আব্দুল আলীর শহর ও আবুলদের বিশ্ব জয়

Minar Rashid

বর্তমান সরকার সারা বিশ্বে দেশের মর্যাদা অনেক বৃদ্ধি করে ফেলেছে, এই প্রচারণাটি বারবার শুনে আব্দুল আলীর গল্পটি মনে পড়ে যায়। নিজের চালাকি কিংবা বাহাদুরির গল্প শুনিয়ে এই আব্দুল আলী তার বউয়ের কান ঝালাপালা করে ফেলেছে। বিশেষ করে গ্রাম থেকে শহরে গিয়ে সে কী কী বাহাদুরি করে, সেসবের অনেক গল্প তার ঝুলিতে রয়েছে।

স্ত্রী এক দিন বায়না ধরে স্বামীধনের কীর্তিগুলো নিজ চোখে দেখে দেহমনকে সার্থক করার জন্য। কথামতো একদিন স্ত্রীকে শহরে নিয়ে যায় আব্দুল আলী। বাস থেকে নেমেই স্ত্রীর সামনে বিশেষ কায়দায় শহরের বিল্ডিং গুনতে থাকে। বিষয়টি শহরে এক বাটপারের দৃষ্টিতে পড়ে। জিজ্ঞেস করে,

ওহে বেরাদার, এ কী করছ?

আব্দুল আলী জানায়, কেন আবার, বিল্ডিং গুনছি?

– এ পর্যন্ত কতগুলো বিল্ডিং গুনেছ, হে বেরাদার?

– নয়টি।

– যতটি গুনেছ, ততগুলো টাকা দিতে হবে যে।

 অবস্থা বেগতিক দেখে তাড়াতাড়ি টাকাটা পরিশোধ করে ফেলে। এরপর স্ত্রী মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করে, আপনি না বলেছেন নিজে খুব চালাক! এই তবে আপনার বাহাদুরি!

আব্দুল আলীর জবাব, আরে বুঝস নাই। গুনলাম দশটি, আর কেমন চালাকি করে টাকা দিলাম মাত্র নয়টির জন্য।

 আন্তর্জাতিক পরিসরে বর্তমান সরকারের বাহাদুরির অনেকগুলোই এই আব্দুল আলীর মতো। বউ অনেক কিছু বুঝলেও স্বামীকে খুশি রাখার জন্য না বোঝার ভাণ করে। ফলে নিজের বউকে আব্দুল আলী যেমন বোকা মনে করে, দেশের মানুষকে আবুলদের সরকার তেমনি বোকা ঠাহর করে। আব্দুল আলী যে প্রক্রিয়ায় শহর জয় করেছে, আমাদের আবুলরা হুবহু সেই একই প্রক্রিয়ায় বিশ্বজয় করে ফেলেছে। দিল্লি জয় থেকে শুরু করে সমুদ্র জয়, লন্ডন জয়, ওয়াশিংটন জয়, পর্বত জয়- সব সম্পন্ন হয়ে গেছে। অনেক জায়গায় খায়দায় বাঙ্গাল, আর মোটা হয় ইন্দুলাল এরকম অবস্থা।

 সরকার বলে, বিশ্বসভায় আমাদের ইজ্জত বেড়ে গেছে। অথচ বিশ্বসভায় সনদপ্রাপ্ত দুর্নীতিবাজ হিসেবেই আমাদের নাম ছড়িয়ে পড়েছে। পদ্মা সেতুর ঘটনা এবং সর্বশেষ রিজার্ভ লুটের ঘটনায় তা স্পষ্ট। এ ধরনের চুরির ঘটনা বিশ্বসভায় কম ঘটেছে।

 তারপরও চাপাবাজি একটুও বন্ধ হয়নি। বরং তা অনেক বেড়ে গেছে।

 পদ্মা সেতু থেকে বিশ্বব্যাংক চলে যায়নি। আবুলদের সরকার তাদের খেদিয়ে দিয়ে দেশপ্রেম ও জাতীয় মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রেখেছে। ধরা খাওয়ার পর প্রথমেই চোটপাট দেখিয়ে বিশ্বব্যাংককে ‘গোলামের পুত গোলাম’ বলে গালি দিয়েছে। পরে আবার মিটমাটের জন্য বিশ্বব্যাংকের সম্ভাব্য সব জায়গায় ধরেছে। কিন্তু কোনো কিছুতেই কাজ না হওয়ায় এটাকেই নিজেদের সততা, দেশপ্রেম এবং জাতীয় মর্যাদাবোধ প্রদর্শনের অনন্য নমুনা হিসেবে প্রচার করেছে। এটা দেখিয়ে চামচার দল বলে, ‘বাঘে ধরলে ছাড়ে, নেত্রী ধরলে ছাড়ে না।’

এখন নিজস্ব ফান্ড দিয়ে পদ্মা সেতু করার কথা ভাবা হচ্ছে।

 কিন্তু বিষয়টি দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে কী প্রভাব ফেলবে, তা ঘুণাক্ষরেও ভেবে দেখা হয়নি।

 পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ কখন শেষ হবে, অথবা আদৌ শেষ হবে কি না কিংবা শেষ হলেও কলকাতার উড়াল সেতুর ভাগ্য বরণ করে কি না, তা নিয়েও সন্দেহ দেখা দিয়েছে। কারণ সোনার ছেলেরা ইতোমধ্যে রডের পরিবর্তে বাঁশ দিয়ে সরকারি বিল্ডিং বানানোর যুগান্তকারী ফর্মুলা বের করে ফেলেছে। এরা যে জাতির কত দিকে এমন করে বাঁশ দিচ্ছে, তা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কেউ বলতে পারবেন না। এটাকেই বলে জাতির কপালে ফাটা বাঁশ নয়- একেবারে ডিজিটাল বাঁশ।

 ইন্ডিয়া থেকে মহা এক ‘বাঁশ’ খেয়ে এসেছেন এদেশের কিছু ক্রীড়া সাংবাদিক। অবাক করার ব্যাপার হলো, এতে দেশের মানুষ সহানুভূতিশীল না হয়ে কেমন যেন খুশি খুশি হয়ে পড়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জনগণ তাদের সে প্রতিক্রিয়াটি জানিয়েছে। ইন্ডিয়ার নামে একটি মহল এখনো পাগল। যে ইন্ডিয়া এখনো নিজের বেশির ভাগ জনগোষ্ঠীর জন্য টয়লেট নির্মাণ করতে পারেনি, সেই ইন্ডিয়া নাকি ট্রানজিট ফি দিয়ে আমাদেরকে সিঙ্গাপুরের মতো ধনী বানিয়ে দেবে! মিডিয়ার একাংশই এ কথাটি ছড়িয়েছে। কিন্তু যখন ইন্ডিয়ার কাছ থেকে সেই ট্রানজিট ফি চাওয়ার সময় এলো, তখন এক উপদেষ্টা বলেন, প্রতিবেশীর কাছে ট্রানজিট ফি চাওয়া অসভ্যতা।

ট্রানজিট ফি মাফ করে দিয়ে যে প্রতিবেশীর কাছে সভ্য ও প্রিয় হলাম, সেই প্রতিবেশীর হোটেলে গিয়ে আমাদের সাংবাদিকেরা এমন করে গলা ধাক্কা খেলেন! কাতর নয়নে দেখতে পেলেন, নো বাংলাদেশী পাসপোর্ট ইজ অ্যালাউড। এটা শুধু একজন-দু’জনের ক্ষেত্রে নয়, এই কিছিমের করুণ অভিজ্ঞতা অনেকের হয়েছে।

 সমগ্র বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আমরা আমাদের বিশ্বটা এখন একটি দেশে মধ্যেই সীমিত করে ফেলেছি। ইন্ডিয়াকে নিয়ে অন্ধ প্রেমিকের মতো গান করি, তুমিই আমার পৃথিবী। মুগ্ধ প্রেমিকের মতো সারাক্ষণ গুনগুনিয়ে বলি,

তুমি আমার প্রথম সকাল

 একাকী বিকেল ক্লান্ত দুপুর বেলা

 তুমি আমার সারা দিন আমার

 তুমি আমার সারা বেলা।

 সেই দেশটা এখন আমাদের সাদা দিলে এই কাদাটি লাগিয়ে দিয়েছে।

 কিছুসংখ্যক নীতিভ্রষ্ট ও বিবেক বিবর্জিত লোক দেশপ্রেম আর ইন্ডিয়া প্রেমকে সত্যিই একাকার করে ফেলেছে। যারা ওই দেশে অন্যায়ের বিরুদ্ধে মুখ খুলবে, তাদেরকেই ইন্ডিয়া বিদ্বেষী ও সাম্প্রদায়িক বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে। এই অপরাধ রাষ্ট্রদ্রোহিতার কাছাকাছি বলে গণ্য করা হচ্ছে। একতরফা প্রেম দেখিয়ে আমাদের জাত্যাভিমানকে পুরোপুরি ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে।

 সারা বিশ্বে আমাদের মর্যাদা আগের চেয়ে কতটুকু বৃদ্ধি পেয়েছে, তা বিদেশী ইমিগ্রেশন ফেস করেছেন, এমন প্রতিটি বাংলাদেশী ‘উপভোগ’ করছেন আর সচেতন প্রতিটি দেশবাসী জেনে গেছেন। সারা বিশ্ব থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি আমরা। আরব আমিরাতে আমাদের ভিসা বন্ধ হয়ে গেছে। আরো অনেক দেশ বাংলাদেশীদের জন্য ভিসা সঙ্কুচিত করে দিয়েছে। ইউরোপ থেকে আশি হাজার বাংলাদেশীকে ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছে। ভিসা সমস্যার জন্য মেরিনাররা তাদের চাকরিবাকরি নিয়ে ভয়াবহ সমস্যায় পড়ে গেছে। তারপরও সরকারের কৃতিত্ব আর বাহাদুরির ঢোল বাজানো বন্ধ হয়নি।

 আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এবং গণতন্ত্রকে বন্ধক রাখা হয়েছে জনগণকে দমন করার জন্য। প্রতিপক্ষকে দমনের নিষ্ঠুরতায় নিজের রেকর্ডকেও এ দল অনেক আগেই ছাড়িয়ে গেছে। কানা ছেলের নাম পদ্মলোচনের মতো বশংবদ মিডিয়া এবং বুদ্ধিজীবীকুল এটাকেই গণতন্ত্রের বিজয় বলে ঘোষণা করেছেন। গণতন্ত্রের নাম নিয়ে গণতন্ত্রকে এবং স্বাধীনতার নাম নিয়ে স্বাধীনতাকে জব্দ করে ফেলা হয়েছে।

 গণতন্ত্রের মানসকন্যার আমলে গণতন্ত্রের এ কী চেহারা! আইয়ুব খানের মতো করেই এখন বলছেন, গণতন্ত্র নয়- উন্নয়ন। সেই উন্নয়ন রাষ্ট্রীয় কোষাগার খালি করে চার গুণ খরচে শুধু কিছু রাস্তাঘাট তৈরি করে এক ধরনের ভেলকির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ‘লাগ লাগ ভেলকি লাগ’ কথাটি জনগণকে খাওয়ানো হচ্ছে পুলিশ, র‌্যাব আর বিজিবির ছড়ি ঘুরিয়ে।

 চারদলীয় জোট সরকারের শেষ সময়ে এ দেশকে অর্থনীতির উদীয়মান ব্যাঘ্র বা ইমার্জিং টাইগার হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। হতভাগা জনগণ টের পাচ্ছে না যে, মূলত তাদের সে ভাগ্যটি ছিনিয়ে নিয়ে এসব কথিত উন্নয়নের গল্প শোনানো হচ্ছে। যে টাকা দেশের মানুষের প্রকৃত উন্নয়নে কাজে লাগত, সে টাকা এখন দেশের মানুষকে উন্নয়নের ভেলকি দেখানোর কাজে লাগানো হচ্ছে। সে টাকা অবৈধ ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করার নিমিত্তে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশকে কব্জা করার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে দেশটিকে মূলত এক ধরনের ফাঁপা বেলুন বানানো হচ্ছে। মনে হচ্ছে, এই শাসকের দল যখন বিদায় নেবে, তখন দেশের খোলসটি ছাড়া অন্য কিছু বাকি থাকবে না।

 অ্যানালগ বাকশালের সময়ে সরকারের গুণগানের জন্য চারটি মাত্র পত্রিকা রেখে বাদবাকি সব পত্রপত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। তখন অবশ্য কোনো প্রাইভেট টিভি চ্যানেল ছিল না। ডিজিটাল বাকশাল বাস্তবায়নের সময় দু-একটি পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল ছাড়া বাদবাকি সব পত্রিকা এবং টিভি চ্যানেল বন্ধ করার আর দরকার পড়ে না। কারণ, তারা বাকশালের জন্য হুমকি না হয়ে আশ্চর্যজনকভাবে সহযোগী হয়ে পড়েছে। কেউ সরাসরি একদলীয় ব্যবস্থার পক্ষ নিয়েছে, কেউ নীরব থেকেছে আর কেউ গৃহস্থ আর টক দইওয়ালা স্টাইলে হম্বিতম্বি করে অবশেষে জনগণকে টক দইটিই খাইয়ে দিয়েছে।

 এসব গণমাধ্যম জনগণের মাধ্যম না হয়ে অপশক্তির মাধ্যম হয়ে পড়েছে। এখন নিউ এইজের নুরুল কবিরের সাথে আরো কয়েকজন যোগ হলে আমাদের চোখের সামনে এভাবে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে দুর্বৃত্ততন্ত্র এবং লুটেরাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হতো না। মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করা হলে বাদবাকিরা নীরব থেকে গেছেন। মাহমুদুর রহমানের সম্পাদকীয় পৈতা খাঁটি নয় বলে বাদবাকি মিডিয়া ব্রাহ্মণেরা নাক সিটকিয়েছেন, তাকে ‘বাই চান্স’ সম্পাদক বলে উপহাস করেছেন। বাকশালের আপাত বিজয়ে এটাই সবচেয়ে বড় বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যর্থতা।

 চার দিকে চাটার দলকে আরামছে চাটতে দিয়ে অসহায় এক রাষ্ট্রনায়ক বলেছিলেন, ‘আমার সামনে চোর, পেছনে চোর।… আমার নিজের কম্বলটি গেল কই?’ কিংবা ‘সবাই পায় স্বর্ণের খনি, আর আমি পেয়েছি চোরের খনি।’

আজকে গণতন্ত্র ধ্বংস করে সেই একই খনি থেকে উৎপাদিত চোরেরাই গত কয়েক বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা সাবাড় করে ফেলেছে।

 যার ধমনী ও শিরা দিয়ে সর্বদা আওয়ামী লীগের রক্ত প্রবাহিত হয়েছে, সেই এ বি এম মূসাও হতাশ হয়ে দেশবাসীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, এদের দেখামাত্রই ‘তুই চোর’ বলে সম্বোধন করতে। এই ক্ষণজন্মা মানুষটি দেখিয়ে গেছেন যে, নিজের চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়।

 গত সপ্তাহে এই ক্ষণজন্মা পুরুষটির মৃত্যুদিবস অনেকটা নীরবে নিভৃতে পার হয়ে গেল। আজ মনে হচ্ছে, অভাগা এই দেশটির জন্য এ ধরনের মানুষ আরো অনেক দরকার; যারা যেকোনো পরিস্থিতিতে সাদা সাদা এবং কালোকে কালো বলতে পারবেন। চোর যত বড় কিংবা ভয়ঙ্কর হোক না কেন- মুখের সামনে আঙুল উঁচিয়ে তারা বলতে পারবেন, তুই চোর।

1 COMMENT

  1. Excellent. I liked it more than all the previous ones. Please keep writing because those within Bangladesh cannot write. Nobody will publish what they write. We are the only hope.

Comments are closed.