যুদ্ধ-সংঘাত, অর্থনৈতিক মন্দাসহ বৈশ্বিক বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বাংলাদেশে গঠিত হওয়া নতুন সরকারের সামনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পেশাদার কূটনীতিকদের সর্বোতভাবে প্রস্তুত থাকার নির্দেশনা দিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। দূতাবাস, হাইকমিশন, স্থায়ী মিশন, কনস্যুলেট, উপ-হাইকমিশন ও সহকারী হাইকমিশন মিলে বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশের ৮১টি মিশন প্রধানকে উদ্দেশ্য করে পাঠানো অভিন্ন চিঠিতে মন্ত্রী জরুরি ওই নির্দেশনা দিয়েছেন। ২৯শে ফেব্রুয়ারি ডেটলাইনে মন্ত্রীর সই সংবলিত চিঠিটি এরইমধ্যে বেশির ভাগ মিশনে পৌঁছেছে। যার কপি হাতে পেয়েছে মানবজমিন। চিঠিতে প্রধানমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে অর্থনীতিসহ আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ৯ দফা নির্দেশনা বাস্তবায়নে দূতদের সময়োপযোগী পদক্ষেপ চেয়েছেন মন্ত্রী। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দাজনিত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় মিশনসমূহের কার্যকর ভূমিকা পালন বিষয়ক ওই চিঠিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দ্বাদশ নির্বাচন প্রশ্নে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করেন। বলেন- একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণের অভূতপূর্ব ম্যান্ডেট নিয়ে টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ ও সুযোগ্য নেতৃত্বে তারই দিক নির্দেশনা এবং ঘোষিত নির্বাচনী ইশতেহারের আলোকে অর্থনীতির গতি জোরদারকরণসহ সব ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার কার্যকর এবং সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে যাচ্ছে। চিঠিতে নতুন সরকার গঠিত হওয়ার পর (১৫ই জানুয়ারি ২০২৪) মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী যে নির্দেশনা দিয়েছেন তা উদ্ধৃত করা হয়েছে। দূতদের উদ্দেশ্যে মন্ত্রী বলেন- সুশাসন প্রতিষ্ঠা, সরকারি দপ্তরসমূহে সেবার মান বৃদ্ধি, সরকারি আয়-ব্যয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, রপ্তানি বহুমুখীকরণ, বিনিয়োগ আকর্ষণ, দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি, প্রত্যাবাসনের মাধ্যমে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান, এবং রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী আমাদের দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন।
সেই দিকনির্দেশনার আলোকে সুনির্দিষ্টভাবে ৯টি পয়েন্টে (দফা) দূতদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ওই দিকনির্দেশনা বাস্তবায়নে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং বিদেশস্থ মিশনসমূহের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
৯ দফা নির্দেশনার বিস্তারিত: পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ তার ৯ দফা নির্দেশনার সূচনাতে
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরবর্তী কূটনীতির বিষয়ে বলেন-
সংবিধান সমুন্নত রাখা এবং গণতান্ত্রিক ধারা চলমান রাখার নিমিত্তে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে দেশ এবং দেশের বাইরের সকল চাপকে অত্যন্ত সফলভাবে মোকাবিলা করেছে সরকার। পরিবর্তিত বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রণীত মূলনীতি ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’-এর আলোকে সরকার বৈদেশিক সম্পর্ককে এগিয়ে নিচ্ছে। ভূ-রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ নিয়ে বিভিন্ন দেশের ভিন্ন ভিন্ন ধারণা ও উপলব্ধি থাকতে পারে জানিয়ে চিঠিতে মন্ত্রী বলেন- সেসব উপলব্ধি এবং যৌক্তিক পরামর্শসমূহ বিবেচনায় নিয়ে পূর্ব-পশ্চিমের সকল রাষ্ট্রের সঙ্গে বিদ্যমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরও শক্তিশালী করার নিমিত্তে কাজ করবে সরকার। অর্থনৈতিক কূটনীতিতে গুরুত্বারোপের তাগিদ দিয়ে চিঠির দ্বিতীয় দফায় মন্ত্রী লিখেন- ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর রূপকল্প-২০২১ এবং পরবর্তীতে রূপকল্প-২০৪১ গ্রহণ করে। সেই রূপকল্প বাস্তবায়নে গৃহীত কার্যকর উদ্যোগের ফলেই দেশে অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। দারিদ্র্যের হার অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। তাছাড়া পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল এবং বঙ্গবন্ধু টানেলসহ বেশ কিছু মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ আজ ‘স্বল্পোন্নত দেশ’ থেকে ‘উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। মন্ত্রী বলেন, কোভিড-১৯ অতিমারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের ফলে পৃথিবীর প্রায় সকল দেশ অর্থনৈতিক মন্দা ও মূল্যস্ফীতি মোকাবিলা করছে। প্রধানমন্ত্রীর সুদৃঢ় দূরদর্শী নেতৃত্বে প্রায় সকল দেশের তুলনায় ভালো অবস্থায় থাকলেও বাংলাদেশের অর্থনীতিও নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। এ অবস্থায় রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধিতে কার্যকর ও উদ্ভাবনী উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধির মাধ্যমে অর্থনীতির গতি পুনরুদ্ধারে আমাদের মিশনসমূহ নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করতে পারে।
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পথ পরিক্রমায় পণ্য ও জনশক্তি বাজার সমপ্রসারণ ও বিকল্প আমদানি উৎসের সন্ধান ও বহুমুখীকরণ বিষয়ক তৃতীয় দফায় মন্ত্রী লিখেন- স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের স্বীকৃতি প্রাপ্তির ফলে ২০২৭ সালের পর ব্যবসা-বাণিজ্যে বিদ্যমান কিছু সুযোগ, বিশেষ করে অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা সংকুচিত হতে পারে। ফার্মাসিউটিক্যাল সহ কয়েকটি শিল্পের ক্ষেত্রে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বর্তমানে প্রাপ্ত মেধাস্বত্ব আইনের শিথিলতা অন্তত আরও ১০ বছর নিশ্চিত করা এবং পোশাক শিল্পের বর্তমান শক্তিশালী অবস্থান সুদৃঢ় করতে দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সম্ভাবনাময় নতুন বাজার অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। বিদ্যমান শ্রম বাজার সুসংহত রেখে দক্ষ জনশক্তির নতুন বাজার অন্বেষণের নিমিত্তে মনোনিবেশ করা প্রয়োজন। রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত এবং মধ্যপ্রাচ্য সংকটকে বিবেচনায় নিয়ে বিকল্প আমদানির উৎস সন্ধানে কাজ করতে হবে।
বিনিয়োগ আকৃষ্টকরণের তাগিদ দিয়ে মন্ত্রী তার চতুর্থ নির্দেশনায় দূতদের বলেন– আর্থসামাজিক খাতের সকল ক্ষেত্রে অর্জিত উন্নয়নের ধারা পরবর্তী পর্যায়ে এগিয়ে নিতে প্রয়োজন উন্নয়ন সহযোগীদের অব্যাহত অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহযোগিতা এবং অংশীদারিত্ব। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শিল্পায়ন ছড়িয়ে পড়েছে এবং সৃষ্টি হয়েছে বিপুল বিনিয়োগ সম্ভাবনা। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের মাধ্যমে দেশে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে আমাদের মিশনসমূহ অবদান রাখতে পারে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের তাগিদ এবং…:
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সর্বোচ্চ এবং সমন্বিত কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ বিষয়ক পঞ্চম দফায় মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ লিখেন- আমাদের উন্নয়ন অগ্রযাত্রার পথে রোহিঙ্গা সমস্যা একটি প্রতিবন্ধক। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি সকল দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে তুলে ধরতে হবে।
বাণিজ্য সংক্রান্ত সভা- সেমিনার ও মেলা আয়োজনের তাগিদ সংবলিত ৬ষ্ঠ দফায় তিনি লিখেন- আমি প্রতিটি মিশনকে অনুরোধ করবো পণ্য বাজার বহুমুখীকরণ ও সমপ্রসারণ এবং বিনিয়োগ আকর্ষণকে মূল উপজীব্য রেখে বছরে অন্তত তিনটি সভা/ সেমিনার/বাণিজ্য-উন্নয়ন মেলা আয়োজন করতে যেখানে বাংলাদেশ থেকেও আমাদের রপ্তানিকারক এবং ব্যবসায়ীগণ অংশগ্রহণ করবেন। এ ধরনের সভা আয়োজনের নিমিত্তে আমরা বাজেট বরাদ্দের চেষ্টা করবো। যে সব মিশন আমাদের নিজস্ব ভবনে অবস্থিত তারা মিশনের মধ্যেই এ ধরনের সভা আয়োজনের পরিকল্পনা করতে পারেন।
জন কূটনীতি বিষয়ে (৭ম দফা) পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিখেন-
অর্থনৈতিক কূটনীতিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়ার পাশাপাশি অভিবাসী বাংলাদেশিদেরকে আমাদের অর্থনীতিতে অধিকতর অবদান রাখতে উৎসাহিত করতে হবে। বিভিন্ন প্রজন্মের বাংলাদেশি অভিবাসীদের কাছ থেকে সর্বোচ্চ উপযোগটুকু আদায়ে উদ্যোগী ও কুশলী হতে হবে। স্বাগতিক সরকারের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন এবং দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বার্থ সংরক্ষণের প্রথাগত কূটনীতির পাশাপাশি বাংলাদেশকে একটা উদার, অসামপ্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরার জন্য জনকূটনীতিকেও জোরদার করার উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।
অন্যান্য বৈশ্বিক ইস্যু বিষয়ক ৮ম দফায় মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ লিখেন- কৃষির আধুনিকায়ন এবং কৃষি প্রযুক্তি হস্তান্তর ও বিনিময় আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে ভূমিকা রাখতে পারে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি, সবুজ প্রযুক্তি আনয়ন এবং জলবায়ু কূটনীতির বিষয়েও আমাদের সমন্বিত প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।
জনবল ও বাজেট যৌক্তিক পর্যায়ে সুষমীকরণ বিষয়ক ৯ম দফায় মন্ত্রী দূতদের উদ্দেশ্যে বলেন- আপনারা জানেন যে, ২০০৯ সালে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণের পূর্বে আমি পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হিসেবে কয়েক মাস দায়িত্ব পালন করেছি। কাজ করতে গিয়ে জনবল ও বাজেট স্বল্পতাসহ মিশনসমূহ যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সেগুলো সম্পর্কে আমি অবগত। বিগত ১২ বছরে নানাবিধ কারণে (মূলত কোভিড পরবর্তী বৈশ্বিক মন্দা) আমাদের কূটনীতিকদের বিভিন্ন ধরনের ভাতা বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়নি। জনবল সুষমীকরণসহ আপনাদের সকল সমস্যার যৌক্তিক পর্যায়ে সমাধানে আমরা কাজ করবো।
চিঠির উপসংহারে মন্ত্রী আরও কিছু বিষয়ের অবতারণা করেন, যাকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলছেন পেশাদাররা। তাদের মতে চিঠিতে মন্ত্রী রাষ্ট্রদূতদের কাজের প্রশংসার পাশাপাশি তাদের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসের বার্তা দিয়েছেন। পূর্ব ইউরোপের একটি দেশে দায়িত্বরত জ্যেষ্ঠ এক কূটনীতিক চিঠি পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে গতকাল সন্ধ্যায় মানবজমিনকে বলেন, ড. হাছান মাহমুদ যে বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ চিঠির ভাষাতে তার ছাপ রয়েছে। ক’দিন আগে এক কূটনীতিকের ফেসবুক স্ট্যাটাস এবং ফরেন সার্ভিসের বেশির ভাগ অফিসারের ললাটে ‘স্বাধীনতা বিরোধী’ সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়ার কথা স্মরণ করে ওই রাষ্ট্রদূত বলেন, চিঠিটির সমাপনীতে মন্ত্রী সবার প্রতি বিশ্বাস রেখেছেন, এটা অনুপ্রেরণাদায়ক। সমাপনীতে মন্ত্রীর বক্তব্যটি ছিল এমন- ‘জাতির পিতা অনুসৃত পররাষ্ট্রনীতিকে মূলমন্ত্র করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী নেতৃত্ব ও সার্বিক নির্দেশনায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ সমুন্নত রেখে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে সদা পরিবর্তনশীল বিশ্ব-ব্যবস্থার সঙ্গে তাল মেলাতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যেভাবে তার কূটনৈতিক কর্মকাণ্ড বহুমাত্রিকতায় বিস্তৃত করেছে তা প্রশংসনীয়। এরই ধারাবাহিকতায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপরোল্লিখিত সদয় নির্দেশনাসমূহ বাস্তবায়নে নিজ নিজ অবস্থান থেকে আপনাদের সুবিবেচনাপ্রসূত উদ্যোগ ও তদানুযায়ী প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণে আপনাদের প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি। আপনাদের গৃহীত সকল কার্যকর উদ্যোগের বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।’