গতবারের মতো এবারও ঈদুল আজহায় কোরবানির পশুর চামড়ার দাম পাওয়া গেল না। গরুর চামড়া নামমাত্র মূল্যে বিক্রি হয়েছে। ছাগলের চামড়া বিনা মূল্যেও নিতে চাননি ফড়িয়ারা। ফড়িয়ারা বলছেন, স্থানীয় ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে দাম কমিয়েছেন। আর ব্যবসায়ীরা বলছেন, ট্যানারির মালিকেরা বকেয়া পরিশোধ করছেন না। সেই সঙ্গে রয়েছে লবণ ও শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির অজুহাত। চীন ছাড়া বিকল্প রপ্তানি বাজার না থাকাও বড় কারণ। নানা পক্ষের এই টানাপোড়েনের মধ্যে সরকার নির্ধারিত দামে দেশের কোথাও চামড়া বিক্রি হয়নি।
এ নিয়ে কথা হয় সাভারের চামড়া শিল্প নগরীর ট্যানারিমালিকদের সঙ্গে। তাঁরা বলছেন, বিনা মূল্যে পাওয়া বা ফেলে দেওয়া চামড়া কুড়িয়ে আনলেও তা বিক্রি করে তাঁদের লাভ হবে না। রাসায়নিক ও লবণের বাড়তি দামের কারণে চামড়া প্রক্রিয়া করতে হিমশিম খাচ্ছেন তাঁরা।
শুক্রবার (৩০ জুন) সাভারের চামড়া শিল্পের সংশ্লিষ্টরা জানান, মূলত ঈদের দিন ও ঈদের পরদিন কাঁচা চামড়াগুলো প্রবেশ করে ট্যানারিগুলোতে। দু-তিন দিন পর থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লবণ দেওয়া চামড়া আসতে শুরু করে। এ বছর কোরবানির ঈদে সাভার চামড়া শিল্প নগরীতে এক কোটি পিস চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।
গোল্ডেন লেদার ইন্ডাস্ট্রিজ নামে একটি ট্যানারিতে গিয়ে দেখা যায়, শ্রমিকেরা চামড়ার অপ্রয়োজনীয় মাংস, শিং ও লেজ কাটার কাজ করছেন। এরপর চামড়াগুলোতে লবণ লাগানো হচ্ছে।
ট্যানারিমালিক জাফর চৌধুরী বলেন, ‘মানুষ যে চামড়ার দাম না পেয়ে ফেলে দেয় আমরা ড্রেন থেকে যদি সেই চামড়াও কুড়িয়ে নিয়ে আসি, তা-ও আমাদের লাভ হবে না! কারণ চামড়ার দাম যদি হয় ১০ টাকা, সেই চামড়া প্রসেস করতে আরও ৪০ টাকার কেমিক্যাল প্রয়োজন হয়। এই কারণে চামড়া যদি আরও কম দামেও কেনা হয় বা ফ্রি পাই তা-ও লাভ নিয়ে সন্দেহ আছে।’
সবকিছুরই দাম বাড়ে, চামড়ার কমে কেন
প্রাথমিকভাবে লবণের পাশাপাশি আরও কয়েক ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার হয় চামড়ার প্রক্রিয়াকরণে। এই পণ্যগুলোর দাম বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানিয়েছেন গোল্ডেন লেদার ইন্ডাস্ট্রিজের সুপারভাইজার নূর হোসেন। তিনি বলেন, ‘এত দাম দিয়ে কেমিক্যাল কিনে কীভাবে আমরা কাজ করব? দিন দিন যদি দাম বাড়ায় কেমিক্যাল কোম্পানিগুলো তাহলে আমরা কী করতে পারি! আমরা চাই সরকার একটু এদিকেও দৃষ্টি দিক।’
এ নিয়ে কথা হয় চামড়া প্রক্রিয়াকরণে প্রয়োজনীয় রাসায়নিকের বিক্রেতাদের সঙ্গে। তাঁরা বলছেন, বহির্বিশ্বে কেমিক্যালের দাম বেড়েছে, তাই দেশে কমানোর সুযোগ নেই। সাভার চামড়া শিল্প নগরীর কেমিক্যাল ব্যবসায়ী খায়রুল বাশার সোহেল বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে কেমিক্যালের দাম বেড়েছে। ডলারের দামও বেশি। আমাদের হাতে তো কিছু নেই। গত এক বছরে কেমিক্যালের দাম বেড়েছে ৫০ শতাংশের বেশি। সরকারেরও আসলে তেমন কিছু করার নেই।’
ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘একেবারেই যে সিন্ডিকেট হয় না, তা বলব না। তবে দামের ক্ষেত্রে তা খুব একটা প্রভাব ফেলে না।’
কয়েক বছর ধরে চামড়ার ভালো দাম পাচ্ছেন না সারা দেশের বিক্রেতারা। এ প্রসঙ্গে রপ্তানিবাজার ছোট হয়ে আসার কারণও বলছেন ব্যবসায়ীরা। এত বছরেও পরিবেশবান্ধব হয়ে উঠতে পারেনি চামড়াশিল্প। কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করতে না পারায় মেলেনি ইউরোপের লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ। ফলে ইউরোপের বাজারে প্রক্রিয়াজাত চামড়া রপ্তানি করতে পারছে না বাংলাদেশ।
ট্যানারির মালিকেরা বলছেন, ২০১৭ সালের দিকে একটি প্রক্রিয়াজাত চামড়া প্রতি বর্গফুট রপ্তানি করা হতো দু-তিন ডলার। সেই চামড়া এখন চীনাদের কাছে প্রতি বর্গফুট ৭০-৮০ সেন্টে বিক্রি করতে হচ্ছে।
এর মধ্যে সরকারও চামড়ার দাম কমিয়ে নির্ধারণ করেছে। ২০১৩ সালে সরকার-নির্ধারিত দাম অনুযায়ী ঢাকায় প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত গরুর চামড়া ৮৫-৯০ টাকা, আর ঢাকার বাইরে ৭৫-৮০ টাকা দরে কেনা হয়। তখন সারা দেশে প্রতি বর্গফুট ছাগলের চামড়ার দাম ছিল ৫০-৫৫ টাকা। কিন্তু ৯ বছরের ব্যবধানে কাঁচা চামড়ার দাম কমিয়ে অর্ধেকে নিয়ে এসেছে সরকার। গত বছর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত গরুর চামড়া ঢাকায় ৪৭-৫২ টাকা ও ঢাকার বাইরে ছিল ৪০-৪৪ টাকা। আর ছাগলের চামড়া সারা দেশে প্রতি বর্গফুট ১৮-২০ টাকা ঠিক করে দেওয়া হয়। এ বছর ৫ টাকা করে বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সরকার-নির্ধারিত এই দামেও চামড়া কেনার মতো ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছে না।
এ প্রসঙ্গে ঢাকার হাজারীবাগের চামড়া ক্রেতা সুলতান লেদার গ্যালারির স্বত্বাধিকারী মোফাজ্জল ইবনে মাসুদ বলেন, ‘স্পষ্ট দুটি কারণ আছে চামড়ার দাম কমার জন্য। একটি হচ্ছে আমাদের রপ্তানি করার জায়গা হচ্ছে চায়না। আগে ইউরোপে যেত, তখন দাম বেশি পাওয়া যেত। এখন শুধু চায়না। যেই দামে চামড়া বিক্রি করা হয় তার চেয়ে বেশি খরচ হয়ে যায় চামড়া প্রসেস করতে। চামড়া যদি ইউরোপে পাঠানোর সুযোগ হয়, তাহলে আবার চামড়ার দাম বাড়বে। এ ছাড়া কেমিক্যাল ও লবণের বাড়তি দাম তো আছেই। এই দাম না কমালে ফ্রি চামড়া নিলেও লাভ নিয়ে সন্দেহ আছে। তাই সবাই চেষ্টা করে যত সম্ভব কম দামে চামড়া সংগ্রহ করতে।’
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, ‘আমাদের এ বছরের টার্গেট ১ কোটি পিস। ঈদের দিন আমরা প্রায় ৩ লাখ ২০ হাজার পিস চামড়া সংগ্রহ করেছি। এখন ট্যানারিতে সাধারণ শ্রমিকদের পাশাপাশি মৌসুমি শ্রমিকেরা কাজ করছেন। আশা করছি, আমাদের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে এবার। গতবার আমরা প্রায় ৯০ লাখ পিস চামড়া সংগ্রহ করেছিলাম।’
চামড়া শিল্প পরিবেশবান্ধব হয়ে উঠতে না পারা বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দিন দিন ট্যানারি নগরীর পরিবেশ ভালো হচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তর বেশ কিছু কারখানাকে পরিবেশ ছাড়পত্র দিয়েছে। এ ছাড়া অনেক কারখানার পরিবেশ ছাড়পত্র নবায়ন হচ্ছিল না, এখন সেগুলো নবায়ন হচ্ছে। আমাদের মূল লক্ষ্য এলডব্লিউজি সনদ। আশা করছি, দু-এক বছরের মধ্যে ২০টি ট্যানারি এই সনদ পাবে। তখন বেশি দাম পাওয়া পেলে বেশি দামে চামড়া কিনতে পারব।’