ঢাকা যাদের, রাষ্ট্র ক্ষমতা তাদের
২৭ ডিসেম্বর ২০১৮
ঢাকার আসন মানেই ক্ষমতা—১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকেই এমন ধারণা বদ্ধমূল বাংলাদেশের রাজনীতিতে। তা হবেই বা না কেন! ১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতনের পর থেকে বাংলাদেশে যতগুলি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয়েছে, সবগুলোতেই একই ঘটনা ঘটেছে। ঢাকা মহানগরের আসন যে রাজনৈতিক দলের দখলে গেছে, বা এই আসনগুলিতে যে দল জিতেছে ক্ষমতায় গেছে তারাই।
রাজধানী ঢাকার আসন গুলিকে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের শক্তির উৎস হিসেবে ধরা হয়। বিশেষ করে ঢাকা মহানগরীর আসনগুলির গুরুত্ব অপরিসীম। তবে এ ক্ষেত্রে একটি জিনিস বারবার দেখা গেছে গোটা দেশের ভোটের গতি-প্রকৃতি ঢাকার আসনগুলিতে প্রভাব বিস্তার করেছে। গোটা দেশ যে দিকে ভোট দিয়েছে, ঢাকার তুলনামূলক শিক্ষিত ও উচ্চমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত এমনকি নিম্নবিত্ত শ্রেণির ভোট দেওয়ার প্রবণতা সেদিকেই। এটাকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, এক ধরনের রাজনৈতিক সুবিধাবাদ।
বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কোনো আসনেও ভোটাররা প্রার্থীর সঙ্গে এলাকার যোগ বিচার করে ভোট দেন। সেখানেও অনেক সময় মার্কার চেয়ে প্রার্থী প্রাধান্য পায়, কিন্তু ঢাকায় এমনটি দেখা যায় না। এখানে নির্বাচনে জেতা যায় কেবল মার্কা আর রাজনৈতিক হাওয়া কাজে লাগিয়ে। ঢাকার নাগরিকেরাই বেশি করে মার্কা আর প্রার্থীর শক্তি দেখে ভোট দেন।’
ঢাকার ভোটারদের ‘সুবিধাবাদী’ চরিত্র বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আবুল মকসুদ স্মৃতি হাতড়ে বলেন, ‘ড. কামাল হোসেনকে আমরা সবাই শ্রদ্ধা করি। তিনি শিক্ষিত, তাঁকে যোগ্য রাজনীতিক হিসেবেই আমরা জানি। কিন্তু ১৯৯১ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে গিয়েছিলেন বিএনপির অপরিচিত এক প্রার্থীর কাছে। খুব শিক্ষিত ও যোগ্য হিসেবে সেই প্রার্থীর সুনাম ছিল না। কিন্তু তিনি হেরে গিয়েছিলেন। ১৯৯৬ নির্বাচনে নিজের দলের প্রতীকে তিনি নির্বাচন করেন ধানমন্ডি-মোহাম্মদপুরের আসনটি থেকে। কিন্তু তাঁর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। এই ঢাকার ভোটাররাই হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে “স্বৈরাচার” উপাধি দিলেও তিনি ২০০৮ নির্বাচনে গুলশান-বনানীর আসনে বিপুল ভোটে জিতেছিলেন।’
২০০১ সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত ঢাকা মহানগর ও এর আশপাশে আসন ছিল ১৩ টি। এগুলো হচ্ছে-ঢাকা-১ (দোহার), ঢাকা-২ (নবাবগঞ্জ), ঢাকা-৩ (কেরানীগঞ্জ), ঢাকা-৪ (ডেমরা-শ্যামপুর), ঢাকা-৫ (গুলশান-ক্যান্টনমেন্ট-উত্তরা), ঢাকা-৬ (মতিঝিল-সবুজবাগ), ঢাকা-৭ (সূত্রাপুর-কোতোয়ালি), ঢাকা-৮ (লালবাগ-হাজারিবাগ), ঢাকা-৯ (ধানমন্ডি-মোহাম্মদপুর), ঢাকা-১০ (তেজগাঁও-রমনা), ঢাকা-১১ (মিরপুর), ঢাকা-১২ (সাভার), ঢাকা-১৩ (ধামরাই)। ১৯৯১,১৯৯৬, ২০০১ সালের তিনটি সাধারণ নির্বাচনে জিতে যে দল ক্ষমতায় এসেছে, এই ১৩ আসনের সিংহভাগই তাদের দখলে গেছে।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনের (সবশেষ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন) আগে ঢাকার সে সময়ের ১৩টি সংসদীয় আসন বিস্তৃত করা হয়। জনসংখ্যার ভিত্তিতে এই নতুন আসনবিন্যাসে ঢাকার আস ১৩টি থেকে বেড়ে হয় ২০ টি। ২০০৮ নির্বাচনের বিজয়ী আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট জয়ী হয় এই ২০ আসনেই। ঢাকার আসনগুলিতে প্রায় প্রতিটি নির্বাচনেই পরিবর্তন হয়েছে, দুই দলেরই। ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে ঢাকার ১৩ আসনের মধ্যে ৪ টিতেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন দুই নেত্রী। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সেবার সারা দেশ থেকে পাঁচটি আসনে নির্বাচন করেছিলেন। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচন করেছিলেন ৩ টিতে। শেখ হাসিনা গোপালগঞ্জের একটি আসনের বাইরে ছিলেন ঢাকা-৭ ও ঢাকা-১০ আসনে।
খালেদা জিয়া ফেনি, বগুড়া ও চট্টগ্রামের তিনটি আসনের বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন ঢাকা-৫ ও ঢাকা-৯ আসনে। আশ্চর্যের ব্যাপার, ঢাকায় নির্বাচনী ফল খালেদা জিয়ার পক্ষে গেলেও শেখ হাসিনা দুটি আসনেই হেরে গিয়েছিলেন তুলনামূলক নবীন প্রার্থীর কাছে। ১৯৯১ সালে ঢাকার সব কটি আসন বিএনপির দখলে গিয়েছিল। ঢাকার আসনগুলিতে শেখ হাসিনা ছাড়াও হেরেছিলেন আওয়ামী লীগের মোস্তফা মহসীন মন্টু, সাজেদা চৌধুরী, ড. কামাল হোসেন ও মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনের মতো নেতারা। বিএনপি সেবার নির্বাচনের মাধ্যমে ঢাকা মহানগরের রাজনীতিতে দুই হেভিওয়েটের জন্ম দেয়-মির্জা আব্বাস (ঢাকা-৬) আর সাদেক হোসেন খোকা (ঢাকা-৭)। বিএনপি প্রার্থীদের মধ্যে সেবার জিতেছিলেন ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা (ঢাকা-১), আবদুল মান্নান খান (ঢাকা-২), আমানউল্লাহ আমান (ঢাকা-৩), সালাউদ্দিন আহমেদ (ঢাকা-৪), মীর শওকত আলী (ঢাকা-৮), মেজর (অব.) আবদুল মান্নান (ঢাকা-১০) ও হারুনুর রশিদ মোল্লা (ঢাকা-১১), দেওয়ান মোহাম্মদ সালাউদ্দিন (ঢাকা-১২) আর ব্যারিস্টার জিয়াউর রহমান খান (ঢাকা-১৩)।
সাদেক হোসেন খোকা ও মেজর মান্নানের কাছে হেরেছিলেন শেখ হাসিনা। খালেদা জিয়া হারিয়েছিলেন সাহারা খাতুন ও সাজেদা চৌধুরীকে। পরে বিএনপি চেয়ারপারসন ঢাকায় জেতা দুটি আসন ছেড়ে দিলে উপনির্বাচনেও জিতেছিলেন বিএনপির প্রার্থীরা। ঢাকা-৫ থেকে জয়ী হন মেজর (অব.) কামরুল ইসলাম আর ঢাকা-৯ থেকে ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার।
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত একতরফা নির্বাচনে বিএনপি ছাড়া কোনো মূল রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করেনি। স্বভাবতই সেবার ঢাকার সব কটি আসনই নিজেদের দখলে নিয়ে নেয় বিএনপি। তবে ত্রয়োদশ সংশোধনী পাশের পর নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ঢাকায় ভোটের রাজনীতি কিছুটা উল্টোদিকে প্রবাহিত হয়। তবে নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানোর পরেও ঢাকার ১৩টি আসনের মধ্যে ৫টি আসন নিজেদের দখলে রেখে নিজেদের শক্তিমত্তার প্রমাণ কিন্তু বিএনপি রেখেছিল। ঢাকা-৪, ঢাকা-৫, ঢাকা-৬, ঢাকা-৮ ঢাকা-৯, ঢাকা-১০ ও ঢাকা-১১ আসনে জয়ী হয় আওয়ামী লীগ।
১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ঢাকায় নতুন প্রার্থীর সমাগম ঘটায়। ঢাকা-৪-এ প্রার্থী হন হাবিবুর রহমান মোল্লা, ঢাকা-৫-এ একেএম রহমতউল্লাহ, ঢাকা-৬-এ সাবের হোসেন চৌধুরী, ঢাকা-৭-এ ফজলুল করিম, ঢাকা-৮-এ হাজী মোহাম্মদ সেলিম, ঢাকা-৯-এ মকবুল হোসেন, ঢাকা-১০ এ ডা. এইচবিএম ইকবাল আর ঢাকা-১১ আসনে ছিলেন কামাল আহমেদ মজুমদার। ঢাকা-৭ এর ফজলুল করিম ছাড়া বাকিরা সকলেই সেবার জয়ী হয়েছিলেন।
২০০১ নির্বাচনে মোটামুটি একই প্রার্থী বিন্যাসে ঢাকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ আসনে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিএনপি ঢাকার সব কটি আসনই নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। আগের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের কাছে হারের মধুর বদলা নেন বিএনপির সালাহউদ্দিন আহমেদ (হাবিবুর রহমান মোল্লা), মেজর (অব.) কামরুল ইসলাম (একেএম রহমতউল্লাহ), মির্জা আব্বাস (সাবের হোসেন চৌধুরী), মেজর (অব.) আবদুল মান্নান (ডা. এইচ বি এম ইকবাল)। ঢাকা-৮ আসনে হাজী সেলিমকে ঠেকাতে বিএনপি মনোনয়ন দিয়েছিল সাবেক ছাত্রনেতা নাসিরউদ্দিন পিন্টুকে। পিন্টু নির্বাচনে জিতেছিলেন। ঢাকা-১১ আসনে আগের নির্বাচনের পরাজিত প্রার্থী এখলাসউদ্দিন মোল্লাকে বদলিয়ে সেখানে মনোনয়ন দেওয়া হয় সাবেক সাংসদ ও স্থানীয় রাজনীতিতে অভিজ্ঞ এসএ খালেককে। খালেকও হারিয়েছিলেন কামাল আহমেদ মজুমদারকে। ধানমন্ডি মোহাম্মদপুরে মকবুল হোসেনকে হারিয়েছিলেন প্রবীণ আইনজীবী মাহবুবউদ্দিন আহমেদ। এছাড়া দোহারে নাজমুল হুদা, নবাবগঞ্জে আবদুল মান্নান খান কেরানিগঞ্জে আমানউল্লাহ আমান ছাড়াও ধামরাই ও সাভারে জিয়াউর রহমান খান আর দেওয়ান মোহাম্মদ সালাউদ্দিন নির্বাচন জয়ের হ্যাটট্রিক সম্পন্ন করেছিলেন।
২০০৬ সালের শেষ দিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন কমিশন নিয়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা ফলে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি দেশে জরুরি অবস্থা জারি হয়। এরপর ড. ফখরুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত সেনাবাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুই বছর ক্ষমতায় থাকে। জরুরি অবস্থার কারণে ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় সাধারণ নির্বাচন বাতিল হয়েছিল। ২০০৮ সালের ডিসেম্বর যখন নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তখন ঢাকার আসন বাড়িয়ে ২০টি করা হয়। বেশ কয়েকটি আসন জনসংখ্যার ভিত্তিতে একাধিক ভাগে ভাগ করা হয়। এই নির্বাচনে ঢাকার ১-২০ প্রতিটি আসনেই জয় পায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট। আসন বেড়ে যাওয়ায় ঢাকার আসনগুলিতে সেবার সমাগম ঘটে নতুন মুখের। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা অনেকেই ছিলেন পুরোনো।
১৯৯১ সালে নির্বাচন করা সাহারা খাতুন ঢাকা-১৮ (উত্তরা-কুড়িল নিয়ে গঠিত) আসনে নির্বাচন করে জেতেন।
তবে এবার ঢাকার দুটি আসন মহাজোটের শরীকদের ছাড়তে হয় আওয়ামী লীগকে। ঢাকা-৮ আসনে (মতিঝিল ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যাল এলাকা নিয়ে গঠিত) ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন নির্বাচিত হন নৌকা প্রতীক নিয়ে। তিনি পরাজিত করেন বিএনপির হাবীব-উন-নবী খান সোহেলকে। তবে এ নির্বাচনে চমক ছিল ঢাকা-১৭ আসনটিকে ঘিরে। গুলশান-ক্যান্টনমেন্টসহ অভিজাত বনানী, বারিধারা এলাকা নিয়ে গঠিত এই আসনটি আওয়ামী লীগ ছাড়ে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদকে। তিনি লাঙল প্রতীক নিয়ে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন। তাঁর কাছে হারেন বিএনপির সাবেক মন্ত্রী ও আসম হান্নানশাহ।
আসছে সংসদ নির্বাচনেও এ ধারা অব্যাহত থাকবে বলেই ধারণা আবুল মকসুদের। তবে তিনি মনে করেন, এটা বাংলাদেশের রাজনীতির একটি বড় দুর্বলতা। আবুল মকসুদ বলছিলেন, ‘আমি
মনে করি এটা খুব সুস্থ কোনো ধারা নয়। গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য এটি ভালো নয়।’