হাসান আফরাদ
আজ ২৮ শে অক্টোবর। ২০০৬ সালে চার দলীয় জোট সরকারের ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রাক্কালে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে যে তাণ্ডবলীলা চালিয়েছিল, প্রকাশ্য দিবালোকে লগি-বৈঠা দিয়ে তরতাজা মানুষদের পিটিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে লাশের উপর যে নারকীয় উল্লাসে মেতে উঠেছিল, তাকে “পল্টন ট্রাজেডি দিবস” কিংবা “লগি-বৈঠার তাণ্ডব দিবস” কিংবা যেভাবেই নামকরণ করা হোক না কেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক কালো অধ্যায় হয়ে থাকবে। পরিস্থিতির ভয়াবহতার মাত্রাকে বিভিন্নভাবে পরিমাপ ও মূল্যায়ন করা হলেও এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণে বার বার সামনে আসবে। আসতে হবে।
কী ঘটেছিল সেদিন?
২০০৬ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট সরকার পাঁচ বছর সরকার পরিচালনা শেষে শান্তিপূর্ণভাবে কেয়ারটেকার সরকারের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলছে। এ সংক্রান্ত যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করে বঙ্গভবন যথারীতি প্রস্তুত। ২৮ অক্টোবর রাত ৮টায় বঙ্গভবনে কেয়ারটেকার সরকারের প্রধান হিসেবে বিচারপতি কে এম হাসানের শপথ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ক্ষমতা হস্তান্তরের অপেক্ষায় সমগ্র দেশবাসী। সেদিন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী জোট সরকারের সহযোগী হিসেবে বলা যায় অনেকটা ‘বিদায় অনুষ্ঠান’ এবং কেয়ারটেকার সরকারকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেইটে পূর্বঘোষিত শান্তিপূর্ণ সমাবেশের আয়োজন করে। এদিকে “একটা লাশের বদলে দশটা লাশ” চাওয়া আওয়ামী লীগ সভাপতি ও তৎকালীন মহাজোটের নেতা শেখ হাসিনা ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পল্টনের এক সমাবেশে নিজ নেতা-কর্মীদের লগি-বৈঠা নিয়ে রাজপথে বিশেষভাবে ঢাকায় চলে আসার নির্দেশ দেন।
শেখ হাসিনার নির্দেশ মত আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলের নেতা-কর্মীরা লগি বৈঠা ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ২৭ অক্টোবর রাত থেকেই ঢাকাসহ সারাদেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে থাকে। ২৮ শে অক্টোবরের জামায়াতের পূর্বনির্ধারিত সমাবেশে সকাল থেকেই নেতা-কর্মীরা উপস্থিত হতে থাকেন বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেইটে। এদিকে খুনের নেশায় মত্ত আওয়ামী ঘাতক বাহিনী চূড়ান্ত আঘাত হানার জন্য তাদের কেন্দ্রীয় অফিস, মুক্তাঙ্গন সহ ঢাকার সর্বত্র প্রস্তুতি নিতে থাকে। জামায়াতের অনুষ্ঠান শুরুর পূর্বেই দফায় দফায় হামলা চালানো হয়। সমাবেশ অভিমুখী জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীদের উপর দফায় দফায় আক্রমণ চালাতে থাকে। সর্বশেষ জামায়াত সমাবেশ শুরু করার পর চূড়ান্তভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে সন্ত্রাসী আওয়ামী বাহিনী। সমাবেশকে লক্ষ্য করে মুহুর্মুহু গুলি এবং বোমা নিক্ষেপ করতে থাকে। আওয়ামী সন্ত্রাসীদের তাণ্ডবে পুরো ঢাকা শহর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। নেতৃবৃন্দের নিকট আহত এবং নিহতের খবর আসতে থাকে।
আওয়ামী ঘাতক বাহিনীর নিষ্ঠুরতা ও পাশবিকতার এমন নজীর আইয়ামে জাহেলিয়াতকেও হার মানিয়েছে। পাঁচ থেকে ছয়দিন সারা দেশকে জিম্মি করে সেসময়ের আওয়ামী সন্ত্রাসীদের সশস্ত্র আক্রমণ ও মৃতদেহের ওপর নগ্ন উল্লাস আর নৃশংস-উন্মত্ততা সারা বিশ্বকে হতবাক করে দিয়েছে। আওয়ামী জিঘাংসার শিকার হয়ে শাহাদাত বরণ করেন গোলাম কিবরিয়া শিপন (২১), মুহাম্মদ মুজাহিদুল ইসলাম (২২), সাইফুল্লাহ মুহাম্মদ মাসুম (১৬), রফিকুল ইসলাম (১৫), আব্দুল্লাহ আল ফয়সাল (২৪), মোঃ শাহজাহান আলী (২৫), জসিম উদ্দিন-১, আরাফাত হোসেন সবুজ(২৩), আব্বাস আলী (২৬), জাবিদ আলী (৫৫), সাবের হোসেন (৩২), রুহুল আমিন (৪৫), জসিম উদ্দিন-২ সহ প্রায় ১৪জন। আহত এবং পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন শতাধিক।
শহীদের মায়েদের বুকফাটা আর্তনাদে বাংলাদেশের আকাশ ভারি হয়ে উঠেছিল সেদিন। শাহাদাত বরণকারী মুজাহিদুল ইসলামের মা মাহমুদা মানসুরী মুন্নী তাঁর প্রিয় সন্তানকে নিয়ে লেখেন-
“২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর আমার জীবনের সবেচেয় বড় স্মরণীয় দিন, সবচেয়ে বেদনার দিন এবং সবচেয়ে বড় শুকরিয়া আদায়ের দিন। এই দিনে আমার পরম প্রিয় নাড়িছেঁড়া ধন, রক্তের বাঁধন ছিন্ন করে শাহাদাত বরণ করলো। সে হলো শহীদ মুজাহিদুল ইসলাম। সে ছিল আমার অতিপ্রিয় সন্তান। যাকে যাবে না কোন দিন ভোলা। সে যে অন্তরে থাকবে অতি যতনে। সে ছিল আমার চোখের মণি, কলিজার টুকরা, সাধনার ধন, আত্মারই এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তার বিহনে আমি যে কিভাবে বেঁচে আছি তা শুধু আমি ও আমার সৃষ্টিকর্তা জানেন। সে শুধু আমার সন্তানই ছিল না, ছিল পরম প্রিয় বন্ধু। আমার জীবনের যত কষ্ট, যন্ত্রণা, বোবাকান্না তা শুধু তার সাথে শেয়ার করেছি, অন্য কারো সাথে নয়। নয় স্বামী, নয় বাবা-মা, নয় কোন আত্মীয়স্বজন। সে ছিল আমার পরামর্শদাতা। আজ সে নেই তাই আমার অব্যক্ত বুকফাটা আর্তনাদ। তার মত ভালো আমলের ভালো ছেলে পরকালে আমি পাবো তো? এই জীবনে তাকে আমি কিছু দিতে পারিনি তাই আল্লাহকে বলি, হে আল্লাহ এই জীবনে যতটুকু পুণ্য করেছি এবং মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত যা পুণ্য অর্জন করবো, তার সবটুকু সওয়াবই আল্লাহ যেন তার আমলনামায় যোগ করে দেন। আমার জন্য আমার পাপগুলো থাক জমা। আমার আল্লাহ যা ভালো মনে করবেন তাই করবেন।”
২৮শে অক্টোবর কী ধরনের প্রভাব রেখেছে গত এক যুগে?
সারা দেশে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের তাণ্ডবলীলায় সরকার পরিবর্তন প্রক্রিয়া আর স্বাভাবিক পথে আগাতে পারেনি। আওয়ামী লীগের আন্দোলনের ফসল সেনা সমর্থিত ১/১১ সরকার ক্ষমতায় আসীন হলো। শুদ্ধি অভিযানের নামে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করা শুরু হলো। মানুষের কথা বলার অধিকার প্রায় কেড়ে নেয়া হলো। ডিজিএফআই কর্তৃক সংবাদ মাধ্যমে সেন্সর করা শুরু হলো। রাজনীতিশূন্য করে বাংলাদেশকে যখন বিকলাঙ্গ করার সকল আয়োজন সম্পন্ন হলো তখন যেসকল দেশপ্রেমিক বাংলাদেশি হাতে কলম তুলে নেন, নির্যাতিত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান তাঁদের অন্যতম। সেনা সমর্থিত ১/১১ সরকার দীর্ঘ দুই বছর ক্ষমতায় থাকার পর ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনা হলো। যদিও স্বাভাবিক ও স্বচ্ছ নির্বাচন হলেও বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয় সরকার পুনরায় ক্ষমতায় আসতে পারতো কিনা সেটা নিয়ে বিতর্ক করা যাবে!
প্রতিশোধস্পৃহায় মত্ত ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আরোহণ করেই প্রথমে পিলখানায় ৫৭জন সেনা অফিসারসহ প্রায় ৭৪জনকে হত্যার মাধ্যমে সেনাবাহিনীকে দুর্বল করা হলো এবং ভারতের আজ্ঞাবহ কপর্দকহীন বাহিনীতে পরিণত করা হলো। পোশাক, লোগো এবং নাম পরিবর্তন করে বিডিআরকে করা হলো দারোয়ানের চেয়েও অধম ‘বিজিবি’। প্রতিনিয়ত সীমান্তে বাংলাদেশীদের হত্যা করা হলেও বর্তমান বিজিবি’র কোনো বিকার নেই। বরং উল্টো বিএসএফ কর্তৃক নিরীহ বাংলাদেশীদের হত্যার পক্ষে সাফাই গাইছেন স্বয়ং বিজিবি প্রধান।
গত এক যুগ ধরে জনগণের ঘাড়ে চেপে বসা ফ্যাসিবাদী আওয়ামী জমানায় এখন আর বাংলাদেশে বিচার বিভাগ বলতে কোনো কিছু অবশিষ্ট নেই। সরকারের পক্ষে রায় না দেয়ার কারণে হত্যার হুমকি নিয়ে দেশ ছাড়তে হয়েছে স্বয়ং প্রধান বিচারপতিকে। অস্রের মুখে দেশ থেকে পালাতে বাধ্য হয়েছেন বিচারপতি মোতাহার হোসেন। তথাকথিত যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে বিচার বিভাগীয় হত্যাকাণ্ডের আয়োজন সম্পন্ন করা হয়েছে। আদালত পাড়া থেকে আসামী পক্ষের সাক্ষী সুখরঞ্জন বালীকে অপহরণ করার পর তাকে ভারতের কারাগারে পাওয়া গিয়েছিলো। তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম তখন সাংবাদিকদের ফোন করে এ সংক্রান্ত কোনো সংবাদ প্রকাশ না করার জন্য হুমকি দিয়েছিলেন। শাহবাগে দিল্লীর সহায়তায় মব জাস্টিসের ব্যবস্থা করা হলো। খুনি এবং আদালত ভাঙচুরকারী হলো বিচারপতি।
অর্থনীতিকে ঋণনির্ভর করে দেশের মানুষের ঘাড়ে ঋণের বোঝা চাপানো হয়েছে। শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারি আর আওয়ামী লীগ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় দরবেশ বাবা, ক্যাসিনো সম্রাট, ইয়াবা বদি, শাহেদদের উত্থান হয়েছে গত এক যুগে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলের মত বড় বড় প্রজেক্ট নিয়ে দুর্নীতি করে লুটতরাজের পথ সুগম করেছে। হাজার হাজার কোটি টাকা মহা উৎসবে বিদেশে পাচার করা হচ্ছে। মানবপাচার ও অর্থ পাচারের অভিযোগে কুয়েতে গ্রেফতার হয়েছে আওয়ামী সংসদ সদস্য কাজী শহীদ ইসলাম ওরফে কাজী পাপুল। সরকার সমর্থকদের ব্যাংকের অনুমোদন দিয়ে সাধারণ মানুষের হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। অনেক ব্যাংক আজ প্রায় দেউলিয়া। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অর্থ চুরির মত ঘটনা ঘটলেও সরকার নির্বিকার থেকেছে।
ইসলামকে মানুষের জীবনবোধকে মুছে দিয়ে সেখানে হিন্দুত্ববাদী সংস্কৃতিকে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। মিডিয়াগুলোকে ইসলামের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। নামাজ পড়া, কুরআন-হাদীস, ইসলামী বই রাখা, পাঞ্জাবী-টুপি পরাকে জঙ্গিবাদের আলামত হিসেবে চিহ্নিত করে ইসলাম বিদ্বেষী মিডিয়া দিয়ে সেগুলো প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আলেমদের বিভিন্নভাবে বিভাজিত করা হয়েছে। তরুণদেরকে ইসলাম বিমুখ করার জন্য সকল আয়োজন সম্পন্ন করা হয়েছে। সর্বোপরি, রাজনীতিকে সংকুচিত করে নবরূপে একদলীয় বাকশাল কায়েম করা হয়েছে।
ঔপনিবেশিক দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ জাতি সাধারণত ভুলোমনা হয়ে থাকে। তাদের উপর সকল নির্যাতন আর নির্মমতা সহজে ভুলে যায়। তবুও আজকের প্রজন্ম ২৮শে অক্টোবরে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের তাণ্ডবলীলা থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন বুনবে, এই প্রত্যাশা রেখে আজকের লেখা এখানে শেষ করলাম। আল্লাহ হাফিজ।