Minar Rashid
বিশেষ ধামা দিয়ে চাপা দেয়া দু’টি ঐতিহাসিক সত্য এ সপ্তাহে প্রকাশিত হয়েছে। এই পরম সত্যের একটি বলেছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট ও জাতীয় পার্টির প্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। অন্যটি বলেছেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা।
এরশাদ শেষমেশ স্বীকার করে ফেলেছেন যে, তার কোনো ছেলেসন্তান নেই! ১৯৮২ সালে বন্দুকের নল দেখিয়ে ক্ষমতা দখল করে এ দেশের বাদশাহ বনে যান তিনি। তারপর আঁটকুড়ে বাদশাহর অপবাদ ঘুচাতে সুস্থ সবল ও বয়স্কা স্ত্রীকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে সন্তান জন্মদানের নাটক সাজান। পুরো ঘটনাটিই ছিল একটি মহাপ্রতারণা। তজ্জন্য শিল্পী কামরুল হাসান তাকে যে বিশ্ববেহায়া উপাধি দিয়েছিলেন, তার যথার্থতায় অনেকে আস্থা আনবেন। তার পরম অনুগত ও ব্যক্তিত্বহীন সেই স্ত্রীই হয়েছেন আজ বিরোধীদলীয় নেত্রী। ছাই ফেলতে যেন ভাঙা কুলাই ব্যবহৃত হয়েছে।
অন্য দিকে বাংলাদেশের ২১তম বিচারপতি তার দায়িত্ব গ্রহণের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে গত মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বাণীতে বলেন, ‘কোনো কোনো বিচারপতি রায় লিখতে অস্বাভাবিক বিলম্ব করেন। আবার কেউ কেউ অবসর গ্রহণের দীর্ঘ দিন পর পর্যন্ত রায় লেখা অব্যাহত রাখেন, যা আইন ও সংবিধানপরিপন্থী।’
তার এই বক্তব্যের পর সারা দেশে তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। এর ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলসহ আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায় প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। আদালতের কাঁধে বন্দুক রেখে বর্তমান সরকার যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করেছিল তা ছিল অবৈধ। তার ফলে সরকারের বৈধতাও মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এই ঘটনার পরে আবারো প্রমাণ হলো যে, সত্য কোনো দিন চাপা থাকে না। কোনো না কোনোভাবে, কারো না কারো মুখ দিয়ে তা বেরিয়ে পড়ে। সত্যপন্থীদের জন্য এটাই পরম সান্ত্বনা।
প্রধান বিচারপতি নিঃসন্দেহে একজন প্রাজ্ঞ ব্যক্তি। বিচারপতিদের অবসরের পর রায় লেখা নিয়ে তার এই বক্তব্যটি কোনো সমাবেশে উচ্চারণ করেননি যে স্লিপ অব দ্য টাং হয়ে পড়বে। তার এ বক্তব্যটি এসেছে লিখিত আকারে। অনেক ভাবনাচিন্তার পর। তার সেই বক্তব্যটি একটি বহুল পঠিত বাংলা দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ্যে এনেছে। পত্রিকাটি প্রধান বিচারপতি কিংবা সরকারের এত বড় ক্ষতি করবে, তা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়!
অনুমিত হচ্ছে, এটা একটা সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনার ফসল। দেশী-বিদেশী চাপের মুখে সরকার সম্ভবত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে একটা নির্বাচন দিতে রাজি হয়ে পড়বে। এর ফলে উচ্ছ্বসিত বিএনপি কিংবা ২০ দলীয় জোটের কাছে সম্ভাব্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে বিশেষ ব্যক্তির একটা গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি হয়ে পড়বে। সদ্য অবসরে যাওয়া বিচারপতি মানিকের মুখে বর্তমান প্রধান বিচারপতির নিন্দা এবং এরশাদ দম্পতির সাম্প্রতিক ঝগড়া একই জায়গা ও একই ভাবনা থেকে শুরু হতে পারে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিকটি হলো, আদালত দিয়ে রাজনৈতিক সমস্যা দূর করতে গিয়ে আদালতকেও রাজনৈতিক কূটকৌশলে জড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। সদ্য অবসরে যাওয়া বিচারপতি রাজনৈতিক সমাবেশে যোগদান করেন, বিভিন্ন রাজনৈতিক বক্তব্য দেন, প্রধান বিচারপতির প্রকাশ্য সমালোচনা করেন।
গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম দীর্ঘ হবেই। কোনো শর্টকাট রাস্তা নেই। তজ্জন্য দম ফুরিয়ে গেলে চলবে না। অনেক লম্বা দম নিতে হবে। মাগো, কুত্তা সামলান আর ভিক্ষা যা দেয়ার দিয়ে দেন। বিএনপি তথা ২০ দলীয় জোটের অবস্থা এমন যেন হয়ে না পড়ে।
দেশ ও জাতির স্বার্থে তাই জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে সামনের পাঁচটি সাধারণ নির্বাচনের দাবি জানিয়েছিলাম। যারা এই জাতির প্রকৃত মঙ্গল চান ও জাতির বিবেক হিসেবে গণ্য তাদেরকে বিষয়টি নিয়ে ভেবে দেখার অনুরোধ করছি। সরকার যতই ছলচাতুরী করুক না কেন, তাদেরকে এই বাঘের পিঠ থেকে একদিন না একদিন নামতেই হবে। সেই নামার কাজটি যত তাড়াতাড়ি হবে, ততই তাদের জন্য মঙ্গলজনক হবে। জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে এবং আমাদের সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। বিশেষ করে বর্তমান সরকার গায়ের জোরে ক্ষমতা দখল ও টিকে থাকতে গিয়ে সমাজের পেশিশক্তির ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এরা জনগণের ওপর যে নির্যাতন করেছে, তাতে এদের ওপর জনগণের প্রচণ্ড ক্ষোভ জমা হয়েছে। কাজেই এই ক্ষোভ ও আক্রোশ থেকে বাঁচাতেও জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে এবং আমাদের সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া দরকার।
এই বিবেচনা থেকেই সামনের সম্ভাব্য সঙ্ঘাত থেকে প্রিয় জন্মভূমিকে রক্ষার্থে এ প্রস্তাবটি রেখেছি। এটা শুধু কোনো দলের জন্য নয়, জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে সেনাবাহিনী দিয়ে পর পর পাঁচটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে সম্ভাব্য নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতাও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। যে কারণে আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় টিকে থাকতে মরিয়া হয়ে ওঠে, প্রস্তাবিত ব্যবস্থা তা থেকে কিছুটা হলেও টেনশনমুক্ত করবে। জাতিসঙ্ঘের ব্যাপারে বিশ্বব্যাপী একটা হতাশা থাকলেও বিশ্বের দেশগুলোর ইন্টারনাল ও এক্সটারনাল সমস্যা সমাধানে এর বিকল্প এখনো তৈরি হয়নি। জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে আমাদের নিজেদের সেনাবাহিনীই মূল দায়িত্বে থাকবে বলে এটাকে অন্য দেশের হস্তক্ষেপও বলা যাবে না। নির্বাচনকালীন সময়ে সব দলের অংশগ্রহণে একটি জাতীয় সরকার ক্ষমতায় থাকতে পারে। এমনকি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে আমরা বারবার যে সঙ্কটে পড়েছি, এ ব্যবস্থায় সেই জটিলতাও থাকবে না।