- ড. আবদুল লতিফ মাসুম
- ০৬ নভেম্বর ২০২০
১৯৭১ সালে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। একটি নতুন দেশের নতুন নাগরিক হিসেবে সর্বত্র একটি আশা-আকাক্সক্ষার ভিত রচিত হয়। কিন্তু প্রাথমিক শাসক গোষ্ঠীর নেতৃত্ব সে আশা-আকাক্সক্ষার বিপরীতে জনগণের জন্য আরো দুর্যোগ ও দুঃখ-কষ্ট বয়ে আনে। জাতির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জনপ্রিয়তায় ব্যাপক ধস নামে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন। সেনাবাহিনীর একটি বিপথগামী অংশ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। জনগণের দুর্ভোগ এবং শাসন প্রশাসনের ব্যর্থতার সুযোগ গ্রহণ করে তারা। ১৯৭৫ সালের মধ্য আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনাবলিকে প্রকারান্তরে সেনাবাহিনী অনুমোদন দেয়। ওই দিন বেলা ১১টায় সেনাবাহিনীর সদরদফতরে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে হত্যাকারী মেজররা নিজেদেরকে সেনাবাহিনীর কাছে সমর্পণ করে। সেনাবাহিনী তাদের গৃহীত সিদ্ধান্ত এমনভাবে প্রকাশ করে যে, ‘হোয়াট হ্যাপেন্ড ইজ হ্যাপেন্ড’। জেনারেল জিয়াউর রহমান সংবিধান অনুযায়ী অগ্রসর হওয়ার তাগিদ দেন। তিনি উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের কাছে দায়িত্ব সমর্পণের পরামর্শ দেন। অবশ্য ততক্ষণে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা খন্দকার মোস্তাক আহমেদ প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার নেন। প্রাথমিক আবেগ-উত্তেজনা এবং ভাব ও বিহ্বলতা কাটিয়ে ওঠার পর, সেনাবাহিনীতে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। খুনি মেজররা বঙ্গভবনে বসে রাষ্ট্র চালাচ্ছিল। আর সিনিয়ররা সেনানিবাসে বসে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছিলেন। খন্দকার মোশতাক আহমেদ মেজরদের আস্থা অর্জন করেছিলেন। সিনিয়রদের তার প্রতি দৃঢ় আনুগত্য ছিল না। খন্দকার মোশতাক মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এম এ জি ওসমানীকে প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা নিয়োগ করলে স্বস্তির আশাবাদ সৃষ্টি হয়। কিন্তু উভয় পক্ষই তাকে যেমনি বিশ্বাস করছিল, তেমনি অবিশ্বাস করছিল। উল্লেখ্য, তত দিনে সেনাপ্রধান কে এম শফিউল্লাহ রাষ্ট্রদূতের চাকরি নিয়ে লন্ডনে পাড়ি জমান এবং জেনারেল জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান পদে অধিষ্ঠিত হন। জিয়া তার স্বভাব সুলভ কুশলতা এবং ভারসাম্যপূর্ণভাবে সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ করছিলেন। জিয়ারপ্রতি মেজরদের আস্থায় ঘাটতি না থাকলেও সিনিয়ররা ক্রমে হতাশ হয়ে পড়েন। ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় পদাধিকারী খালেদ মোশাররফ এবং ঢাকা ব্রিগেড প্রধান কর্নেল সাফায়াত জামিল দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার পক্ষপাতি ছিলেন। বিশেষ করে কর্নেল সাফায়াত জামিল ‘হট হেডেড’ বলে পরিচিত ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর এই দু’জন মুক্তিযোদ্ধা অফিসার জিয়াউর রহমানের কমান্ড অস্বীকার করেন। তারা পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটান। জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করেন। খালেদ মোশাররফ নিজেকে সেনাবাহিনী প্রধান ঘোষণা করেন। তারা খন্দকার মোস্তাকের পরিবর্তে প্রধান বিচারপতি এএসএম সায়েমকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করেন। তিনটি প্রেক্ষাপটে এ পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করা যায়।
সেনানিবাস পরিস্থিতি
সেখানে জাসদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা গোপনে কার্যক্রম পরিচালনা করছিল। একটি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের আশায় কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে তারা গোপনে কর্মরত ছিল। ৩ নভেম্বরের সামরিক অভ্যুত্থান সেনা ছাউনিতে এক উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব একটি আত্মঘাতী যুদ্ধের আশঙ্কা সৃষ্টি করে। সেনাবাহিনীর রাজনীতি সচেতন অংশ বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার মাধ্যমে কর্নেল তাহেরের কাছে করণীয় নির্দেশনা আশা করে। কর্নেল তাহের তখন নারায়ণগঞ্জে অবস্থান করছিলেন। নির্দেশনা দেয়ার জন্য ট্রেনে তিনি ঢাকা আসেন এবং এলিফ্যান্ট রোডে এক শুভাকাক্সক্ষীর বাড়িতে অবস্থান নেন। তিনি এ পরিস্থিতিকে কাক্সিক্ষত বিপ্লবের জন্য মাহেন্দ্রক্ষণ মনে করেন। কিন্তু তার জনবল এবং কাঠামো বিপ্লব কার্যকর করার জন্য যথেষ্ট ছিল না। তাই তিনি জিয়াউর রহমানের বন্দিদশা, স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে তার ইমেজ এবং সৈনিকদের মধ্যে তার সদ্ব্যবহারের সুনাম- ব্যবহার করার কৌশল নেন। জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করার জন্য বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার কিছু সৈনিককে পৃথকভাবে দায়িত্ব দেয়া হয়। নির্দেশ ছিল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে ঢাকায় এনে জিম্মি হিসেবে ব্যবহার করা হবে। কিন্তু জিয়াকে মুক্ত করার জন্য বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার লোকেরা যখন অগ্রসর হন, তখন উপস্থিত শতশত সৈনিক তাদের অনুগমন করে। সৈনিকরা জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে স্লোগান, আনন্দ-উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে করতে তাকে কাঁধে বহন করে ২২ বেঙ্গল রেজিমেন্টে নিয়ে আসেন। ফলে কর্নেল তাহেরের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়। কর্নেল তাহের এলিফ্যান্ট রোডের বাসার বারান্দায় অধীর আগ্রহে জিয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার লোকেরা যখন খালি হাতে এলিফ্যান্ট রোডে পৌঁছে তখন কর্নেল তাহের তার স্বভাবসুলভ গালমন্দ করে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থাকে ধিক্কার জানান। পরে তারা আরেকবার চেষ্টা চালায় জিয়াউর রহমানকে নিয়ে আসার জন্য। ২২ বেঙ্গলে গিয়ে তারা জিয়াউর রহমানকে বলেন, কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে আপনি মুক্ত হয়েছেন। চলুন তার সাথে দেখা করে আসবেন। ধীরস্থির অথচ দৃঢ়চরিত্রের অধিকারী জিয়াউর রহমান ততক্ষণে অনেক কিছু আঁচ করতে পেরেছেন। নাটকীয় কায়দায় তিনি বললেন, ‘কর্নেল তাহের তোমাদের নেতা এবং আমারও নেতা। একদিন তাকে এই সেনানিবাস ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল। তাকে আবার এখানে নিয়ে আসো। তিনি এখান থেকেই বিপ্লবের নেতৃত্ব দেবেন। পরে কর্নেল তাহের ২২ ইস্ট বেঙ্গলে চলে আসেন। এ সময় জিয়াউর রহমান কর্নেল তাহেরের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। একটি বর্ণনায় বলা হয়েছে জিয়াকে ফুলের মালা পরিয়ে দিতে চাইলে জিয়া নিজে তা কর্নেল তাহেরের গলায় পরিয়ে দেন এবং বলেন, এটা তাহের ভাইকেই শোভা পায়। কর্নেল তাহের ক্রমে উপলব্ধি করতে থাকেন, তার পায়ের নিচের মাটি আর নেই। তাহেরের লোকেরা জিয়াউর রহমানকে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেয়ার জন্য রেডিও অফিসে নিয়ে আসার জন্য আরেকবার শেষ চেষ্টা চালায়। ঢাকা ব্রিগেডের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি কর্নেল আমিনুল হক মতলব বুঝতে পেরে একটি রেকর্ডিং ইউনিট ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে আসার জন্য নির্দেশ দেন। সর্বশেষ সমাপনী ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জুবায়ের। তিনি তার আত্মজীবনীমূলক ‘আমার জীবন আমার যুদ্ধ’ গ্রন্থে বলেন, ‘৭ নভেম্বর সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতি সায়েম যখন বেতার ভাষণ দেন তখন জিয়াউর রহমান ও কর্নেল তাহের উভয়ই বেতার কেন্দ্রে উপস্থিত ছিলেন। বেতারের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কামরায় বসে জিয়ার সাথে তাহেরের কথাবার্তা হয়। তাহের জিয়াকে বলেন, বিপ্লবী সৈনিকদের কিছু দাবি আছে। জিয়া যেন তা শোনেন এবং অবিলম্বে মেনে নেন। জিয়া স্বভাবসুলভ ধীরস্থিরভাবে বলেন, তিনি একটু পরে সৈনিকদের সাথে দেখা করবেন। উল্লেখ্য, বেতারের স্টুডিওতে আসার আগেই রাষ্ট্রপতির ভাষণ রেকর্ড করা হয়েছিল, যাতে আলোচনার সময় তাহের বা জাসদের সশস্ত্র সৈনিকেরা কোনো শর্ত বা দাবি দাওয়া নিয়ে চাপ না দিতে পারে। জিয়ার এ কৌশল ম্যাজিকের মতো কাজ করেছিল’। ‘রাষ্ট্রপতির ভাষণ শেষ হওয়ার পর জিয়া খুব হালকা মেজাজে তাহেরকে নিয়ে পাশের ঘরে গেলেন। সেখানে জাসদপন্থী ২০-২৫ জন সশস্ত্র সৈনিক দাবির একটা লম্বা তালিকা নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। জিয়া ঘরে ঢুকেই সৈনিকদের সাথে হাত মেলান, কুশল জিজ্ঞাসা করেন এবং ছোট একটা টেবিলের ওপর বসে খোশ মেজাজে হেসে হেসে তাদের সাথে আলাপ জুড়ে দেন। তিনি সৈনিকদের মধ্যে একজনকে দাবি পড়ে শোনাতে বললেন। পড়া শেষ হলেই জিয়া বললেন, দাবিগুলো খুবই ন্যায্য এবং তা অবশ্যই পূরণ করা উচিত। দাবিগুলোর মধ্যে একটি ছিল জেলে আটক ও জাসদ নেতা জলিল ও রবের মুক্তি। জিয়া সাথে সাথে তাদের মুক্তির নির্দেশ দিলেন। এতে জাসদপন্থী সৈনিকদের মধ্যে যেটুকু উত্তেজনা অবশিষ্ট ছিল, তা মুহূর্তে মিলিয়ে গেল। বাকি দাবিগুলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিবেচনা করা হবে- এ আশ্বাস দিয়ে জিয়া অত্যন্ত আস্থার সাথে সৈনিকদের সাথে হাত মিলিয়ে হাসিমুখে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। (মহিউদ্দিন আহমেদ : ২০১৬:৭৬)। জুবায়ের সিদ্দিকী লিখেছেন, ‘জেনারেল জিয়ার এই তীক্ষè বুদ্ধিসম্পন্ন কৌশলের কাছে কর্নেল তাহের একেবারে পর্যুদস্ত হয়ে হতাশ এবং অত্যন্ত নিরাশ হয়ে পড়লেন। আরো একটি সিগারেট ধরিয়ে পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালে জমে ওঠা ফোঁটা ফোঁটা ঘাম মুছতে মুছতে পাশেই রাখা ক্র্যাচের মতো লাঠিটা নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলেন। কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে জাসদপন্থীদের সিপাহি বিপ্লবের ফলাফলকে নিজেদের পক্ষে নেয়ার সর্বশেষ আশাটুকুও যেন কর্পূরের মতো উবে গেল। টু ফিল্ডের সৈনিকেরা চেয়ে চেয়ে দেখতে থাকল, যতক্ষণ না লাঠিতে ভর দিয়ে কর্নেল তাহের তাদের দৃষ্টি-সীমানা ছাড়িয়ে গেলেন।’ এসব হতাশা ও ব্যর্থতার পরও তাহেরপন্থীরা মরণকামড় দেয়। ৬ নভেম্বর ১৯৭৫ তারা ভারতীয় হাইকমিশনার সমর সেনকে অপহরণের চেষ্টা করে। সেনা অফিসারদের হত্যা এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অভিযোগে পরবর্তীকালে কর্নেল তাহেরের বিরুদ্ধে সামরিক আদালতে অভিযোগ দায়ের করা হয়। তিনি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন।
রাজনৈতিক পরিস্থিতি
১৯৭৫ সালের নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বুঝতে হলে মধ্য আগস্ট পরবর্তী ঘটনাবলিতে ফিরে যেতে হয়। সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বের কথা আগেই বলা হয়েছে। আর একটি অপ্রকাশিত দ্বন্দ্ব ছিল দলীয় বিরোধ। আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিক ক্ষমতার ভারসাম্য ভারতের বিপরীতে প্রবাহিত হচ্ছিল। ভারত-বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমীকরণ পাক-মার্কিন বলয়কে শক্তিশালী করেছিল। ভারত সার্বক্ষণিকভাবে বাংলাদেশ পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছিল। খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানে সরাসরি ভারতীয় ইন্ধন ছিল এ রকম কোনো প্রামাণ্য দলিল নেই। ভারতের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক তৎপরতা দিয়েও এটা প্রমাণ করা সহজ হবে না। ৪ নভেম্বর যখন তার বৃদ্ধা মা এবং ভাই বঙ্গবন্ধুর শোক প্রকাশে মিছিলে অংশ নেন, তখনই খালেদ মোশাররফের রাজনৈতিক ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায়। খালেদ নিজে তার মাকে তার পরিণতির কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। যা হোক, তখন বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব তুঙ্গে এবং ঘটনাচক্রে সেনাবাহিনীতে তার অবস্থান আওয়ামী লীগের অনুকূলে হিসাব করা হয়। সেনানিবাসে সাধারণ সৈনিক থেকে কে এম শফিউল্লাহ পর্যন্ত অর্থাৎ সেনাপ্রধান পর্যন্ত একটি প্রচ্ছন্ন ভারতবিরোধী মনোভাব বজায় ছিল। ৪ নভেম্বরের মিছিল ভারতবিরোধী মনোভাবে ঘৃতাহতির কাজ করে। কর্নেল তাহের এ সস্তা ভারতবিরোধী সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগান এবং তাদের কথিত বিপ্লবে অংশীদার হওয়ার জন্য সাধারণ সৈনিকদের আহ্বান জানান। সাধারণ সৈনিকেরা গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা এবং প্রচণ্ড ভারতবিরোধী মনোভাবের কারণে তাহের বাহিনী সঞ্চারিত বিপ্লবে যোগদান করেন। পূর্ব-পরিকল্পনা মোতাবেক ৬ নভেম্বর দিবাগত রাত ‘জিরো আওয়ারে’ গুলিবর্ষণের মাধ্যমে বিপ্লবের সূচনা করা হয়। শহরমুখী ট্রাকগুলোতে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার লোকদেরকে গাইড হিসেবে প্রদান করা হয়। বিস্ময়ের ব্যাপার যে স্লোগান দিতে বারণ ছিল সেই স্লোগান মুখে মুখে প্রবলভাবে উচ্চারিত হয়। এই নিবন্ধকার ব্যক্তিগতভাবে সেই মিছিলের ঘনঘটা এবং জনগণের উল্লাস প্রত্যক্ষ করেন। সৈনিকরা ‘নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবার’ স্লোগান দেয়। খন্দকার মোস্তাকের ছবি বহন করে তাকে প্রেসিডেন্ট পদে পুনঃঅধিষ্ঠানের আহ্বান জানান। তবে মজার ব্যাপার এই যে, খালেদ মোশাররফ নিজেই খন্দকার মোস্তাকের পক্ষে দাঁড়ান। তিনি তাকে প্রেসিডেন্ট পদে অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। কিন্তু রাজনীতির চতুর্মুখী সমীকরণে খন্দকার মোস্তাক আহমেদ পরাজিত হন।
অতীত ইতিহাস ও বর্তমানের শিক্ষা
৭ নভেম্বর ’৭৫ পরবর্তী অধ্যায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রজীবনে অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সামরিক বাহিনী এবং গণতন্ত্রকে একে অপরের পরিপূরক মনে না করে এর বিপরীত মনে করা হয়। পৃথিবীর সামরিক বাহিনীর রাজনীতি ইতিহাস এর সাক্ষ্য দেয়। কিন্তু জিয়াউর রহমানের ক্ষেত্রে এটা একটি বিরল, ব্যতিক্রমধর্মী এবং অভূতপূর্ব ঘটনা যে, তিনি আওয়ামী লীগ প্রবর্তিত একদলীয় বাকশালের পরিবর্তে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। তার আর একটি অনবদ্য অবদান কৃত্রিম বিভাজনে বিভক্ত, রাষ্ট্র ও সমাজে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা। জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠিত এই দুটো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গণতন্ত্র ও জাতীয় ঐক্য আজ বিপন্ন। ৭ নভেম্বরের মূল চেতনা ছিল জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা। আজ ক্রান্তিলগ্নে জাতীয় নেতারা নতুন করে জাতীয় ঐক্যের লক্ষ্যে যে আন্দোলন পরিচালনা করছেন, তা ৭ নভেম্বরের চেতনার পরিপূরক। এ চেতনা ও প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়া নাগরিক সাধারণের অবশ্য কর্তব্য।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]