৫৩ নারী শ্রমিকের লাশ: মাননীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রীকে একটি খোলা চিঠি

৫৩ নারী শ্রমিকের লাশ: মাননীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রীকে একটি খোলা চিঠি

শরীফ আস্-সাবের  17 November 2019

মাননীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রী, আপনি কি জানেন এই দূর্মূল্যের বাজারে আপনার জীবনের মূল্য কত? প্রশ্নটা শুনে আপনি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যেতে পারেন। আলু পেয়াজের বাজারদর হলে এক কথা। বাড়ি, গাড়ি গয়নাগাটি হলেও হুট করে একটা উত্তর হযতো দেয়া চলে। কিন্তু একটা জীবনের মূল্য কত হতে পারে, তা হয়তো বিশেষ গুরুত্বসহ ভেবে দেখেন নি কখনো। আর নিজের জীবন? কঠিন প্রশ্ন। আমিও আপনার চেয়ে আলাদা নই। আমারও এ বিষয়ে বিশেষ কোন ধারণা নেই, জানা নেই কোন সদুত্তর।

তবে, অতি সম্প্রতি সৌদী আরব থেকে ৫৩ জন বাংলাদেশী মহিলা শ্রমিকের লাশ হয়ে দেশে ফেরাকে আপনি ‘নগন্য’ ঠাউর করেছেন। তাই আজ হঠাৎ জানতে ইচ্ছা হলো, এই হতভাগ্য নারীদের জীবনের মূল্য কতটুকু, সেই সাথে আমার-আপনার জীবনের মূল্যইবা কত? জানতে ইচ্ছে হলো, তারকাটায় ঝুলে থাকা ফেলানীর জীবনের মূল্য কত ছিল? জানতে ইচ্ছা হলো আমাদের অহংকার শহীদ নূর হোসেন, কুমিল্লার কিশোরী তনু, মেধাবী আবরার, সাংবাদিক সাগর-রুনীর জীবনের মূল্য কত?  বাসের চাকায় পিস্ট হয়ে প্রতিদিন লাশ হয়ে যাওয়া জীবনের মূল্যইবা কত হতে পারে? একই সাথে জানতে ইচ্ছে করে, আপনার মত ধোপদুরস্ত মন্ত্রী, আমলা কিংবা সমাজপতিদের  জীবনের মূল্য কতটুকু বেশী?

মাননীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রী, ৫৩ জন নিরীহ, নিরপরাধ মহিলার লাশ আপনার কাছে নগন্য মনে হয়, মধ্যপ্রাচ্যে  হাজার হাজার বাংলাদেশী মহিলার নিয়মিত দৈহিক ও  মানসিক নির্যাতনকে আপনি বিচ্ছিন্ন ঘটনা জ্ঞান করেন। প্রশ্ন করতে পারি কি, আপনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী না হয়ে সিলেটের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কোন এক কন্যাদায়গ্রস্থ গরীব কৃষক হলে এ বিষয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কি হতো। এই হতভাগ্য নারীদের কেউ যদি আপনার বোন, কন্যা কিংবা স্ত্রী হতো আপনার প্রতিক্রিয়া কি অন্যরকম হতে পারতো?

জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার আগে জীবনের মূল্যটা খানিকটা হলেও উপলব্ধি করা জরুরী নয় কি? আমার কাছে, দেশের আপামর জনতার কাছে, প্রতিটি জীবনই মূল্যবান। দেশী কিংবা বিদেশী মুদ্রায় এর কোন দাম বেঁধে দেয়া যাবে না। তবে, নিজের কাছে নিজের জীবন সব চাইতে বেশী গুরুত্ব বহন করে। নোবেলজয়ী সাহিত্যিক আলেকজান্ডার সলঝেনিৎসিন নি:সঙ্গ কারাবাসে জীবনের মূল্য ও তাৎপর্য সন্ধান করতে গিয়ে জেনেছিলেন, “each of us is a center of the universe” অর্থাৎ, আমাদের প্রত্যেকেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। আমার কাছে আমিই সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ এবং আমি  হারিয়ে গেলে আমার বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তার অস্তিত্ব হারাবে।  লাশ হয়ে যাওয়া এই প্রতিটি নারীও একেকটি মহাবিশ্বের  কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন যাঁকে ভর করে ঘুরছিল তাঁর মা, বাবা, স্বামী সন্তান, ভাই বোন, বন্ধু বান্ধব, আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী ও সমাজ। লাশ হয়ে ফিরে আসা প্রতিটি নারীর  বিশ্বব্রহ্মাণ্ড আজ হয়েছে কেন্দ্রহীন আর তার নিজস্ব গ্রহ নক্ষত্রমালা কক্ষচ্যুত হয়ে ছিটকে বেড়িয়ে গেছে অচিন, আধার, অনিশ্চিত  গন্তব্যে। আমি কিংবা আপনি চলে গেলেও আমার-আপনার মহাবিশ্ব একই ভাবে তার কেন্দ্র হারাবে, গ্রহ নক্ষত্র হারিয়ে আমরাও  হয়ে যাবো ‘nobody’, মূল্যহীন!

মাননীয় মন্ত্রী, আবারো বলছি, প্রতিটি জীবনই অমূল্য। কে গৃহকর্মী, পথশিশু, কে সাহেব, মোসাহেব, ধনী কিংবা দরীদ্র তা দিয়ে জীবনের মূল্য নির্ধারিত  হয় না। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, রাষ্ট্রের কাছে প্রতিটি নাগরিক সমমর্যাদার অধিকারী এবং তাঁদের প্রত্যেকের “মৌলিক মানবাধিকার” নিশ্চিত করা রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতারই অপরিহার্য অংশ।  দেশের মন্ত্রী হিসাবে, জনগনের সেবক হিসাবে, আপনার কাছে তাই সবিনয় অনুরোধ, জীবনের নিরিখে জীবনকে উপলব্ধি করুন এবং অবিলম্বে মধ্যপ্রাচ্যে নারী শ্রমিক রপ্তানী বন্ধ করুন। সেই সাথে হতভাগ্য, অসহায় নারীদের অন্যায় নিপিড়নের বিরুদ্ধ ব্যবস্থা নিন, নিহত ও ক্ষতিগ্রস্ত নারী শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করুন এবং মধ্যপ্রাচ্য থেকে সকল নারী শ্রমিককে সত্বর দেশে ফিরিয়ে আনুন ।

———

ড. শরীফ আস্-সাবের অস্ট্রেলিয়ার আরএমআইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক বানিজ্য ও সুশাসন বিষয়ে গবেষনা ও অধ্যাপনা করেন।