৫ই মে বাংলাদেশে বেশ নীরবেই পার হয়ে গেল।

 

by Farhad Mazhar    8 May 2022
শাপলা হত্যাযজ্ঞ স্মৃতি থেকে মুছে দেবার প্রক্রিয়া প্রবল ভাবেই জারি আছে। এমনকি ইসলামপন্থিদের মধ্যেও। হয়তো ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার সঙ্গে অধিকাংশেরই সখ্যতা বেড়েছে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে ইসলামপন্থি রাজনীতির নৈতিক ও কৌশলগত দুর্বলতা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। একই ভাবে শাহবাগে যারা মোটামুটি একটা লিবারেল কিম্বা বামপন্থি তাড়নায় যোগ দিয়েছেন এবং নিজেদের ফ্যাসিস্ট নন বলে প্রাণপণ দাবি করেন তাদের মধ্যে সমাজ ও ইতিহাস বোঝাবুঝির প্রকট সমস্যাও তাদের সাম্প্রতিক লেখালিখিতে প্রকট ভাবে বেরিয়ে পড়ছে।
শাহবাগের বিরোধিতা করবার কারণ শুধু ফ্যাসিজম বা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরোধিতার জন্য নয়। শাহবাগ একই সঙ্গে ছিল দিল্লীর প্রকল্প। যারা তা মনে রাখেন নি তাদের মনে করিয়ে দেবার জন্য টাইমস অব ইন্ডিয়ার ইন্দ্রাণী বাগচির একটি প্রতিবেদনের লিংক দিচ্ছি। লিংকটির শিরোনাম খেয়াল করুন: Protesters at Shahbagh in Bangladesh backed by India । ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশংকর মেনন শাহবাগ সমর্থন করছেন, অথচ এটা বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার। এছাড়া দিল্লী আর কি কি করেছে সেটা নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে প্রকাশিত হবে। শুধু শিবশংকর মেনন নন, ভারতের পরররাষ্ট্র মন্ত্রী সালমান খুরশিদও শাহবাগ আন্দোলন সমর্থন করেছেন। দিল্লীর ইসলাম নির্মূল ও উপমহাদেশ থেকে মুসলমান বিতাড়নের রাজনীতি, বাংলাদেশে দিল্লির আগ্রাসন এবং বাংলাদেশের পরাধীনতা দীর্ঘস্থায়ী করবার রাজনীতি থেকে শাহবাগকে আলাদা করা যায় না।
এরপর  নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশে আসা, বায়তুল মোকাররমের ভেতরে ঢুকে মুসল্লিদের হামলা ও হত্যাযজ্ঞ এই রাজনীতিরই ধারাবাহিকতা। ফলে যারা শাহবাগের বিরোধিতা করেছেন তাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা উপমহাদেশের রাজনৈতিক টানাপোড়েনকে দুরদর্শী অবস্থান থেকে বিবেচনায় নিয়ে বিরোধিতা করেছেন। বিষয়টা শুধু ফ্যাসিজম প্রতিরোধ করা ছিল না, একই সঙ্গে হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসন মোকাবিলাও ছিল। এখন ইসলামপন্থিদের বড় একটি অংশ ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্ট শক্তির সমর্থন জুগিয়ে উপমহাদেশে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি ও আগ্রাসনকে দীর্ঘস্থায়ীত্ব দিচ্ছে। ফলে বিষয়টা মোটেও এতো সিম্পল ইসলাম বনাম সেকুলারিজমের মামলা নয়। কিম্বা শুধু ফ্যসিজমের পক্ষ বিপক্ষও নয়। এটা একই সঙ্গে ভূ-রাজনীতির প্রশ্নও বটে।
প্রাক্তন শাহবাগীদের অনেকের সাম্প্রতিক চিন্তা এবং উপলব্ধিকে আমি গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। তাদের চিন্তার সাম্প্রতিক রূপান্তর ইতিবাচক মনে করি। আশা করি আগামি দিনে তাঁরা বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবেন। কিন্তু শাহবাগ নিয়ে কথা বলার সময় তারা অতিমাত্রায় আবেগী, আত্মপক্ষ সমর্থনের ক্ষেত্রে কাণ্ডজ্ঞানহীন হয়ে যান। তাই অতি আবেগ ও শাহবাগের প্রতি পুরানা টানের তাড়নায় লেখেন যে শাহবাগ শাপলা, জামাত, আওয়ামী লীগ এমন নানান পক্ষ নানান রকম ‘চাণক্য নীতি’র রাজনীতি করেছেন। কিন্তু ‘চাণক্য নীতি’ কী আসলে?  কিম্বা যখন তারা বলেন সব পক্ষের ঐ সময়কার রাজনীতিতেই নানান রকম ‘টেক্সটবুক ফ্যাসিস্ট’ কিছু প্রবণতা চিহ্নিত করা যাবে।  ‘টেক্সটবুক ফ্যাসিস্ট’ কি আমি বুঝি নি, সেটা আমার অজ্ঞতা হতে পারে। তবে সুনির্দিষ্ট ভাবে বাস্তবে ফ্যাসিবাদের রূপ চেনা এবং তার বিরুদ্ধে সংরামের কর্তব্যের জায়গা থেকেই ফ্যাসিবাদকে চিনতে হবে। যেমন, ইসলাম নির্মূল রাজনীতি এবং হিন্দুত্ববাদের স্থানীয় রূপ বাঙালি জাতিবাদ (এবং তার প্রতিক্রিয়া জাত বিপরীত মূদ্রা জাতিবাদী ইসলাম), সাংবিধানিক ভাবে একজন ব্যাক্তর হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত রাখার পখে জনমত, হাতুড়ী,  ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্ট — ইত্যাদি। যখন আমরা বাস্তবে নেমে এসে কথা বলতে এখনও শিখি নি  তখন বুঝতে পারি শাহবাগ কিম্বা শাপলাকে আমরা আর্থ-সামাজিক ও ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বের জায়গায় দাঁড়িয়ে নৈর্ব্যক্তিক (objective) ভাবে পর্যালোচনা করবার সামর্থও য়াজ অবধি অর্জন করি নি। এখনও আমরা অক্ষম ও পশ্চাৎপদ। প্রবল আবেগ ও জিঘাংসার তাড়নায় তাই লেখা হয়, ‘শাহবাগীদেরকে মাহমুদুর রহমান জাহান্নামের কীটের পর্যায়ে নামাইতে চাইছিল’।
এই পোস্ট আমার লেখার দরকার ছিল না। কিন্তু  মাহমুদুর রহমান ঘৃণা বহাল রেখে শাহবাগ বা শাপলা কোনটিরই কোন প্রকার নৈর্ব্যক্তিক মূল্যায়ন অসম্ভব। মাহমুদুর রহমান ও  আমার দেশ ২০১৩ সালে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। আমি তা সমর্থন করি। মাহমুদুর রহমান ও আমার দেশ পত্রিকার সুনির্দিষ্ট রাজনীতি আছে। কিন্তু আমি দূরবর্তী পথের যাত্রী। তাঁর রাজনীতি পছন্দ না হলে মাহমুদুর রহমানকে  মোকাবেলা করতে জানতে হবে। মাহমুদুর রহমানের লেখালিখি এখন বই হিশাবে প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশে ইসলাম ও মুসলমানদের ইতিহাস সম্পর্কে তাঁর ইংরেজি বইও প্রকাশিত হয়েছে। আমার দেশ আবার লণ্ডন থেকে প্রকাশিত হচ্ছে। যদি তাঁকে কেউ তার রাজনীতির প্রতিপক্ষ মনে করেন তবে তাকে সিরিয়াসলি চিন্তার জায়গায় মোকাবিলা করতে হবে।
মাহমুদুর রহমানের সমালোচনা হোক। কিন্তু তা না করে শাহবাগীদেরকে মাহমুদুর রহমান জাহান্নামের কীটের পর্যায়ে নামাইতে চাইছিল – এই ধরণের বালখিল্য বাক্য কোন প্রজ্ঞার পরিচয় কিম্বা রাজনৈতিক গতি-প্রক্রিয়ায় সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণের পরিচয় বহন করে না।
আশা করি আমরা এই সব কাটিয়ে উঠব। এবং শাহবাগ/শাপলা বিভাজনের বাইরে বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থের জায়গায় দাঁড়িয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক ধারা গড়ে তুলব।