রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র যেন আত্মহত্যা
০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৭
প্রস্তাবিত রামপাল বিদ্যুতকেন্দ্রের ডিজাইন। (সংগৃহিত)
সুন্দরবন ঘেঁষা রামপালে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ মালিকানায় প্রস্তাবিত কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মান হতে যাচ্ছে। ফলে কেন্দ্রটি নির্মিত হলে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার ওই বিদ্যুৎকেন্দ্র বাগেরহাটের রামপালে সুন্দরবনের পাশে নির্মিত হবে। এটি নির্মাণের জন্য বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি (প্রাইভেট) লিমিটেড (বিআইএফপিসি) নামের কোম্পানিটি গঠিত হয়েছে। কোম্পানিটি গত সপ্তাহে যৌথ মূলধনী কোম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদপ্তর (আরজেএসসি) থেকে নিবন্ধন পেয়েছে। এ কেন্দ্র থেকে ২০১৫ সালে বিদ্যুৎ পাওয়ার কথা থাকলেও স্থানীয় জনগণের আন্দোলন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের চূড়ান্ত অনুমোদন না পাওয়ায় বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মান করতেই অনেক সময় লেগে যাচ্ছে।
রামপালের বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি হবে দুই দেশের সমান অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দুই দেশের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানী এই প্রকল্পের অর্থায়ন করবে ১৫% পি ডি বি, ১৫% ভারতীয় পক্ষ আর ৭০% ঋণ নেয়া হবে। যে নীট লাভ হবে সেটা ভাগ করা হবে ৫০% হারে। উৎপাদিত বিদ্যুৎ কিনবে পি ডি বি। বিদ্যুতের দাম নির্ধারিত হবে একটা ফর্মুলা অনুসারে। কী সে ফর্মুলা? যদি কয়লার দাম প্রতি টন ১০৫ ডলার হয় তবে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ এর দাম হবে ৫ টাকা ৯০ পয়সা এবং প্রতি টন ১৪৫ ডলার হলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ৮ টাকা ৮৫ পয়সা। অথচ দেশীয় ওরিয়ন গ্রুপের সাথে মাওয়া, খুলনার লবন চড়া এবং চট্টগ্রামের আনোয়ারা তে যে তিনটি কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের যে চুক্তি হয়েছে পি ডি বির সাথে সেখানে সরকার মাওয়া থেকে ৪ টাকায় প্রতি ইউনিট এবং আনোয়ারা ও লবন চড়া থেকে ৩টাকা ৮০ পয়সা দরে বিদ্যুৎ কিনবে। সরকার এর মধ্যেই ১৪৫ ডলার করে রামপালের
জন্য কয়লা আমদানির প্রস্তাব চূড়ান্ত করে ফেলেছে। তার মানে ৮ টাকা ৮৫ পয়সা দিয়ে পি ডি বি এখান থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কিনবো সেটা নিশ্চিত। বলাবাহুল্য, এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মানের সিদ্ধান্ত দুঃখজনক। এর মধ্য দিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরকে বুঝিয়ে দেয়া হলো যে পরিবেশের ছাড়পত্রটি যেন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পক্ষেই দেয়া হয়। সরকারই যদি আইন না মানে তাহলে আইন মানবে কে? রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করা হলে সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে যাবে।
উল্লেখ্য, কোন সংরক্ষিত বনের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র করা যায় না। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে প্রচার করা হচ্ছে রামপালে যেখানে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি হতে যাচ্ছে, তা সুন্দরবনের ১৪ কিলোমিটারের বাইরে। কিন্তু বৈশ্বিক অবস্থান নির্ণয় পদ্ধতি বা গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম (জিপিএস) পরিমাপ করলে সরকারের দেয়া তথ্যের মধ্যে গরমিল পাওয়া যায়। সরকার যেখানে বলছে সুন্দরবনের ১৪ কিলোমিটারের বাইরে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, সেখানে বিজ্ঞানীরা বলছে এ দূরত্ব বন থেকে মাত্র দুই কিলোমিটারের মধ্যে। জিপিএস ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা দেখেছে, প্রস্তাবিত প্রকল্প সুন্দরবনের প্রতিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকার মধ্যে পড়েছে। জিপিএস কো অর্ডিনেট, এক্স : ৮৯.৬৯১৬০ এবং ওয়াই : ২২.৪২৭৭৫ নেয়া হয়েছে পশুর নদের প্রান্ত থেকে, যেখানে রামপালের এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটির সীমানা শুরু। এই পয়েন্ট থেকে সুন্দরবনের দূরত্ব মাত্র ১.৩ মাইল বা ২.০৯ কিলোমিটার। বিদ্যুৎকেন্দ্রের আরও ভেতর থেকে নেয়া আরেকটি হিসাব বলছে, বনের দূরত্ব সেখান থেকে মাত্র ১.৯ মাইল বা তিন কিলোমিটার।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণ করা হলে সুন্দরবন যেসব বিপর্যয়ের শিকার হবে তার মধ্যে বিশেষ উল্লেখ্যযোগ্য বিষয়গুলো হচ্ছে-
১. কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন ১৪২ টন বিষাক্ত সালফার ডাই-অক্সাইড ও ৮৫ টন বিষাক্ত নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড নির্গত হবে। ফলে এসিড বৃষ্টি, শ্বাসতন্ত্রের মারাত্মক ক্ষতিসহ গাছপালা-জীবজন্তুর জীবন বিপন্ন হবে।
২. সাড়ে চার বছর ধরে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণকালে পণ্য ও যন্ত্রপাতি সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নদীপথে পরিবহনের সময় বাড়তি নৌযান চলাচল, তেল নিঃসরণ, শব্দদূষণ, আলো, বর্জ্য নিঃসরণ, ড্রেজিং ইত্যাদির মাধ্যমে সুন্দরবনের ইকোসিস্টেম বিশেষ করে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণ, ডলফিন, ম্যানগ্রোভ বন ইত্যাদির উপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে।
৩. কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বছরে ৪৭ লাখ ২০ হাজার টন কয়লা পুড়িয়ে ৭ লাখ ৫০ হাজার টন ফ্লাই অ্যাশ ও ২ লাখ টন বটম অ্যাশ উৎপাদিত হবে। এ ফ্লাই অ্যাশ, বটম অ্যাশ, তরল ঘনীভূত ছাই ইত্যাদি ব্যাপকমাত্রায় পরিবেশ দূষণ করে।
৪. কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের টারবাইন, জেনারেটর, কম্প্রেসার, পাম্প, কুলিং টাওয়ার, কয়লা উঠানামা, পরিবহন ইত্যাদি কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ও যানবাহন থেকে ভয়াবহ শব্দদূষণ হবে।
৫. প্লান্ট পরিচালনার জন্য পশুর নদ থেকে ঘণ্টায় ৯ হাজার ১৫০ ঘনমিটার পানি সংগ্রহ করা হবে এবং পরিশোধন করার পর পানি এ নদীতেই ঘণ্টায় ৫ হাজার ১৫০ ঘনমিটার হারে নির্গমন করা হবে। গোটা
সুন্দরবনের স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ, পানির প্লাবতা, পরিবহন ক্ষমতা, মৎস্য ও অন্যান্য প্রাণী এবং উদ্ভিদের জীবন চক্র ইত্যাদির উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে।
৬. কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চিমনি থেকে নির্গত বিষাক্ত গ্যাসের তাপমাত্রা হবে ১২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা চারপাশের পরিবেশের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে।
৭. বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য আমদানি করা কয়লা সুন্দরবনের মধ্য দিয়েই পরিবহন করা হবে। বড় জাহাজ এবং লাইটারেজ জাহাজ সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে কয়লার মতো দূষণকারী কার্গো নিয়ে চলাচল করবে। ফলে কয়লা পরিবহন, উঠানামা, জাহাজের ঢেউ, নাব্য রক্ষার জন্য ড্রেজিং, জাহাজ থেকে নির্গত তরল-কঠিন বিষাক্ত বর্জ্য, জাহাজ নিঃসৃত তেল, দিন-রাত জাহাজ চলাচলের শব্দ, সার্চলাইট ইত্যাদি সুন্দরবনের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ও জীববৈচিত্র্য বিনাশ করবে। এগুলো আমাদের নিজেদের কথা নয়, প্রকল্পের কাজ শুরু করে দিয়ে তারপর এটি বৈধ করার জন্য যে পরিবেশ সমীক্ষা করা হয়েছে, তাতে শত জালিয়াতি করেও এ রকম ভয়ঙ্কর ফলাফলকে ঢেকে রাখা যায়নি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব আনু মুহাম্মদ বলেছেন, ‘এনটিপিসি’র সঙ্গে ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য চুক্তি করেছে, এই চুক্তি পুরোপুরি অসম ও অস্বচ্ছ চুক্তি। ভারতের সাথে এ চুক্তি টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশনগুলো পুরোপুরি বাংলাদেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে, আইনগত বা বিধিসম্মতভাবে এ চুক্তি হয়নি। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী চুক্তি করলে প্রথমে এ ব্যাপারে এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট করতে হবে তারপর চুক্তির বিষয়।’ (সূত্র : রেডিও তেহরান)
আমরা জানতে পারলাম যে,
বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য বছরে ৪৭ লক্ষ ২০ হাজার টনকয়লা ইন্দোনেশিয়া, অষ্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে সমুদ্রপথে আমদানী করতে হবে। আমাদানীকৃত কয়লা সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে জাহাজের মাধ্যমে মংলাবন্দরে এনে তারপর সেখান থেকে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু সুন্দরবনের ভেতরে পশুর নদীর গভীরতা সর্বত্র বড় জাহাজের জন্য উপযুক্ত না হওয়ার কারণে প্রথমে বড় জাহাজে করে কয়লা সুন্দরবনের আকরাম পয়েন্ট পর্যন্ত আনতে হবে, তারপর আকরাম পয়েন্ট থেকে একাধিক ছোট জাহাজে করে কয়লা মংলাবন্দরে নিয়ে যেতে হবে। ১৩২০ মেগাওয়াটের জন্য প্রতিদিন প্রায় ১৩ হাজার টন কয়লা লাগবে।অর্থাৎ দ্বিতীয় পর্যায়ের শেষে ২৬ হাজার টন কয়লা লাগবে। এর জন্য সুন্দর বনের ভেতরে হিরণ পয়েন্ট থেকে আকরাম পয়েন্ট পর্যন্ত ৩০ কিমি নদী পথে বড় জাহাজ বছরে ৫৯ দিন এবং আকরাম পয়েন্ট থেকে মংলা বন্দরপর্যন্ত প্রায় ৬৭ কিমি পথ ছোট জাহাজে করে বছরে ২৩৬ দিন হাজার হাজার টন কয়লা পরিবহন করতে হবে! সরকারের পরিবেশ সমীক্ষাতেই স্বীকার করা হয়েছে, এভাবে সুন্দরবনের ভেতরদিয়ে কয়লা পরিবহনকারী জাহাজ চলাচল করার ফলে, কয়লা পরিবহনকারী জাহাজ থেকে কয়লার গুড়া,ভাঙা /টুকরো কয়লা, তেল,ময়লা আবর্জনা, জাহাজের দূষিত পানি সহ বিপুল পরিমাণ বর্জ্য নি:সৃত হয়ে নদী-খাল-মাটি সহ গোটা সুন্দরবন দূষিত করে ফেলবে। চলাচলকারী জাহাজের ঢেউয়ে দুইপাশের তীরের ভূমি ক্ষয় হবে। কয়লা পরিবহনকারী জাহাজ ও কয়লা লোড-আনলোড করার যন্ত্রপাতি থেকে দিনরাত ব্যাপক শব্দ দূষণ হবে। রাতে জাহাজ চলার সময় জাহাজের সার্চ লাইটের আলো নিশাচর প্রাণী সহ সংরক্ষিত বনাঞ্চল সুন্দরবনের পশু-পাখির জীবনচক্রের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে।
পূর্বে, এই ভারতীয় কোম্পানি এন টি পি সি র মধ্যপ্রদেশে প্রস্তাবিত কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প ভারতীয় পরিবেশ মন্ত্রণালয় বাতিল করে দিয়েছে। তাঁরা বলেছে,” বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির জন্য প্রস্তাবিত স্থানটি কৃষি জমি, যা মোটেই প্রকল্পের জন্য গ্রহণযোগ্য নয়। তাছাড়া নর্মদা নদী থেকে প্রকল্পের জন্য ৩২কিউসেক পানি টেনে নেয়া প্রকল্পের জন্য বাস্তবসম্মত নয়। কৃষি জমির সল্পতা,নিকটবর্তী জনবসতি, পানির সল্পতা, পরিবেশগত প্রভাব এসব বিবেচনায় এই প্রকল্প বাতিল করা হোল’। যে বিবেচনায় এন টি পি সি নিজের দেশে বিদ্যুৎ কেন্দ্রনির্মাণ করতে পারেনি সেই একই বিবেচনায় বাংলাদেশে কী তাদের প্রকল্প বাতিল হতে পারেনা?
প্রসঙ্গত আমরা মনে করি, পরিবেশ রক্ষায় বিশ্বচ্যাম্পিয়নের পুরস্কার লাভকারী ব্যক্তিত্ব যেখানে বাংলাদেশের সরকারপ্রধান হিসেবে কর্মরত রয়েছে, সেখানে সুন্দরবনের মতো বৈশ্বিক ঐতিহ্য হুমকির মধ্যে পড়তে পারে এমন প্রকল্প বাস্তবায়ন কোনোভাবেই কাঙ্খিত হতে পারে না। রামপালের মতো বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন বাংলাদেশকে পরিবেশ বিনষ্টের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর ঝুঁকিও রয়েছে। অথচ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোকে পরিবেশ বিনষ্টের জন্য অভিযুক্ত করে পরিবেশ বিপত্তির শিকার দেশ হিসেবে বাংলাদেশ তাদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ দাবি করে আসছে। তবে যদি সত্যিই এই প্রকল্প বাস্তবয়ায়ন হয়েই যায় তবে আমরা উন্নত দেশের কাছে কি জবাব দিবো?
রামপাল কে তো আমরা আত্মহত্যা বলতেই পারি। তবে কেন আমরা এ আত্মহত্যার পথ বেছে নিবো? বিকল্প কি কিছু নেই?
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ১০: