ক্ষমতার ফ্রাঙ্কেনষ্টাইন
আরিফুল হক
ইংরেজ লেখিকা মেরি শেলীর কালজয়ী উপন্যাস ফ্রাঙ্কেনষ্টাইন। এক বিজ্ঞানী; মৃত মানুষকে বাঁচিয়ে তোলার পদ্ধতি আবিষ্কার করলেন। একদিন তিনি এক মৃত ব্যক্তির উপর সেই পদ্ধতি প্রয়োগ করায়, মৃত ব্যক্তি বেঁচে উঠলো বটে, তবে সে এক ভয়ঙ্কর শক্তিশালী দানবে রূপ নিল। যে দানব একএক করে সবকিছু ধ্বংস করে ফেলল, শেষে বিজ্ঞানীকেও হত্যা করলো। এই হল ফ্রাঙ্কেনষ্টাইন উপন্যাসের সংক্ষিপ্ত গল্প!
এ যেন বাংলাদেশেরই রূপক। এদেশের জনগণ বিভিন্ন সময় দাসন সৃষ্টি করেছে। যা এক এক করে সবকিছু গিলে খেয়েছে। এখন শূণ্য হাতে নিরূপায় জনগণ! কত আশা নিয়ে,কত বাহারী নাম দিয়ে সৃষ্টি করেছিল সেই দানবদের ! জননেত্রী, বঙ্গবন্ধু,পল্লীবন্ধু আরও কত তাদের নামের বাহার। কত আদর যত্নে জনগণ তাদের হাতে তুলে দিয়েছিল ক্ষমতার চাবি কাঠি। তখন কি জনগণ জানতো যে,ক্ষমতা বলতে এই ফ্রাঙ্কেনষ্টাইন কেবল ‘পালোয়ানী’ ই বুঝবে। আর সেই পালোয়ানীর অর্থ হবে,পঙ্গপালের মত সব কিছু খেয়ে দেশ উজাড় করে ফেলা!
গত পঞ্চাশ বছর ধরে ক্ষমতার ফ্রাঙ্কেনষ্টাইন দেশটাকে উজাড় করে খেয়ে ফেলেছে। ধর্ম খেয়েছে। শিক্ষা সংস্কৃতি খেয়েছে। ইতিহাস খেয়েছে। মানবতা-মূল্যবোধ খেয়েছে। ঐতিহ্য-আচরণ খেয়েছে। জাতীয় পরিচয়,রাজনৈতিক অধিকার এমনকি বাঁচার অধিকার পর্যন্ত গিলে খেয়েছে। পড়ে আছে চলচ্ছশক্তিহীন মানুষগুলোর, মোড়কে মোড়া কঙ্কাল। তারা কথা বলতে পারেনা, ক্ষিধায় কাঁদতে পারেনা, যন্ত্রনায় আর্তনাদ করতে পারেনা, অত্যাচারে প্রতিবাদ করতে পারেনা। শুধু নেশাগ্রস্তের মত নিশ্চুপ পড়ে থাকে। মার খায়! আর মাঝেমধ্যে চোখ মেললেই উন্নয়নের নৃত্যগীত শোনে। তার পর আবার নীরবে পড়ে থাকে।
যে দেশের, ৫ জনে এক জন দারিদ্রসীমার নিচে বাস করে, সেই দেশ নাকি ‘উন্নয়নের রোড মডেল’? যে দেশের ৫০ লক্ষ গৃহ হীন মানুষ ফুটপাথের বা রেললাইনের ধারে মানবেতর জীবন কাটায়, জনসংখ্যার ৪ভাগের ৩ভাগ মানুষ কাদামাটির ঘরে বাস করে। সেই দেশকে সিঙ্গাপুরের মত উন্নত দেশ ঘোষনা করা হয়। শিক্ষা ক্ষেত্রে শুধু মাত্র সাক্ষরতার অনুপাতে দেশের অবস্থান ১২৪ তম স্থানে। বস্ত্রের জন্য জাকাতের কাপড় সংগ্রহে গিয়ে ভীড়ের চাপে যে দেশের নারী শিশু মারা যায় ! যে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই। চিকিৎসা ব্যবস্থা এত নাজুক যে, সর্দিকাশি হলেও দু’চারজন ভাগ্যবান কে চেন্নাই হংকং ব্যাংকক লণ্ডনে চিকিৎসা নিতে ছুটতে হয়! বাদবাকির মৃত্যু ডাক এলে চিকিৎসা বা হাসপাতালে স্থান মেলে। যে দেশে মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের মতও সংস্থান নেই, সেই দেশে উন্নয়নের আস্ফালন শোনা যায়।
১৮ কোটি মানুষ মরে বেঁচে আছে, না বেঁচে মরে আছে তারা নিজেও জানেনা। উন্নয়নের ড্রাগ খাইয়ে তাদের বিবশ অর্ধচেতন ফেলে রাখা হয়েছে। তারা ভুলে গেছে প্রতিবাদের ভাষা। ভুলে গেছে নিজেদের ক্ষমতার কথা। ভুলে গেছে যে,ঐ দৈত্যের চাইতেও অধিক শক্তিধর তারা। দেশের সকল ক্ষমতার উৎস তারাই। তাদের আঘাতে বিশাল পর্বতমালা ধ্বসে পড়তে বাধ্য। ঐ মানুষ খেকো ফ্রাঙ্কেনটাইন তাদের সমবেত শক্তির কাছে কিছুই নয়। তারপরও কাগুজে বাঘের ভয়ে তারা নিশ্চুপ পড়ে থাকে।
কারণ সেই বিষের প্রয়োগ। ব্রিটিশের রেখে যাওয়া বিষ, “ডিভাইড এ্যাণ্ড রুলূ”, ‘ভাগ কর আর রাজ কর’। স্বৈরাচার ফ্রাঙ্কেনষ্টাইনের রাজ কৌশলই হল, ১৮ কোটি মানুষকে ১৮ ভাগে ভাগ কর, আর রাজ কর। ৩৬ কোটি হাত যেন কোন মতে একমুষ্টিবদ্ধ হতে না পারে সেদিকে তার সদা শ্যেন দৃষ্টি। মুক্তিযুদ্ধপক্ষ-বিপক্ষ,রাজাকার-মুক্তিযোদ্ধা এসব পুরানো বিভক্তি তো আছেই, এই বিভক্তি আরও শক্ত, পোক্ত করার জন্য, একএক দল বা গোষ্ঠীর উপর একএক ধরণের গায়েবী ইস্যু বা সমস্যা সৃষ্টিকরে ছুড়ে দেয়া হচ্ছে , যাতে মূলইস্যুর দিকে কেউ নজর উঠিয়ে তাকাতে না পারে। গায়েবী ইস্যুগুলো হলো, যুদ্ধাপরাধীর বিচার ইস্যু, এতিমের টাকা মারার ইস্যু, শাহবাগ ইস্যু, সাগর-রুনী ইস্যু, নিরাপদ সড়ক ইস্যু, মেজর সিনহা হত্যা ইস্যু থেকে আজকের ভাষ্কর্য-মূর্তি ইস্যু সবই এক উদ্দেশ্যে গাঁথা । এগুলোর কোনটাই জাতীয় ইস্যু নয় ।তবু বিভিন্ন দল বা গোষ্ঠী এইসব ইস্যু নিয়েই মেতে আছে। তারা বিচ্ছিন্ন মঞ্চ থেকে প্রতিবাদ করছে , মার খাচ্ছে , জেলে যাচ্ছে, শক্তিক্ষয় করছে, নিস্তেজ হয়ে ঝিমিয়ে পড়ছে। ফলে মূল ইস্যু তার জয়জয়কার অব্যাহত রেখেছে।
ফ্রাঙ্কেনষ্টাইনের সাইড ইস্যু সৃষ্টির উদ্দেশ্য আজ অনুধাবন করতে হবে। সে উদ্দেশ্য হল সকল সমস্যার অনুঘটক যে দৈত্য নিজেই, সেটাকে আড়াল করা। অতএব সাইড ইস্যু নিয়ে ব্যস্ত থাকলে চলবেনা । সবার রক্তচক্ষু এক করে তাকাতে হবে মূল ইস্যু সৃষ্টিকারি স্বৈরাচারি দৈত্যের দিকে। মুল সমস্যা সৃষ্টিকারি স্বৈরাচারকে উৎপাটন করতে পারলেই স্বয়ংক্রিয় ভাবে সকল সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। মূল সমস্যা সৃষ্টিকারি আজ কারও অচেনা নয় ! সে আপামর জনসাধারণের চিহ্নিত স্বৈরাচারি,ক্ষমতালোভী,দেশের দুষমন ঐ দানব ফ্রাঙ্কেনষ্টাইন।
আজ দেশজুড়ে নেমেছে অন্ধকার। ১৮ কোটি মানুষ সর্বনাশের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। স্বাধীনতা বন্ধক পড়েছে মহাজনের কাচারী ঘরে। মনুষ্যত্ব লাচ্ছিত। এসময় নির্জীব পড়ে থাকার সময় নেই। জনগনকে নিজের ক্ষমতার দিকে ফিরে তাকাতে হবে। ৩৬কোটি মুষ্টিবদ্ধ হাতের ক্ষমতা কম নয় ! চাই ইস্পাত কঠিন একতা। যে একতা মুসলমানদের জন্য ফরজ কাজ ! কান পেতে শুনুন কোরানুল করিমের ডাক “হে মুমিনগণ ! তোমরা আল্লার রশি শক্ত হাতে ধর, আর পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়োনা”!(বাকারা:১০৩) ।
দেশ বাঁচাতে আজ একতার বিকল্প নেই। আমাদের রসূল(সঃ) বলেছেন ‘যে দেশকে ভালবাসেনা সে প্রকৃত ইমানদার নয়।’
দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব আজ বিপন্ন। ইমানের পরীক্ষা দেওয়ার এইতো উপযুক্ত সময়। দেশের ইমানদার আলেম ওলামাদের এক হয়ে এগিয়ে আসতে হবে। রাজনীতি করিনা বলে গা ঢাকা দিলে চলবেনা। ইসলাম মানেই রাজনীতি। ইসলাম কোনদিন রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলনা। কোরানের শক্তিতে বলীয়ান আলেমরাই দেশের বড় শক্তি। তাঁরাই হবে দেশরক্ষার অগ্রসৈনিক।দেশের প্রতি ভালবাসা মুসলমানদের ইমানী দায়িত্ব। আল্লাহর রাসূল (সঃ) বলেছেন, ‘দুটো চোখ জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবেনা, একটি চোখ যে আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন করে, অপরটি যে চোখ সীমান্ত পাহারায় বিনিদ্র রাত্রি যাপন করে (তিরমিজি)। দেশের এই ক্রান্তি লগ্নে দেশ পাহারার দায়িত্ব প্রতিটি মুসলমানকে কাঁধে তুলে নিতে হবে।
ইসলাম হচ্ছে চিন্তার স্বাধীনতা। কুকর্মে আনুগত্য ইসলামের শিক্ষা নয়। কুকর্মে দেশের কাণা পূর্ণ হয়ে গেছে। ক্ষমতার ফ্রাঙ্কেনষ্টাইন জনগনের বিরূদ্ধে ব্যূহ রচনা করে সকল কুকর্ম আড়াল করে রেখেছে। ৯২ভাগ মানুষের ইসলাম অন্ধকারে নিমজ্জিত। আজ উচ্চকিত হোক বিবেকের ডাক। ভীরুর মত নেপথ্যে কথা বলে কোন লাভ নেই।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, “যার ভিত্তি পচেগেছে তাকে একদম উপড়ে ফেলে নতুন করে ভিত্তি না গাঁথলে তার উপর ইমারত যতবার খাঁড়া করা যাবে, ততবার তা পড়ে যাবে”। বাংলাদেশের ৯২% তৌহিদী জনতার দেশটাকে হায়দারাবাদ জুনাগড়ের পথে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। আল্লাহর পথে সকলে একজোট হয়ে দেশ রক্ষার প্রাচীর হয়ে দাঁড়ান। হাতে হাত রেখে দানবের গড়া পচা ভিত্তিটা জড়থেকে উপড়ে ফেলুন। নতুন শক্তভিত্তির উপর নির্মিত হোক বাংলাদেশ নামের মজবুত ইমারত। সেই শক্ত ভিত্তি হোক‘কোরানুল করিম ‘এর ভিত্তি। যার চেয়ে শক্ত ভিত্তি বৈজ্ঞানিক ভাবে আরকিছু আবিষ্কৃত হয়নি। সকলে এক কন্ঠে আওয়াজ তুলুন ! আমরা আর শাসক চাইনা। আমরা চাই আল্লাহর খাদেম ! জনগনের সেবক ! যার নেতৃত্বে বাংলাদেশের পবিত্রমাটি সত্য-সুন্দরের ফুলে ফুলে আবার ভরে উঠবে। তখনই হবে সত্যিকার সোনার বাংলাদেশ !