সোহাগীর তরে বিলম্বিত সোহাগ

Minar Rashid

এদেশে মূলধারার মিডিয়ার সহানুভূতি পেতে হলে ধর্ষক কিংবা ধর্ষিতাকে বিশেষ ক্যাটাগরির হওয়া অত্যাবশ্যক । ধর্ষক মওলানা গোছের হলে এদেশের মিডিয়ার পারদ সর্বোচ্চ স্থানে উঠে যায় । তবে ধর্ষক ওলামালীগের হলে এই নিয়মের সামান্য ব্যাত্যয় ঘটে । একই ভাবে ধর্ষিতা সংখ্যাগুরু না হয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের হলে সর্বোচ্চ মিডিয়া ট্রিটমেন্ট পাওয়া যায় ।

সোহাগী জাহান তনু ধর্ষণের পর খুন হয়েছেন । কিন্তু হিজাব পরিহিত থাকায় আমাদের তথাকথিত মূল ধারার মিডিয়া প্রথমে আগ্রহ দেখায় নি । সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় শুরু হলে মূল ধারার মিডিয়া এগিয়ে আসে । স্কার্ফ পরিহিতা থাকলেও নাট্যকর্মী হিসাবে পরিচয়টি এক্ষেত্রে কিছুটা সহায়তা করেছে ।

এখানে সম্ভাব্য ধর্ষকের ক্যাটাগরিও একেবারে খারাপ না । ক্যান্টনমেন্টের সুরক্ষিত জায়গায় লাশ পাওয়া গেছে । ফলে দেশের সেনাবাহিনীকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো সম্ভব হয়েছে । মওলানাদের চেয়েও এর কৌশলগত গুরুত্ব কম নহে । এই বাহিনী জনগণের মনে যে জায়গাটি করে নিয়েছিল , তা থেকে অনেকটাই সরিয়ে ফেলা সম্ভব হয়েছে । অনেক সেকুলারাইজ ও চেতনাইজ করার পরেও এই বাহিনীর উপর এখনও মনে হয় তেমন করে বিশ্বাসটি স্থাপন করা যাচ্ছে না ।

গণ জাগরণ মঞ্চের অন্যতম প্রবক্তা নাসিরুদ্দীন ইউসুফের সাম্প্রতিক মন্তব্য থেকে তেমনি মনে হচ্ছে । তিনি জানিয়েছেন , ‘ তনুর ধর্ষণ নিয়ে কথা বলতে সেনা নিবাস থেকে আমাকে নিষেধ করা হয়েছে ।’ ব্যাপারটা অনেকটা গ্রামের সেই বাতাসীর মায়ের মত । সে সারা গ্রাম ঘুরে যার সঙ্গে দেখা হচ্ছে তার কাছেই বলছে , ” আচ্ছা বলুন তো দেখি , রহিমের বউ করিমের বউয়ের মুরগীর বাচ্চাটি মেরে ফেলেছে , আমি দেখে ফেলায় আমাকে আট আনা পয়সা আর দুই মুঠ চালও দিয়েছে । আসার সময় আপন বোনের মত দুই হাত ধরে কাউকে বলতে মানা করেছে । এখন আপনিই বলেন , এই সব কথা কোন দু:খে আমি অন্যকে বলতে যাবো ?

সেনাবাহিনীর প্রতি নাসিরুদ্দীন ইউসুফদের দরদ রহিমের বউয়ের প্রতি বাতাসীর মায়ের দরদের মতই । এদেশে সেনাবাহিনী রাখাকে যারা অপ্রয়োজনীয় অপব্যয় মনে করতেন , তারাই এক এগারোর আগে আগে হঠাৎ সেনাবাহিনী প্রেমিক সেজে বসলেন। তাদেরকে দিয়ে নিজেদের কিছু কাজও করিয়ে নিলেন । এই সেনাবাহিনীকে পুরাপুরি রক্ষী বাহিনী বানানো সম্ভব হয় নি । তজ্জন্যেই নাসিরুদ্দীন ইউসুফদের বর্তমান এই হতাশাটি সৃষ্টি হতে পারে ।
সোহাগী জাহান তনুর তরে গণজাগরণ মঞ্চের এই বিলম্বিত সোহাগ অনেক প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে । শাহবাগীরা তো সরকারের খাস লোক । ‘ আমি খাড়ায়া পড়মু , আফনে বসাইয়া দিবেন ‘ সরকারের সাথে ঐ ধরনের বোঝাপড়ায় আবদ্ধ । একজন তো সাগর-রুনী কেইসে অনেক বাঘ ভাল্লুক মেরে অবশেষে সরকারের উপদেষ্টা হয়ে গেলেন !’ কাজেই ৪৮ ঘন্টার আল্টিমেটাম ৪৮ মাসেও শেষ হয় নি , আশা করা যায় ৪৮ বছরেও শেষ হবে না । সাগর-রুনীর ইস্যুটি যাতে সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে না পারে সেই কাজটিই এরা আন্জাম দিয়েছেন । একই উদ্দেশ্যে তনুকে নিয়েও এগিয়ে এসেছেন নাসিরুদ্দীন ইউসুফ ও তার মাঠের সেনাপতি ডা: ইমরান এইচ সরকার । রাজকোষ লুণ্ঠনের ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়ার মতলবটি তো রয়েছেই । তাছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইস্যুটি বড় ধরনের বিপর্যয়ের সৃষ্টি করতে পারে, এই আশংকায় আগেভাগেই এই মরদকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে ।

নাসিরুদ্দীন ইউসুফ ও ইমরান এইচ সরকার যদি তনু হত্যার প্রকৃত বিচারই চান তবে তো সরকারের দায়িত্বশীলদের একটা ফোন করলেই যথেষ্ঠ । তাদের জন্যে রাস্তায় এই ধরনের সার্কাস করার তো দরকার নেই । মূল অপরাধীকে ধরার আগেই পুরো সেনাবাহিনীকে সন্দেহের খাতায় রেখে এই ধরনের লম্ফ ঝম্ফ এই সন্দেহের উদ্রেক করেছে।

সেনাবাহিনীর কোন সদস্য বা তাদের কোন পোষ্য যদি এই কাজ করেও থাকে তাহলে তার জন্যে পুরো সেনাবাহিনীকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে কেন ? সেনাবাহিনীকে জনগণের মুখোমুখি করার এ কেমন পাঁয়তারা ?

রাজনৈতিক বিবেচনায় ইনটেইক হওয়ার কারণেই এই ধরনের ধর্ষক সহজেই ঢুকে যেতে পারে । বিদেশে শান্তি মিশন থেকেও আমাদের সেনাসদস্যদের সম্পর্কে একই ধরনের অভিযোগ এসেছে যা এর আগে কখনই শোনা যায় নি । দেশরক্ষাকারী বাহিনীর সার্বিক শৃংখলায় এই ছন্দ পতনটির জন্যে (যদি হয়ে থাকে ) দায়ী কে বা কারা ?
এর কারণগুলো খুঁজে বের করে যথাযথ ব্যবস্থা এখনই নিতে হবে । সেনাবাহিনীর ঢোল তাদের নিজেদেরকেই বাজাতে হবে , নাসিরুদ্দীন কিংবা ইমরান সরকারের হাতে দিলে সেই ঢুল ফাটাইয়া ফেলিবে ।
সোহাগী জাহান তনু ইস্যুতে নাসিরুদ্দীন ইউসুফ এবং ইমরান সরকাররা এক ঢিলে আসলে কয়টি পাখি মারতে চাচ্ছেন ? তনু হত্যার প্রতিবাদে সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এক ঘন্টা বন্ধ রাখার এই অথরিটি ইমরান সরকার কোথা থেকে পেলেন ? সরকারের পক্ষ থেকে এক ধরনের প্রশ্রয় ছাড়া এই ধরণের স্পর্ধা দেখানো কি আদৌ সম্ভব ? সরকারের প্রশ্রয়ে থেকে এই ইমরান সরকাররা কাদের বিরুদ্ধে জনগণকে ক্ষেপাতে চাচ্ছে ?

সাধারণ মানুষের স্বত:স্ফুর্ত আন্দোলনকে এরা হাইজ্যাক করে নিয়েছে । এরা মানবতাবাদি নয় , এরা হাইজ্যাকার । দেশের সব মানুষ এই খুনের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেখতে চায় । তবে মতলববাজ নাসিরুদ্দীন ইউসূফ আর ইমরান সরকারদের সার্কাস দেখতে চায় না ।

হায়েনার দল এই মিষ্টি মেয়েটিকে বাঁচতে দেয় নি ।
স্কার্ফের ভেতর বুদ্ধিদীপ্ত দুটি চোখ সারা জাতিকে বেদনার্ত করেছে, ক্রোধান্বিত করেছে । সোহাগী জাহান তনুর ছবিটি দেখে প্রাক্তন টার্কিশ প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লাহ গুলের স্ত্রীর একটি উক্তি মনে পড়েছে । মাথায় স্কার্ফ বাঁধা দেখে জনৈক ইউরোপিয়ান সাংবাদিক (তীর্যক ভাবে ) জিজ্ঞেস করেছিল , মাথায় এভাবে কাপড়ের টুকরাটি বেঁধেছো কেন ? মিসেস গুলের জবাব ছিল , মাথা বেঁধেছি সত্য কিন্তু মগজকে বেঁধে ফেলেনি ।
সোহাগী জাহান তনু তার জীবনের বিনিময়ে সেই সত্য কথাটিই যেন জানিয়ে গেছেন । মাথার স্কার্ফ তাকে আধুনিক হতে বা মননশীল হতে কোন বাঁধার সৃষ্টি করে নি । মাথায় স্কার্ফ বাঁধলেই যে মগজকে বেঁধে ফেলা হয় না -এই বোধ ও ভাবনাটি সমাজের অনেক ভেতরে পৌঁছে দিয়ে গেছেন । পরম করুণাময় এই মেয়েটিকে বেহেস্ত নসীব করুক ।