দেশে ডলার সংকট এখনও কাটেনি। এতে পণ্য আমদানিতে এলসি খোলা ও নিষ্পত্তি নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়ছেন আমদানিকারকরা। এ থেকে মুক্তি পায়নি রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনও (বিপিসি)। ডলার সংকটে জ্বালানি তেলের আমদানি মূল্য ঠিকমতো পরিশোধ করতে পারছে না সংস্থাটি। ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিপিসির বিল বকেয়া পড়েছে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলার। তবে ডলার সংকটের কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংক এলসির মূল্য পরিশোধ করতে পারছে না। এতে ঝুঁকিতে পড়েছে বিপিসির জ্বালানি তেল আমদানি।
সম্প্রতি জ্বালানি বিভাগে অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় বিপিসির বকেয়ার বিষয়টি তুলে ধরা হয়। বৈঠক সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে বিপিসির সবচেয়ে বেশি বিল পরিশোধ বকেয়া রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে। ব্যাংকটিতে ১৩২ দশমিক ২৯ মিলিয়ন ডলারের এলসি নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। এছাড়া অগ্রণী ব্যাংকে ১০৭ দশমিক ৬৫ মিলিয়ন ডলার, জনতা ব্যাংকে ৫৬ দশমিক ১৩ মিলিয়ন ডলার এবং রূপালী ব্যাংকে ১ দশমিক ২৬ মিলিয়ন ডলারের এলসি নিষ্পত্তির অপেক্ষায় তেল আমদানির বিল পরিশোধ করতে পারেনি ব্যাংকগুলো।
সূত্র জানায়, সিঙ্গাপুরভিত্তিক ভিটল এশিয়া (বি-৭) থেকে অকটেন জন্য গত ২৮ আগস্ট সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে বিপিসি ২ দশমিক ১১ ও ২৯ দশমিক ৩৯ মিলিয়ন ডলারের এলসি খোলে। নভেম্বরের ২২ ও ২৩ তারিখে দুটো এলসির পুরো অর্থ পরিশোধ করার কথা ছিল ব্যাংকের। তবে এর মধ্যে পাঁচ বারে ব্যাংকটি ২৫ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করে। ডলার সংকটের কারণে এখনও ৬ দশমিক ৫০ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে পারেনি ব্যাংকটি।
একইভাবে ভিটল (বি-১৪) এর আওতায় অকটেন আমদানির জন্য ৩২ দশমিক ৭৭ মিলিয়ন ডলারের এলসি ১২ অক্টোবর খোলা হয় একই ব্যাংকে। ৩০ অক্টোবরের তেল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানটির মূল্য পরিশোধ করার কথা ছিল। তবে এখন পর্যন্ত কোনো অর্থ পরিশোধ করতে পারেনি ব্যাংক। যার কারণে প্রতিষ্ঠানটির কাছে বিপিসির ৩২ দশমিক ৭৭ মিলিয়ন ডলার বকেয়া পড়েছে। ভিটল (ডি-২) থেকে মোগ্যাস তথা পেট্রোল আমদানির জন্য ২৪ দশমিক ৩২ মিলিয়ন ডলারের তিনটি এলসি খোলা হয়। এর মধ্যে ২৯ ও ৩০ ডিসেম্বর দুটো এলসির মূল্য পরিশোধের কথা ছিল ব্যাংকটির। তবে একটি এলসিরও মূল্য পরিশোধ করতে পারেনি। ফলে বিপিসির এই এলসিতে বকেয়া পড়েছে ১৯ দশমিক ৯৪ মিলিয়ন ডলার।
ভিটল (বি-১৩) থেকে অকটেন আমদানির জন্য জনতা ব্যাংকে ১১ অক্টোবর ৩৩ দশমিক ৩১ মিলিয়ন ডলারের দুটো এলসি খুলে বিপিসি। এর মধ্যে ২২ দশমিক ৭৭ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হয়। এখনও বকেয়া রয়েছে ১০ দশমিক ৫৪ ডলার। আর অগ্রণী ব্যাংকের মাধ্যমে ভিটল (বি-১৬) থেকে অকটেন আমদানির জন্য ৩০ দশমিক ২৭ মিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়। নির্ধারিত সময়ের পরে গিয়ে ব্যাংকটি মাত্র ৫ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করে। এখনও ২৫ দশমিক ২৭ মিলিয়ন ডলার বকেয়া রয়েছে।
একইভাবে ইন্দোনেশিয়ান কোম্পানি পিটি বুমি সিয়াক পুসাকোর (বিএসপি) বিলও বকেয়া রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের বিএসপি জি-৮ থেকে ফার্নেস অয়েল আমদানির জন্য সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে বিপিসি ১৪ দশমিক ৪৭ মিলিয়ন ডলারের এলসি খুলে, যার মূল্য পরিশোধের সময় ছিল গত ১ অক্টোবর। এর মধ্যে ৬ মিলিয়ন পরিশোধ করলেও এখনও ৮ দশমিক ৪৭ মিলিয়ন ডলার বকেয়া রয়েছে। বিএসপি জি-১১ থেকে ফার্নেস অয়েল আমদানির জন্য জনতা ব্যাংকে ১৫ দশমিক ৩৮ মিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়। নির্ধারিত সময়ের পরও ব্যাংকটি কোনো অর্থ পরিশোধ করতে পারেনি। এতে বিপিসির কাছে প্রতিষ্ঠানটির পুরো অর্থ বকেয়া রয়েছে।
একই ব্যাংকের মাধ্যমে বিএসপি জি-১৪ থেকে গ্যাস অয়েল আমদানির জন্য বিপিসি ১৩ দশমিক ০৪ মিলিয়ন ডলারের এলসি খুলে। নির্ধারিত সময়ে এই প্রতিষ্ঠানেরও কোনো অর্থ পরিশোধ করা হয়নি। ফলে পুরোই অর্থই বিপিসির কাছে বকেয়া রয়েছে। এছাড়া অগ্রণী ব্যাংকের মাধ্যমে বিএসপি জি-২ থেকে মোগ্যাস আমদানির জন্য বিপিসি থেকে ২৭ দশমিক ৭১ মিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়। ব্যাংকটি ২০ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করে। এখনও ৭ দশমিক ৭১ মিলিয়ন ডলার বকেয়া রয়েছে বিল। একই ব্যাংকের মাধ্যমে বিএসপি জি-১৪ থেকে গ্যাস অয়েল আমদানির জন্য ৩১ দশমিক ১০ মিলিয়ন ডলারের দুটো এলসি খোলা হয়। মূল্য পরিশোধের মেয়াদ শেষ হলেও এখন পর্যন্ত কোনো অর্থ পরিশোধ করতে পারেনি ব্যাংক। ফলে প্রতিষ্ঠানটির ৩১ দশমিক ১০ মিলিয়ন ডলার বিপিসির কাছে বকেয়া পড়েছে।
এছাড়া ইউনিপ্যাক সিঙ্গাপুর পিটিই লিমিটেড (ইউনিপ্যাক) এ-১৪ থেকে গ্যাস অয়েল আমদানির জন্য জনতা ব্যাংকে ৩৩ দশমিক ৬৭ মিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়। প্রতিষ্ঠানটির ২৬ দশমিক ৫০ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হয়। এখনও বকেয়া রয়েছে ৭ দশমিক ১৭ মিলিয়ন ডলার। ইউনিপ্যাক জি-১৩ প্রতিষ্ঠান থেকে গ্যাস অয়েল আমদানির জন্য ৩০ দশমিক ২৬ মিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয় রূপালী ব্যাংকে। ২৯ মিলিয়ন ডলার ব্যাংকটি পরিশোধ করলেও এখনও ১ দশমিক ২৬ মিলিয়ন ডলার বকেয়া বিপিসির।
ইনক জি-৫ ও ইনক জি-৭ থেকে গ্যাস অয়েল আমদানির জন্য অগ্রণী ও সোনালী ব্যাংকে দুটো এলসি খুলে বিপিসি। এর মধ্যে অগ্রণী ব্যাংকের মাধ্যমে ৩৪ দশমিক ৪০ মিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল। ব্যাংকটি ২০ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করলেও এখনও ১৪ দশমিক ৪০ মিলিয়ন বকেয়া রয়েছে। আর সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে খোলা হয় ৩০ দশমিক ৫৬ মিলিয়ন ডলারের এলসি। মূল্য পরিশোধের সময় শেষ হলেও কোনো অর্থ পরিশোধ করা হয়নি। একই ব্যাংকে সিঙ্গাপুরভিত্তিক পিসিএসজি জি-১ থেকে ফার্নেস অয়েল আমদানির জন্য ১৫ দশমিক ২৮ মিলিয়ন ডলারের এলসি খুলে বিপিসি। এর মধ্যে ১০ মিয়িলন ডলার পরিশোধ হলেও এখনও ৫ দশমিক ২৮ মিলিয়ন পাওনা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির।
এছাড়া জনতা ও সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে জেদ্দাভিত্তিক আইটিএফসির ঋণ পরিশোধ বাবদ বিপিসির আরও যথাক্রমে ৫৯ দশমিক ৯৩ এবং ২৫ দশমিক ৫৬ মিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়। এর মধ্যে জনতা ব্যাংক ৪৯ দশমিক ৯৩ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করে। সোনালী ব্যাংক কোনো অর্থ পরিশোধ করতে পারেনি। এ কারণে আইটিএফসির কাছে ৩৫ দশমিক ৫৬ মিলিয়ন ডলারের দেনা রয়েছে বিপিসির। অন্যদিকে মালয়েশিয়াভিত্তিক পিটিএলসিএল জি-০৮ বিপিসির কাছে পাওনা ২৯ দশমিক ১৭ মিলিয়ন ডলার, যার অর্থ পরিশোধ করার কথা অগ্রণী ব্যাংকের। আর ভারতের এনআরএলের পাওনা ৩ দশমিক ২১ মিলিয়ন। ডলার সংকটের কারণে এই এলসির অর্থ পরিশোধ করতে পারেনি সোনালী ব্যাংক।
উল্লেখ্য, ডলার সংকটে জ্বালানি তেলের বকেয়া বিল পরিশোধ করতে না পারায় গত সেপ্টেম্বরে বিপিসিকে চুক্তি অনুযায়ী শিডিউলে থাকা তেল দিতে অসম্মতি জানায় বেশ কয়েকটি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। ওই সময়ে দুটি প্রতিষ্ঠান (ভিটল এশিয়া ও ইউনিপ্যাক) সাফ জানিয়ে দেয় বকেয়া পরিশোধ ছাড়া তারা তেল দেবে না। ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিপিসির দেনা দাঁড়িয়েছিল ৪০৭ দশমিক ৪২ মিলিয়ন ডলার। এরপর কিছু বিল পরিশোধ করা হয়েছে। তবে এখনও প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলারের বিল বকেয়া রয়েছে।