ঠিক ১০ বছর আগের কথা, তখন ব্লগে লিখছি নিয়মিত। নিজের লেখায় এবং অন্যের লেখায় তুমুল তর্ক-বিতর্কে মেতে থাকতাম। তেমনই একদিন খবর পাওয়া যায়, ইলিয়াস আলীকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। খবরটিকে ভিত্তি করে নানা রকম লেখা ব্লগে আসে। এর মধ্যে একটি লেখার বিষয় ছিল জনাব ইলিয়াস আলীর রাজনৈতিক জীবনে কী কী বিতর্ক ছিল, সেগুলো। লেখাটি পড়লে যে কারও বুঝতে বাকি থাকবে না, লেখক চেয়েছেন ইলিয়াস আলী কতো ‘খারাপ’ সেটা মানুষের সামনে নিয়ে আসা এবং সেটার ভিত্তিতে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া নিয়ে কিছু মানুষের শোরগোলকে চাপা দিতে। দশ বছর আগের ঘটনাটি মনে পড়লো একজন ‘ওজনদার’ মানুষের অতি সাম্প্রতিক একটি মন্তব্য সামনে আসায়। সেই বক্তব্যে আসছি কলামের পরের দিকে।
বাংলাদেশে বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন থাকার সময়ে ৬০০ এর বেশি মানুষের গুম (এনফোর্সড ডিজএপিয়ারেন্স) হওয়ার অভিযোগ আছে। এর চাইতে অনেক বেশি মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেও যেহেতু এই ক্ষেত্রে স্বজনকে ফিরে পাবার সম্ভাবনা থাকে না তাই হত্যাকাণ্ডের শিকারদের আত্মীয়-স্বজনরা সংগঠিত নন এবং তারা প্রতিবাদ চালিয়ে যান না। কিন্তু যেহেতু গুম হওয়া মানুষদের কেউ কেউ দীর্ঘ সময় পরেও ফিরে এসেছেন এবং নিজেদের স্বজনদের মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেননি, তাই গুম হওয়া মানুষদের স্বজনরা আশায় দিন কাটান কোনো একদিন তাদের স্বজন ফিরে আসবে।
তাই তারা সংগঠিত হয়েছেন ‘মায়ের ডাক’ নামের একটি সংগঠনের অধীনে। নিয়মিতভাবে তারা ইনডোর, আউটডোর সভা করেন। এ কারণেই গুমের বিষয়টি আমাদের সামনে আসে নিয়মিত বিরতিতেই।
একজন মানুষ, সে যত খারাপই হোক না কেন তার আইনের (যদিও আইন নিয়ে অনেক কথা বলা যায়) নিয়ম দ্বারা বিচার পাবার অধিকার আছে। কোনোভাবেই একজন মানুষ সরকারি বাহিনীর হাতে গুম হয়ে যেতে পারে না। এমনকি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা অনুসারে যদি মানুষরা ব্যক্তিগত কারণে পালিয়ে গিয়ে থাকে, তবুও তাদের খুঁজে বের করার দায়িত্ব সরকারের। সুবিচার পাওয়া একটা রাষ্ট্রের নাগরিকের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধিকার। রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকের চুক্তির বলেই এই অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্রীয় বাহিনী যখন বিনা বিচারে কাউকে হত্যা করে কিংবা গুম করে তখন এই চুক্তির ভয়ঙ্কর বরখেলাপ হয়।
সম্প্রতি জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট বাংলাদেশ সফর করে গেলেন। তার এই সফর বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, মতপ্রকাশের স্বাধীনতাহীনতা, হেফাজতে নির্যাতনের সঙ্গে গুম নিয়ে আলোচনা নতুন করে আবার উস্কে দেয়। এই সময় ঢাকা সফররত জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কমিশনের এশিয়া-প্যাসিফিক শাখার প্রধান ররি মুনগোবেনের সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএনপির ৪ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল। সেই প্রতিনিধি দলে ছিলেন মানবাধিকার বিষয়ক কমিটির সদস্য, গুম হয়ে যাওয়া ইলিয়াস আলীর সন্তান আবরার ইলিয়াস। অর্থাৎ এই সফরকে কেন্দ্র করে আর সব গুমের সঙ্গে জনাব ইলিয়াস আলীর গুম নতুন করে আলোচনায় এসেছে।
আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, গুম হওয়া ব্যক্তিদের বিষয়ে মিডিয়া যদি সরকারের দায়িত্বশীলদের কাছে জানতে চায়, তখন স্পষ্টভাবে তারা বলেন বাংলাদেশে সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কাউকে তুলে নিয়ে যায় না। কেউ যদি নিখোঁজ থেকে থাকে, সেটা তারা থাকেন নানা ব্যক্তিগত কারণে। যেমন টাকা পাওনাদারের হাত থেকে বাঁচতে, প্রেম বা একাধিক বিয়েজনিত কারণে ইত্যাদি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছিলেন আরেক কারণ- ‘জাতিসংঘ নয়, জাতিসংঘের কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান আমাদের একটি তালিকা দিয়েছিল। পরে দেখা গেল, ‘অনেক লোকের ভূমধ্যসাগরে সলিল সমাধি হয়েছে’। অবিশ্বাস্য শোনালেও সত্য যে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মানিবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারকে তার আগে বলা কারণগুলোই বলেছেন গুমের কারণ হিসেবে। সঙ্গে যুক্ত করেছেন আরেকটি কারণ- মামলার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থেকে বাঁচতে।
কয়েক মাস আগে থেকে সরকারের ওপরে জাতিসংঘের চাপ বাড়ার প্রেক্ষাপটে সরকার গুম হওয়া মানুষদের বাসায় পুলিশ পাঠিয়েছে। কিন্তু সেক্ষেত্রেও ছিল না ন্যূনতম আন্তরিকতা বরং পুলিশ স্বজনদের ওপরে নানা রকম চাপ তৈরি করে তাদের এমন স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করেছে যে, তাদের পরিবারের কোনো সদস্যকে সাদা পোশাকের অস্ত্রধারীরা তুলে নিয়ে যায়নি।
এমন হয়রানির পরিস্থিতিতে ‘মায়ের ডাক’ আয়োজিত এক সভায় ২০১৯ সালের ১৯শে জুন স্বামী ইসমাইল হোসেন নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে নাসিমা আক্তার সরকারি সংস্থাগুলোর কাছ থেকে কী আচরণের মুখোমুখি হয়েছেন, তার বিবরণ দেন। নতুন করে পুলিশি তৎপরতার কী কারণ, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন তিনি।
নাসিমা আক্তার বলেন, ‘কিসের পুলিশ? আমি থানায় গেছি, পুলিশ আমাকে থানা থেকে বের করে দিয়েছে। পুলিশের ডিসি আমার চিঠিটা একবার পড়লো না। বলে র্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ, আপনি র্যাবের কাছে যান। পুলিশ এখন ৩ বছর পর এসে জিজ্ঞেস করে আমার স্বামী আসলে গুম হয়েছে নাকি কোথাও চলে গেছে। আমাদের কষ্ট লাগে, ঘেন্না আসে এখন। মন্ত্রীরা আরামে বসে থাকে, আমাদের বিরুদ্ধে যখন কথা বলে, হেলেদুলে বলে, “আরে না। বাংলাদেশে কখনো গুম হয় না। উনারা ঋণের দায়ে চলে গেছে, বিয়ে করেছে। এটা কতোটা লজ্জার! আমার মনে হয় না সমাজে শ্বাস নেই। আমাদের এখন মেরে ফেলেন। তারা আমাদের চোখের পানি নিয়ে হোলি খেলে। উপহাস করে। আমার ঘরে কোনো উৎসব হয় না। আমার বাচ্চারা কখনো হাসে না।”
গুমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর দায়দায়িত্ব যেহেতু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অধীনে, তাই তিনি রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক গুমকে অস্বীকার করাটাকেই সঠিক বলে মনে করেছেন। কিন্তু সরকার দলীয় একজন সদস্য এবং নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী গেছেন একেবারে ভিন্ন পথে। আসলে তার বক্তব্যই ১০ বছর আগে একজন ব্লগারের লেখাকে আমার স্মৃতিতে নিয়ে এসেছে। সম্প্রতি একটি সভায় জনাব খালিদ বলেন, এই কলামের জন্য তার প্রয়োজনীয় অংশটা হলো-
“ওই বিএনপি যখনই মানবাধিকারের কথা আসে, তখনই বলে কী যে, আমাদের ইলিয়াস আলী গুম হয়ে গেছে। কে এই ইলিয়াস আলী….এই ইলিয়াস আলী কে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১১ জন ছাত্রকে বহিষ্কার করা হয়েছিল তার মধ্যে ইলিয়াস আলী অন্যতম।
১০ বছর আগে একজন ব্লগারের মুখে একজন মানুষের চরিত্র হননের মাধ্যমে তার ওপর ঘটে যাওয়া বীভৎস বর্বরতাকে জায়েজ করা আর সেই কাজটি একজন রাজনৈতিক নেতা এবং সরকারের একজন মন্ত্রী করার মধ্যে দুস্তর ব্যবধান। আসলে এর পেছনে নাগরিকদের দায়ও আছে অনেক।
এ দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে বছরের পর বছর ধরে শত শত মানুষকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যার অভিযোগ রয়েছে। কখনো চিহ্নিত সন্ত্রাসী, কখনো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, কখনো মাদক কারবারি, আবার কখনো নারায়ণগঞ্জের ৭ খুনের মতো একেবারে ব্যক্তিগত ‘ধান্দায়’ অনেক মানুষ খুনের শিকার হয়েছেন। এ ঘটনাগুলো চলতে পেরেছে, কারণ দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই দেশের নাগরিকদের একটা অংশের মধ্যে এর প্রতি সমর্থন আছে। বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ডের শিকার মানুষটি অপরাধী হলে অনেকেই একে যথাযথ হিসেবে মেনে নেন।
এভাবে ভাবার কারণেই অনেক সময় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পর আমরা অনেকেই উল্লাস প্রকাশ করেছি। আজ থেকে বছর দশেক আগে পুরান ঢাকার কুখ্যাত সন্ত্রাসী শহীদ (যিনি পরিচিত ছিলেন ডাকাত শহীদ নামে) বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। অন্তত দুই ডজন হত্যা মামলায় অভিযুক্ত ছিলেন তিনি, তার বিরুদ্ধে ছিল সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির বড় অভিযোগ। তিনি হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার পর পুরান ঢাকায় তার প্রভাবাধীন এলাকায় শত শত মানুষ আনন্দ মিছিল করেছিল। অনেক ব্যবসায়ী মিষ্টি বিলিয়েছিলেন তখন।
অভিযুক্ত ব্যক্তিকে বিচার প্রক্রিয়ার বাইরে হত্যা করে ফেলা যায়- এমন একটা মানসিকতা আমাদের দেশের অনেকের মধ্যে আছে। ভয়ঙ্কর ডাকাত তো বটেই, অতি তুচ্ছ ছিনতাইকারী-পকেটমারকে হাতেনাতে ধরে ফেলতে পারলে, এমনকি সন্দেহ হলেও পিটিয়ে মেরে ফেলার ইতিহাস এ দেশে অতি প্রাচীন। এসব গনপিটুনিতে অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে এই দেশের প্রশাসন কোনোদিন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। কারণ রাষ্ট্রও মনে করে এটাই হওয়া উচিত অপরাধীর ‘ন্যায্য’ পরিণতি।
জনাব খালিদ তার বক্তব্যে ইলিয়াস আলী কী ছিল, কেমন ছিল, কতো খারাপ তার অতীত এসব সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। উদ্দেশ্য স্পষ্ট- জনগণকে এই ইঙ্গিত দেয়া যে ইলিয়াস আলীর মতো ‘ভয়ঙ্কর খারাপ’ মানুষ নিখোঁজ হওয়া ‘জায়েজ’। ধরে নিলাম লেখকের সব কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি; তার সঙ্গে আরও অনেক অপ্রকাশ্য অপরাধ আছে তার, আলোচনার খাতিরে ধরে নিলাম এটাও। তো সব জেনে কী আমরা ইলিয়াস আলীর গুম হওয়াকে ‘জায়েজ’ বলে ধরে নেবো? খুশি হবো, নিদেনপক্ষে চুপ থাকবো যে ‘ভীষণ খারাপ’ একজন মানুষ গুম হলো?
মানবাধিকারের প্রতি ন্যূনতম ধারণা থাকা মানুষ এ রকম একটা নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাকে গুরুত্ব না দিয়ে পারে না। নিখোঁজ ব্যক্তি যত খারাপই হোক না কেন। তাই এই মুহূর্তে ইলিয়াস আলী কতো খারাপ ছিল সেই আলোচনার চাইতে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা দেশে দীর্ঘদিন থেকে যে গুম চলছে সেটার বিরুদ্ধে আলোচনা, কঠোর অবস্থান।
একজন মানুষ, সে যত খারাপই হোক না কেন তার আইনের (যদিও আইন নিয়ে অনেক কথা বলা যায়) নিয়ম দ্বারা বিচার পাবার অধিকার আছে। কোনোভাবেই একজন মানুষ সরকারি বাহিনীর হাতে গুম হয়ে যেতে পারে না। এমনকি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা অনুসারে যদি মানুষরা ব্যক্তিগত কারণে পালিয়ে গিয়ে থাকে, তবুও তাদের খুঁজে বের করার দায়িত্ব সরকারের।
সুবিচার পাওয়া একটা রাষ্ট্রের নাগরিকের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধিকার। রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকের চুক্তির বলেই এই অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্রীয় বাহিনী যখন বিনা বিচারে কাউকে হত্যা করে কিংবা গুম করে তখন এই চুক্তির ভয়ঙ্কর বরখেলাপ হয়। তখন খুব যৌক্তিক প্রশ্ন আসে, এটা আদৌ রাষ্ট্র কিনা। ক্ষমতাসীনদের মনে রাখা জরুরি বিচার করে কাউকে শাস্তি প্রদান বা দায়মুক্তি দেয়ার ক্ষমতাই একটা রাষ্ট্রকে রাষ্ট্র করে তোলে। ঠাণ্ডা মাথায় খুন করে ফেলা বা অপহরণ/গুম করে ফেলা স্রেফ সন্ত্রাসীর কাজ। বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং গুম রাষ্ট্রকে সেই পর্যায়ে নিয়ে যায়।
গুম হওয়া এলাকার দায়িত্ব প্রাপ্ত পুলিশ অপিসারকে জানিয়ে ঐ এলাকায় অপারেশন করা হয় এটা ১০০% নিশ্ছিত। যার কারনে থানায় মামলা নেয়া হয় না।
গুম, খুনের পরে পুলিশ বা অন্য আইন শৃংখলা বাহিনীর নির্লীপ্ততা ঐ সব বাহিনীর সম্পৃক্ততা প্রমান করে ।
গুম, খুনের পরে পুলিশ বা অন্য আইন শৃংখলা বাহিনীর নির্লীপ্ততা ঐ সব বাহিনীর সম্পৃক্ততা প্রমান করে ।