৭৮৫৩ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের তথ্য গোপন

৭৮৫৩ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের তথ্য গোপন

প্রকৃত তথ্য আড়াল করে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের ২০২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করার সুযোগ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকটির প্রকৃত খেলাপি ঋণ ৯ হাজার ৫৬৯ কোটি টাকা হলেও দেখানো হয়েছে মাত্র এক হাজার ৭১৬ কোটি টাকা। এর মানে, গোপন করা হয়েছে ৭ হাজার ৮৫৩ কোটি টাকার খেলাপির তথ্য।

এ ছাড়া ৯ হাজার ২৮১ কোটি টাকার নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) রাখার কথা থাকলেও রেখেছে এক হাজার ১৫৩ কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে আড়াল করা হয়েছে ৮ হাজার ১২৮ কোটি টাকার প্রভিশন। এভাবে প্রকৃত তথ্য আড়াল করে ব্যাংকটি ২০২৩ সালের জন্য ১০ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছে, যার ৫ শতাংশ ছিল নগদ ও ৫ শতাংশ স্টক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সদ্য পদত্যাগী গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার এবং দুর্নীতির অভিযোগে কর্মকর্তাদের রোষানলে পড়া ডেপুটি গভর্নর খুরশীদ আলম এ সুযোগ করে দিয়েছেন বলে জানা গেছে। তবে খুরশীদ আলম সমকালের কাছে আর্থিক সুবিধা নেওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, প্রতিটি ব্যাংকের বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করার আগে প্রধান কার্যালয়সহ বড় শাখাগুলোর খেলাপি ঋণ ও প্রভিশনের তথ্য যাচাই করা হয়। এসআইবিএলের ২০২৩ সালভিত্তিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করার আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিনিধি দল সরেজমিন ৫টি শাখা এবং দৈব চয়ন ভিত্তিতে ৫টি শাখার অফসাইট প্রতিবেদনের আলোকে রিপোর্ট প্রস্তুত করে। সে অনুযায়ী ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৯ হাজার ৫৬৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ঋণের বিপরীতে খেলাপি ৯ হাজার ২৪২ কোটি টাকা। আর অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের ৩২৭ কোটি টাকা খেলাপি। এ অনুযায়ী ব্যাংকটির দেশীয় ঋণের বিপরীতে প্রভিশন রাখার কথা ৭ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। এ ছাড়া আদালতের স্থগিতাদেশ থাকা ঋণের বিপরীতে এক হাজার ৭০৪ কোটি টাকা, অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের ঋণের বিপরীতে ১২৮ কোটি এবং অন্যান্য সম্পদের বিপরীতে ২৬ কোটি টাকা। তবে পরিদর্শন উঠে আসা এ তথ্য কাটাছেঁড়া করেন দায়িত্বপ্রাপ্ত ডেপুটি গভর্নর খুরশীদ আলম। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ধমক দিয়ে ব্যাংকের দেওয়া তথ্যের আলোকে মাত্র এক হাজার ৭১৬ কোটি টাকার খেলাপি এবং এক হাজার ১৫৩ কোটি টাকা প্রভিশন দেখানোর নির্দেশ দেন। পরিদর্শন-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বিষয়টি নিয়ে বিভিন্নভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলে গভর্নরের রেফারেন্সে ১০ শতাংশ লভ্যাংশ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।

পরিদর্শন-সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা এসআইবিএলের এ ঘটনা তুলে ধরে নিজের ফেসবুক পেজে একটি স্ট্যাটাস দেন। সেখানে তিনি লেখেন, ‘পরিদর্শন বিভাগে আসার পর বিরাট এক ধাক্কা খেতে হলো। আমাদের বের করা ৮ হাজার কোটি টাকার অনিয়ম মাত্র ৫০ কোটিতে নিয়ে আসতে হলো। আমি নির্বাহী পরিচালক, পরিচালক ও অতিরিক্ত পরিচালকদের জানাই– এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তারাও এটা ছাড় দিতে রাজি ছিলেন না। তবে আমাদের পরিদর্শন বিভাগের ডেপুটি গভর্নর খুরশীদ আলম আমাদের সবাইকে ডেকে নিয়ে বাধ্য করলেন। বাধ্য করলেন উক্ত অনিয়ম করতে। বললেন, যেভাবেই হোক সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে ১০ শতাংশ লভ্যাংশ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তাতে অনিয়মের ফিগারটা মাত্র ৫০ কোটিতে চলে আসে। আমরা বললাম, বিষয়টি গভর্নরকে ইনফর্ম করা দরকার। উনি বললেন, গভর্নরকে তিনি মৌখিকভাবে জানাবেন। পরবর্তী সময়ে শুনলাম, গভর্নরও এতে সায় দিয়েছিলেন। তখন থেকে আমি আর বুক ফুলিয়ে বলতে পারি না– আমি কোনো অন্যায় নোটে সাইন করি না।’

৭ কোটি টাকা ঘুষ নেওয়ার বিনিময়ে এ রকম সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে খুরশীদ আলম গতকাল টেলিফোনে সমকালকে বলেন, ‘আমার ঠিকভাবে মনে পড়ছে না। তবে নিজের নৈতিকতার দিক থেকে এটা প্রশ্নই আসে না। আজ পর্যন্ত এক কাপ চাও কেউ খাওয়াতে পারেনি।’ এত বড় ঘটনা এত দ্রুত ভুলে গেলেন– এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘অফিসে গিয়ে ফাইলটা দেখব। তবে আমার এখন মনে পড়ছে না। ৬১টি ব্যাংকের দায়িত্ব নিয়ে আমি অনেক চাপে ছিলাম। ডেপুটি গভর্নর হওয়ার পর ১৪টি বিভাগের দায়িত্ব নিয়ে আমি অনেক চাপে ছিলাম।’ তিনি বলেন, ‘আমি যখন যেখানে ছিলাম কাজ করেছি সৎভাবে। ফাইল দেওয়ার পর আমি বলতে পারব, কেন অনিয়ম হয়েছে, কেন হয়েছে।’

২০১৭ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক ও একটি গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় এসআইবিএল দখল করে এস আলম গ্রুপ। এখন মালিকানা ফিরে পাওয়ার জন্য মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছেন ব্যাংকটির উদ্যোক্তা পরিচালকরা। ব্যাংকটির বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদনে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট আমানত দেখানো হয়েছে ৩৫ হাজার ৭৩৯ কোটি টাকা। আর বিনিয়োগের পরিমাণ দেখানো হয়েছে ৩৬ হাজার ৮২ কোটি টাকা। ২০১৭ সালের পর সৃষ্ট ঋণের বেশির ভাগই এস আলম গ্রুপ নিয়েছে বলে কর্মকর্তাদের ধারণা।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নরদের দুর্নীতিবাজ আখ্যা দিয়ে গত বুধবার নজিরবিহীন বিক্ষোভ করেন কর্মকর্তারা। নামে-বেনামে এস আলম গ্রুপসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে অনৈতিকভাবে হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ, অর্থ পাচারে সহায়তা, বেআইনিভাবে ব্যাংক দখলের সুযোগসহ বিভিন্ন জালিয়াতিতে সহায়তার জন্য নজিরবিহীন ওই বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়।

কর্মকর্তারা চার ডেপুটি গভর্নর কাজী ছাইদুর রহমান, নুরুন নাহার, খুরশীদ আলম ও ড. মো. হাবিবুর রহমান এবং ডেপুটি গভর্নর পদমর্যাদার বিএফআইইউ-প্রধান মাসুদ বিশ্বাসের পদত্যাগ দাবি করেন। বিক্ষোভের মুখে বুধবার তারা ব্যাংক ছাড়তে বাধ্য হন। তবে গতকাল অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক আদেশে এসব কর্মকর্তাকে আবার ব্যাংকে ফিরতে বলা হয়েছে। আজ তারা আবার অফিস করতে পারেন। অবশ্য দ্রুততম সময়ে এসব কর্মকর্তাকে বাদ দিয়ে নতুন ডেপুটি গভর্নর নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে বলে জানা গেছে। ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলা ধরে রাখতে তাদের ডাকা হয়েছে।

samakal