২০৫১ সাল পর্যন্ত টানতে হবে ক্যাপাসিটি চার্জের বোঝা!

 

পাইপলাইনে ১৭ বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র

বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত নিয়ে গত সপ্তাহে বিদ্যুৎ বিভাগ ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে বৈঠক করেছে সফররত আইএমএফ প্রতিনিধিদল। এ সময় তারা বিদ্যুৎ খাতের বর্তমান পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশকিছু প্রশ্ন করে। সেসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছে শেয়ার বিজ। তা নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের তৃতীয় পর্ব

ইসমাইল আলী: বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য নিয়মিতই ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি)। যদিও এসব কেন্দ্রের বড় অংশই বসে থাকছে। এতে বিদ্যুৎ খাতের বোঝা হয়ে উঠেছে ক্যাপাসিটি চার্জ। তবে এ চার্জ থেকে সহজেই মুক্তি পাচ্ছে না বাংলাদেশ। বেসরকারি খাতে নতুন কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি না দিলেও আরও ২৯ বছর টানতে হবে ক্যাপাসিটি চার্জের বোঝা।

আইএমএফের এশীয় ও প্যাসিফিক বিভাগের প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বাধীন একটি প্রতিনিধিদল গত ২ নভেম্বর বিদ্যুৎ বিভাগ ও পিডিবির সঙ্গে বৈঠকে করে। এ সময় আইএমএফ প্রতিনিধিদলের প্রশ্ন ছিলÑএখন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় যে ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হচ্ছে, সেটি ২০৩০ সালে শেষ হবে কিনা? তখন পিডিবি জানায়, ‘সেটি সম্ভব নয়, কারণ নতুন নতুন বেশকিছু আইপিপি (ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) আসছে। তাদেরও ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে। এখন পর্যালোচনা করে দেখা হচ্ছে, কবে নাগাদ ক্যাপাসিটি চার্জ শেষ করা যাবে।’

আইএমএফের প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে পাইপলাইনে থাকা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর তথ্য বিশ্লেষণ করে শেয়ার বিজ। এতে দেখা যায়, বেসরকারি খাতে ৪১টি বিদ্যুৎকেন্দ্র পাইপলাইনে আছে। এছাড়া দেশীয় ও বিদেশি যৌথ বিনিয়োগে আরও ছয়টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে ১৭টি কেন্দ্রের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হবে। এসব কেন্দ্র ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে। ফলে ক্যাপাসিটি চার্জ টানতে হবে ২০৫১ সাল পর্যন্ত। আর চলমান কেন্দ্রগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ শেষ হবে ২০৪৭ সালে।

পাইপলাইনে থাকা কেন্দ্রগুলোর মধ্যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মেয়াদ ২৫ বছর। এ তালিকায় রয়েছে ভারতের আদানি, দেশীয় এস আলম, ভারত-বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগের রামপালসহ মোট সাতটি কেন্দ্র। গ্যাস বা এলএনজিভিত্তিক কেন্দ্রের মেয়াদ ধরা হয়েছে ২২ বছর। এ তালিকায় আছে ভারতের রিলায়েন্স, দেশীয় সামিট, ইউনাইটেডসহ আটটি কেন্দ্র। এর মধ্যে দুটি কেন্দ্র দ্বৈত জ্বালানিভিত্তিক তথা এলএনজি/ডিজেলচালিত। আর ফার্নেস অয়েলচালিত দুটি কেন্দ্র রয়েছে, যেগুলোর মেয়াদ ১৫ বছর। এছাড়া বেশকিছু সৌর ও বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র পাইপলাইনে আছে। তবে এগুলোর জন্য কোনো ধরনের ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে না।

তথ্যমতে, ২০১০-১১ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত ১২ বছরে পিডিবিকে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে প্রায় ৮৬ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক যুগে প্রায় তিনটি পদ্মা সেতুর নির্মাণব্যয়ের সমান অর্থ গেছে এ খাতে। যদিও বেসরকারি কেন্দ্রগুলো সক্ষমতার অর্ধেক বা তার চেয়েও কম পরিচালিত হয়। তবে চুক্তির কারণে পুরো ক্যাপাসিটি চার্জই পরিশোধ করতে হয়। এছাড়া মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে সরকারের পক্ষ থেকে চুক্তি বাতিলেরও কোনো সুযোগ নেই।

এদিকে প্রতি বছরই বাড়ছে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধের পরিমাণ। গত অর্থবছর এ খাতে পরিশোধ করা হয়েছে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছর এ খাতে ব্যয় ১৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার কথা রয়েছে। এর মূল কারণ আদানি, রামপাল ও এস আলমের বিদ্যুৎকেন্দ্র। এছাড়া আগামী কয়েক বছর এ খাতে ব্যয় বাড়বে। কারণ বড় আকারের বেশকিছু নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রের আগামী দুই বছরের মধ্যে উৎপাদন শুরুর কথা রয়েছে।

তথ্যমতে, আগামী মাসে উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে ভারতের আদানি, বাংলাদেশের এস আলম ও বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ উদ্যোগের রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র। কয়লাচালিত এ তিন বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট চলতি বছর ডিসেম্বরে চালুর কথা রয়েছে। আর দ্বিতীয় ইউনিট উৎপাদনে আসার কথা আগামী বছরের জুন-জুলাইয়ে। এসব কেন্দ্রের মেয়াদ শেষ হবে ২০৪৮ সালে। ফলে আগামী ২৫ বছর তথা ২০৪৮ সাল পর্যন্ত এ তিন বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হবে।

চলতি বছর ডিসেম্বরে বরিশালে আরও একটি কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন শুরুর কথা রয়েছে। এছাড়া পটুয়াখালীতে আরও দুটি কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশ-চীন যৌথ উদ্যোগে এ কেন্দ্র দুটি নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে পটুয়াখালী কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ২০২৪ সালে উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে, যার ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে ২০৪৯ সাল পর্যন্ত।

পটুয়াখালীর পায়রা-২ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ২০২৬ সালের এপ্রিলে উৎপাদন শুরুর কথা রয়েছে। আর ঢাকার অদূরে ওরিয়নের কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে। এ কেন্দ্র দুটির ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হবে ২০৫১ সাল পর্যন্ত।

ভারতের রিলায়েন্স, বাংলাদেশের সামিট ও ইউনিট গ্রুপ তিনটি এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে। এর মধ্যে সামিটের কেন্দ্রটি দ্বৈত জ্বালানিভিত্তিক। ২০২৩ সালে এ তিনটি কেন্দ্র উৎপাদন শুরুর কথা রয়েছে, যার ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে ২২ বছর তথা ২০৪৫ সাল পর্যন্ত। আর ইউনাইটেড পাওয়ারের এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ২০২৬ সালে উৎপাদন শুরুর কথা। এর ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে ২০৪৮ সাল পর্যন্ত।

২০২৬ সালেই উৎপাদন শুরুর কথা আনলিমা গ্রুপের এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। একই সময় গজারিয়ায় আরেকটি এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদন শুরুর কথা রয়েছে। আর কনফিডেন্স গ্রুপের এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ শেষ হওয়ার কথা ২০২৭ সালে। এ তিন বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে যথাক্রমে ২০৪৮ ও ২০৪৯ সাল পর্যন্ত।

এদিকে দেশ এনার্জি ও সিকদার গ্রুপের দুটি ফার্নেস অয়েলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদন শুরুর কথা যথাক্রমে চলতি বছরের ডিসেম্বরে ও ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে। এ দুই কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে যথাক্রমে ২০৩৭ ও ২০৩৯ সাল পর্যন্ত।