Minar Rashid
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেভাবে সম্পন্ন এবং কারচুপি প্রতিরোধ করতে শেষ বুলেট থাকা পর্যন্ত ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকীবউদ্দিন আহমদ। জাতির সাথে তার এই সর্বশেষ মশকারাটির ভাগ্যও আগেকার মশকারার মতোই হয়েছে। এবার ইউনিয়ন পরিষদের প্রথম ধাপের নির্বাচন জনগণ প্রত্য করেছে। বাংলাদেশে এমন ‘সশস্ত্র নির্বাচন’ আর কখনোই হয়নি। গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে ‘দুর্বৃত্ততন্ত্র’কে এবার গ্রাম পর্যন্ত প্রসারিত করে ফেলা হয়েছে।
তার পরও প্রধান নির্বাচন কমিশনার লাজলজ্জার মাথা খেয়ে বলছেন, ‘নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে’। আগে ধারণা করা হয়েছিল, তাদের শুধু মেরুদণ্ড নেই। এখন তাদের ভেতরে গিলা, কলিজা কিছু আছে কি না তা নিয়েও অনেকের সন্দেহ দেখা দিয়েছে।
‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা একজন ব্যক্তি এতটা অনুভূতিহীন ও ব্যক্তিত্বহীন হতে পারেন, তা ভাবতেও কষ্ট হয়। বাংলাদেশের নির্বাচনব্যবস্থাকে যেভাবে ধ্বংস করা হয়েছে, তা রিপেয়ার করা আর কোনো দিন সম্ভব হবে কি না জানি না।
অনেকের শঙ্কা, ধীরে ধীরে দেশটিকে হয়তো উত্তর কোরিয়ার মতো বানিয়ে ফেলা হচ্ছে। তবে উত্তর কোরিয়া অন্য কোনো রাষ্ট্রের তাঁবেদারি করে না, আবার সেখানে কোনো নির্বাচন নেই, গণতন্ত্রের নামগন্ধও নেই। আমাদের এখানে রকীব উদ্দিনের মতো সিইসি রয়েছেন। এরশাদ-রওশনের মতো বিরোধীদলীয় নেতানেত্রী রয়েছেন। এরশাদ তার নিজের পুরোটাই ‘ফর ইউর সার্ভিস’ দিয়ে রেখে মাঝে মধ্যে আফসোস করেন। দেশের বুদ্ধিজীবীমহল থেকে শুরু করে অনেকের অবস্থানই হুবহু তার মতো। বলার জন্য সবাই বলবেন, তবে এমন কিছু করবেন না, যাতে বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন হয়।
শেষ বুলেটের এই হুঙ্কারটি সিইসি ছুড়েছিলেন একটি সংবাদ সম্মেলনে। দেশের মিডিয়াও কেমন যেন ‘করে নাকো ফোঁসফাস মারে নাকো ঢুঁসঢাস’ হয়ে পড়েছেন। সবার হয়তো মনে আছে, সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি এম এ আজিজের বিরুদ্ধে এই মিডিয়া কিভাবে উঠে পড়ে লেগেছিল। অথচ পেশাগত জীবনে অত্যন্ত সৎ হিসেবে বিবেচিত ও স্বল্পভাষী (কথা তেমন গুছিয়ে বলতে পারতেন না) বিচারপতি এম এ আজিজের তখন পর্যন্ত কোনো অনিরপেক্ষতা প্রমাণের ঘটনা ঘটেনি। আজ এত কিছু হওয়ার পরও মিডিয়ার বড় অংশ আশ্চর্যজনকভাবে নীরব। এই কঠিন সঙ্কটে যে মিডিয়া এ দেশের মানুষকে রক্ষা করতে পারত, তাদের বড় অংশই আজ যেন একদলীয় ব্যবস্থার রক্ষাকারী হয়ে পড়েছে।
রকিব উদ্দিনের হুঙ্কারটি শুনে সঙ্গত কারণেই স্প্যানিশ সাহিত্যের অমর সৃষ্টি ডন কুইক্সোটের কথা মনে পড়ে যায়। এই বীর পুরুষ পণ করেছিলেন, অশুভ শক্তির সাথে যুদ্ধ করে তিনি মানবসমাজে অমর হয়ে থাকবেন। বীর পুরুষদের কল্পকাহিনীমূলক কিছু বই পড়ে তার মতি বিভ্রম ঘটে গিয়েছিল। তিনি ওই সব কল্পকাহিনীকে সত্য বলে ধারণা করেছিলেন।
কুইক্সোট তার পুরনো ঘোড়া আর সঙ্গী সানচো পাঞ্জাকে সাথে নিয়ে অ্যাডভেঞ্চারে বেরিয়ে পড়েন। প্রত্যেক বীর পুরুষের একজন ‘লেডি লাভ’ থাকে। ডন কুইক্সোটও প্রতিবেশী এক কৃষকের কন্যাকে ‘লেডি লাভ’ ঘোষণা করেছিলেন। তার এ নিয়োগটি অবশ্য সেই কৃষাণকন্যার গোচরে যায়নি।
আমাদের সমসাময়িক সবাই স্কুল বা কলেজ জীবনে এই বীরের বীরত্বগাথা পড়েছেন। পরিত্যক্ত, কাঠের তৈরি উইন্ডমিলকে অশুভ শক্তি মনে করে এর সাথে মহাবিক্রমে যুদ্ধ করে এই বীর পুরুষ আহত হয়েছিলেন। কারো মধ্যে এসব গুণের সমাবেশ দেখলে ‘ডন কুইক্সোট’ বলে ডাকা হতো তাকে।
আমাদের বাংলাদেশের ডন কুইক্সোট অনেক সফল অপারেশন করে বিশ্বে নির্বাচনের ইতিহাসে নতুন লিগ্যাসি সৃষ্টি করে ফেলেছেন। ২০১৪-এর ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে একটি ব্যালট পেপারে ছাপ না দিয়েও সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় ১৫৪টি আসনে সংসদ সদস্য ‘নির্বাচিত’ করা হয়েছিল। বাকি আসনগুলোরও ৫ শতাংশের ওপর ভোট পড়েনি। অনেক ভোট কেন্দ্র ছিল, যেখানে একটি ভোটও পড়েনি। কিন্তু দুই দিন সময় নিয়ে, অনেক ক্যালকুলেশন করে সবার চোখ কপালে তুলে ডন কুইক্সোট ঘোষণা করলেন যে, ভোট কাস্ট হয়েছে ৪০ শতাংশ!
নব্য ডন কুইক্সোটের চমৎকার ফাইট জাতি দেখেছে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে। ঢাকা ও চট্টগ্রামের মেয়র নির্বাচন এবং পৌরসভা নির্বাচনে ডন কুইক্সোটের ফাইট জাতির স্মৃতিতে চিরদিনের তরে অম্লান হয়ে থাকবে। সর্বশেষ, এবার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের আগে খাপ থেকে তরবারিটি সত্যি সত্যিই বের করে ডন কুইক্সোটের স্টাইলে হুঙ্কার ছুড়েছেন। ‘শেষ’ বুলেট ব্যবহার করে হলেও অবাধ ও কারচুপিমুক্ত নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন। ডন কুইক্সোট এ দেশে ‘অসম্ভব সুন্দর’ একটা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন। ‘লেডি লাভ’-এর প্রক্সি দেয়া প্রতিবেশী সেই গণতন্ত্রকে আন্তর্জাতিক মানের গণতন্ত্র হিসেবে সিল মেরে দিয়েছেন।
তবে বর্তমান সরকার শুধু একজন নয়, বেশ কয়েকজন ডন কুইক্সোট জাতিকে উপহার দিয়েছে। বাংলাদেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে আরিক অর্থেই হাজার হাজার কোটি টাকা স্রেফ ডাকাতি হয়েছে। আগে ছিল অ্যানালগ ব্যাংক ডাকাতি। এবার শুরু হয়েছে ডিজিটাল কারবার। ডক্টর তুহিন মালিক সঙ্গত কারণেই লুটের অভিধানে নতুন একটি শব্দ সংযোজন করেছেন। মিলিয়ন ডলার কিংবা কয়েক কোটি টাকা লুট হলে এটার নাম ‘হরিলুট’। কিন্তু বিলিয়ন ডলার লুট বা হাজার হাজার কোটি টাকা লুট হলে এর নাম ভিন্ন।
বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান দু’টি খাত হলো, বিদেশ থেকে আসা রেমিট্যান্স ও গার্মেন্ট। কিন্তু এই সরকার মতায় আসার পর থেকে এ দু’টি সেক্টরের একটিতেও অতিরিক্ত কিছু যোগ হয়নি, বরং মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার এবং গার্মেন্টে আমেরিকার জিএসপি সুবিধা বন্ধ হওয়াসহ বিভিন্নভাবে বাজার সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। তারপরও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ বাড়ল কিভাবে?
মূল কারণ হলো, দেশে কোনো বিনিয়োগ না থাকায় এবং তজ্জন্য বিদেশ থেকে যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য জিনিসের আমদানি কমে যাওয়ায় এই রিজার্ভটি ফুলে উঠেছে। বিনিয়োগ না থাকলে দেশে কর্মসংস্থান হয় না। এটা মূলত দেশ ও জাতীয় অর্থনীতির জন্য একটি টাইমবোমার মতো। অর্থাৎ মুখে রক্ত এসেছে, কিন্তু বের হতে পারেনি। এটা আসলে একটা রোগ-ফোলা মুখকেই প্রচার করা হয়েছে ভালো স্বাস্থ্যের লক্ষণ হিসেবে। একটা পুরস্কারও প্রদান করা হয়েছে এশিয়ার সেরা গভর্নর হিসেবে। অথচ সব বিবেচনায় দেশের মধ্যে মেরুদণ্ডহীন গভর্নর হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে থাকবেন বিশেষ পরিবার ও রবীন্দ্রনাথের ভক্ত ড. আতিউর রহমান। পদত্যাগ করে নিজেই এটাকে ভীরুর মতো নয়, বীরের মতো পদত্যাগ বলে উল্লেখ করেছেন। বীর পুরুষ তো বটেই! কয়েক হাজার টাকা ডাকাতি করলেই জনতা ডাকাতদের পিটিয়ে মেরে ফেলে, কিন্তু হাজার হাজার কোটি টাকা ডাকাতি হয়ে যাওয়ার পর আমানতদারের শুধু একটুখানি পদত্যাগ দেখেই জনগণ সন্তুষ্ট হয়ে পড়েছে?
মোড়ল সাব ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে বলেছিলেন, ‘পড়ে যাইনি। পাশেই কুটুমবাড়ি, তাই নেমে গেলাম।’ আমাদের এই বীর পুরুষও ঠিক তেমনি ‘ভাব’ করার সুযোগ পেয়েছেন। তিনি পদত্যাগে বাধ্য হননি, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে অশ্রুসজল করে খুশি মনে নিজের ইচ্ছায় নাকি পদত্যাগ করেছেন। অথচ অর্থনীতি নামক ঘোড়ার এই পিঠ থেকে পড়ার সময় ভেতরের অনেক কিছু ফাঁস হয়ে গেছে।
আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি ও গণমাধ্যম শুধু রাজনৈতিক শত্রুদের ‘গণশত্রু’ হিসেবে তুলে ধরেছে। আসল গণশত্রুদের এড়িয়ে ঘৃণার কামানটি শুধু তাদের দিকেই তাক করা হয়েছে। আমাদের সার্বিক অসচেতনতায় আজ ফ্রাঙ্কেনস্টাইন সৃষ্টি হচ্ছে।
জনগণের পকেট থেকে লুট করা হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা। মনে করা হয়, এই হাজার হাজার কোটি টাকা থেকে সামান্য খুদকুঁড়া ছড়ালেই তো প্রায় সবাইকে বশ করে ফেলা যায়। অনেক বিএনপি নেতা বা সমমনা ব্যক্তির বাসায় এমন পত্রিকা দেখা গেছে কিংবা এখনো দেখা যাচ্ছে, যে পত্রিকাটি বিএনপির কোমর ভাঙতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে।
যে যত বড় পরিকল্পনা করুক না কেন, সবচেয়ে বড় পরিকল্পনাকারী একজন রয়েছেন। অনেক কিছুর কল্যাণ আমরা বাহ্য দৃষ্টিতে দেখতে পাই না। কঠিন পরীক্ষার মধ্যেও অনেক কল্যাণ তিনি লুকিয়ে রাখেন।
একটি রাজনৈতিক দলের বিশেষ ভবনকে নিয়ে দেশের মিডিয়া মানুষের মনে যে ধারণা গেঁথে দিয়েছিল, তা দূর করার শক্তি বিএনপির ছিল না। আজ জনগণ পেছনের সব পরিকল্পনা বুঝতে পারছে। অনেক কিছুই পানির মতো সহজ হয়ে পড়েছে। তা আজকের এই পরিস্থিতি সৃষ্টি না হলে বোঝা যেত না।
১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের যারা রাজনৈতিকভাবে বিরোধিতা করেছিলেন, তারা তাদের এই ভূমিকাকে দেশের মানুষকে বোঝাতে চেষ্টা করেও তা পারেননি। বর্তমান সরকার ও তাদের ডন কুইক্সোটরা তাদের এ কাজটিকে যেন সহজ করে দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার, মেজর জলিল তার এক লেখায় উল্লেখ করেছিলেন, ভারতকে নিয়ে ইসলামপন্থীদের যে আশঙ্কা ছিল, তা বোধহয় পুরোপুরি অমূলক ছিল না। আজ সব কিছু দেখে মেজর জলিলের সেই কথাকে অস্বীকার করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব গেছে, সব নদী শুকিয়ে গেছে, গণতন্ত্র যা ছিল তাও গেছে, ট্রানজিট গেছে, অর্থনীতি ও রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাত থেকে চলে গেছে। আদালতের প্যাঁচ, মিডিয়ার প্যাঁচ দিয়ে মানুষের মুখ বন্ধ করে ফেলা হয়েছে।
আমি এখনো আশাবাদী। রাজনীতির প্যাঁচ, আদালতের প্যাঁচ, মিডিয়ার প্যাঁচ, সাহিত্য সংস্কৃতির প্যাঁচ ছুটিয়ে লুটেরাদের একদিন কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবেই। এই দেশে কয়েকজন মাহমুদের মুখ বন্ধ করলেও শত শত মাহমুদের জন্ম হবে। একই রক্তের, একই বর্ণের এক নজরুল উচ্চারণ করেছিলেন,
বিদ্রোহী রণ কান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না।
অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না।
মহা বিদ্রোহী রণ কান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।। ’
অত্যাচারী ও লুটেরাদের বিরুদ্ধে প্রকৃত বীর এই নজরুলরা, এই মাহমুদরা কোনো দিন শান্ত হবেন না, নিস্তেজ হবেন না, নির্জীব হবেন না। গোপাল ভাঁড়, জোকার ও ডন কুইক্সোটরা তখন পালানোর জায়গা পাবে না।