতে পারেন। তাঁর কোন সৈন্যসামন্ত হাতিঘোড়া যুদ্ধ বহর নাই। গান আর ভাব ছাড়া তাঁর আর কিছুই নাই। তাও আবার তিনি ‘জ্যান্তে-মরা’ হবার কথা বলেন। অর্থাৎ তাকে মানলে ইহলোকে কিছুই পাবার আশা নাই। পরলোকেও না।  তিনি জান্নাতের টিকিট বিক্রি করেন না। কিম্বা দোজখ থেকে বাঁচাবার কোন ফর্মুলা বেচাবিক্রি করেন না।  সকল প্রকার ইহলৌকিক লোভ-লালসা,কামনা-বাসনা-বর্জিত হয়ে ‘মানুষ’ জিনিসটা আসলে কী? মানুষ কেন দুনিয়ায় এলো? মানুষের কর্তব্য কী? –সেইসব জিজ্ঞাসা দিয়ে আমাদের উলটা ভারাক্রান্ত করে দিয়ে গিয়েছেন। তাই আমার উপদেশ আটঘাট না বেঁধে কেউ ফকিরদের কাছে যাবেন না। এটা কঠিন পথ। সবার জন্য নয়।  ব্যস!! আর কিছু না। অথচ  ভাবের আকর্ষণে লক্ষ লক্ষ মানুষ ফকির লালন শাহের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। এদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।  সেটা তো লালনের দোষ না। লালন ধর্ম প্রচারক না।
দিল্লীর আগ্রাসী সাংস্কৃতিক রাজনীতি বাংলাদেশের সংস্কৃতির গোড়ায় যে হামলা দীর্ঘকাল ধরে চালিয়ে আসছে তার সার কথা হচ্ছে  লালন হৈলেন ‘বাউল’, তিনি বাউল গো সম্রাট। বাউলেরা গাঁজা খায়, ব্যভিচারী, খারাপ কাজ করে, ইত্যাদি। লালন যেহেতু বাউল, তিনিও সেইসব কুকর্ম করেন। বাউল সম্রাট লালন গাঁজাখোর ও ব্যভিচারী, আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঋষি। এই হোল দিল্লীর সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও প্রপাগান্ডার মর্মবাণী। বাংলাদেশের আলেম-ওলেমাদের একটা অংশ দিল্লির এই ঘৃণ্য সাংস্কৃতিক রাজনীতির পৃষ্ঠপোষক। আলেম-ওলেমা ও ইসলামপন্থিদের লালন বিদ্বেষী অংশ দিল্লীর এই সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বাস্তবায়নের জন্য খেয়ে না খেয়ে উঠেপড়ে লেগেছে।
লালন কখনই নিজেকে ‘বাউল’ বলেন নি। নিজেকে ‘দরবেশ’-ও বলেন নি,অথচ তাঁর গুরু সিরাজ সাঁই একজন ‘দরবেশ’, সেটাও আবার স্বীকার করতে ভুল করেন নি। কিন্তু বড়বাংলায় তিনি যে ধারা গড়ে তুলেছেন সেটা তুর্কিস্তান,ইরান,সৌদি আরব বা আফগানিস্তান থেকে আমদানি করেন নি। তিনি দেখিয়েছেন বড় বাংলার নিজের শক্তিশালী ভাবের ধারা রয়েছে তা  ইসলামসহ মানবেতিহাসের যে কোন ইতিবাচক ভাবের ধারা বহনে সক্ষম, সকলের সঙ্গে ইতিবাচক ‘কাটান’ বহাল রাখাও সম্ভব। ‘কাটান’ মানে গ্রহন ও বর্জন। মানুষ কী?  কোথা থেকে কেন এসেছে? কোথায় যাবে? কার কাছে যাবে? নাকি মৃত্যুই শেষ। এই সকল চিরন্তন জিজ্ঞাসা জারি রাখাই ফকিরদের কাজ।
জয়গুরু। আশা করি তরুণ আলেমরা সাবধান হবেন।