২৬ মাসে রিজার্ভ কমে অর্ধেক!

করোনাকালে আমদানি হ্রাস ও রেমিট্যান্সের উচ্চ প্রবাহ বাংলাদেশের রিজার্ভের পালে বড় ধরনের হাওয়া তোলে। সে সময় তরতর করে বাড়তে থাকে রিজার্ভ। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালের আগস্টে দেশের ইতিহাসে রিজার্ভ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। তবে রিজার্ভের সেই ঊর্ধ্বমুখী চিত্র ধরে রাখতে পারেনি বাংলাদেশ। বরং গত দুই বছর ধরে রিজার্ভের নি¤œমুখী ধারা আতঙ্ক তৈরি করেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য-বিশ্লেষণে দেখা যায়, সেপ্টেম্বরে ২৬ দিনেই রিজার্ভ কমেছিল দুই বিলিয়ন ডলারের বেশি। অক্টোবরে সে ধারা কিছুটা স্তিমিত হলেও কোনো সুখবর দিতে পারছে না রিজার্ভ। বরং রিজার্ভের পতন শিগগিরই থামার সম্ভাবনা নেই বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ রক্তক্ষরণ আরও চলবে বলেই তাদের মন্তব্য। এতে আগামী জুনে গিয়ে রিজার্ভ কোথায় ঠেকবে, তা নিয়ে রীতিমতো শঙ্কিত সংশ্লিষ্টরা।

সূত্রমতে, দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রিজার্ভ ছিল ২০২১ সালের আগস্টে। সে সময় (আগস্ট শেষে) দেশে গ্রস রিজার্ভ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি। তবে ওই সময় রিজার্ভ (বিপিএম ৬) ছিল ৪০ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার।

মূলত গত জুন থেকে আইএমএফের প্রেসক্রিপশন মেনে গ্রসের পাশাপাশি ব্যালান্স অব পেমেন্ট ৬ বা বিপিএম ৬ অনুযায়ী রিজার্ভের হিসাব প্রকাশ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এক্ষেত্রে মোট (গ্রস) রিজার্ভ থেকে ইডিএফ (রপ্তানি বহুমুখীকরণ তহবিল), আইডিএফ (অবকাঠামো উন্নয়ন তহবিল) ও শ্রীলঙ্কাসহ বিভিন্ন দেশকে দেয়া ঋণ বাদ দিয়ে নেট রিজার্ভের হিসাব করা হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত বছর জুন শেষে রিজার্ভ (বিপিএম ৬) দাঁড়ায় ৩৩ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ১০ মাসে রিজার্ভ কমেছিল সাত দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলার। আগস্ট শেষে তা আরও কমে হয় ৩০ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এক বছরে রিজার্ভ কমে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে চলতি বছর জুনে রিজার্ভ কমে দাঁড়ায় ২৪ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার।

চলতি বছর আগস্ট শেষে তা আরও কমে হয়েছে ২৩ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ পরের এক বছরে রিজার্ভ কমেছে সাত দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ডলার। চলতি মাসের ২৫ অক্টোবর শেষে রিজার্ভ (বিপিএম ৬) অনুযায়ী দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলার। এ হিসাবে ২৬ মাসে রিজার্ভ কমে প্রায় অর্ধেক দাঁড়িয়েছে। তবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের বকেয়া বিল পরিশোধ করলে রিজার্ভ আরও অনেক কমে যাবে।

প্রসঙ্গত, সেপ্টেম্বর শেষে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত মেনে রিজার্ভ সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ। আইএমএফের ঋণের শর্ত অনুযায়ী, সেপ্টেম্বরে নিট রিজার্ভ ২৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার রাখার কথা ছিল। তার চেয়ে অনেক নিচে ছিল নিট রিজার্ভ। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে নিট রিজার্ভের হিসাব প্রকাশ করা হয় না। তবে অসমর্থিত সূত্রে জানা গেছে, সেপ্টেম্বর শেষে নিট রিজার্ভ ছিল ১৭ বিলিয়ন ডলারের আশপাশে।

যদিও আইএমএফের সঙ্গে চলতি মাসে অনুষ্ঠিত বৈঠকে নিট রিজার্ভ সংরক্ষণের শর্ত থেকে অব্যাহতি চেয়েছে বাংলাদেশ। এতে প্রাথমিকভাবে সম্মতি দিয়েছে ঋণদাতা সংস্থাটি। ফলে আইএমএফের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়ার বিষয়ে আশাবাদী কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

গত ৪ অক্টোবর বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন এক অনুষ্ঠানে বলেন, দেশে যে পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা ঢুকছে এবং যা বেরিয়ে যাচ্ছে, তার প্রকৃত হিসাব মিলছে না। ফলে ব্যালান্স অব পেমেন্টে বা লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি তৈরি হওয়ায় রিজার্ভ হ্রাস পাচ্ছে। এর অন্যতম কারণ ডলারের দাম। ইউএস ডলার ইনডেক্সের মান ২০২১ সালেও ১০০-এর নিচে ছিল। কিন্তু ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তা ১০০-এর ওপরে চলে যায়। এখন কিছুটা কমলেও, তা ১০০-এর ওপরে রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, লেনদেন ভারসাম্য কখনও ধনাত্মক, আবার কখনও ঋণাত্মক। কিন্তু সম্প্রতি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, এই হিসাব বেশ কিছুদিন ধরে ঋণাত্মক। তিনি বলেন, ‘এর অর্থ হলো, আমাদের জানার বাইরে কিছু একটা ঘটছে।’ বিশ্ববাজারে তেলের দাম এবং ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যাওয়ার কারণে দেশের লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি তৈরি হয়েছে। সে কারণে অর্থনীতিতে বড় প্রভাব পড়ছে। এতে যেমন বাংলাদেশি মুদ্রার বিনিময় হার কমছে, তেমনি রিজার্ভ কমে যাচ্ছে।

অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, এসব কারণে আইএমএফের বিপিএম ৬-এর সংজ্ঞা অনুসারে বাংলাদেশের নিট আন্তর্জাতিক রিজার্ভ এখন ১৮  বিলিয়ন ডলারের নিচে।

এদিকে সরকারের ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি দায় মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিনিয়ত রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে। গত অর্থবছর বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে সাড়ে ১৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিক্রি করে। তার আগের অর্থবছর সাড়ে সাত বিলিয়ন ডলার বিক্রি করে। আর চলতি অর্থবছর তিন মাসে পৌনে চার বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর শেয়ার বিজকে বলেন, বর্তমানে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স ভালো অবস্থানে নেই। নির্বাচনের আগ পর্যন্ত চাল, ডাল, তেল ইত্যাদি আমদানি করতেই হবে। এতে করে রিজার্ভের আরও রক্তক্ষরণ হবে। তাই নির্বাচনের আগে রিজার্ভ বাড়ানোর তেমন কোনো উপায় নেই।

তিনি আরও বলেন, নির্বাচনের পর সরকারের নীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে। এক্ষেত্রে ব্যাংক সুদহার ও বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার আরও বাড়াতে হবে। পাশাপাশি ডলারে আয় বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন উৎস খুঁজে বের করতে হবে।

উল্লেখ্য, দেশে গত বছরের এপ্রিল থেকে ডলারের সংকট শুরু হয়। ফলে ডলারের দাম ৮৮ টাকা থেকে বেড়ে ১১০ দশমিক ৫০ টাকা হয়েছে। তবে সরকারের বেঁধে দেয়া দামে ডলার কোথাও মিলছে না। এছাড়া ব্যাংকারদের দাবির মুখে সম্প্রতি বাড়তি দামে ডলারের অগ্রিম মূল্য নির্ধারণের সুযোগ দেয়া হয়েছে। এটি বর্তমান বিনিময় হারের চেয়ে বেশি হবে।

সূত্র : শেয়ার বিজ