২০২৪ সালের ৫ আগস্ট: গণঅভ্যুত্থান ও নতুন ভোরের সূচনা

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক ও রক্তাক্ত দিনে পরিণত হয়। এই দিনে স্বাধীনতার পর দ্বিতীয়বারের মতো গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রায় ১৬ বছরের একনায়কতান্ত্রিক শাসনের অবসান ঘটে, যা শুরু হয়েছিল চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে এবং দ্রুতই ‘জুলাই বিপ্লব’ নামের এক পূর্ণাঙ্গ গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। একদিকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপ ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে ছাত্র-জনতা ও সাধারণ মানুষের নজিরবিহীন সম্মিলিত অংশগ্রহণে বিশাল জনস্রোতের মুখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ছোট বোন শেখ রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে ভারতে পালিয়ে যান, অন্যদিকে আন্দোলন দমনে সরকারি বাহিনীর ব্যাপক সহিংসতায় অসংখ্য নিরীহ নাগরিকের প্রাণহানিতে দিনটি একটি জাতীয় বেদনার প্রতীক হয়ে ওঠে।

ছবি: সংগৃহীত

জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের তথ্যমতে, জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত অন্তত ১,৪০০ জন নিহত এবং ২০,০০০ এর বেশি আহত হন। এই ঘটনার পর বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক অধ্যায়ের সূচনা হয় এবং সেনাবাহিনীর সহায়তায় গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

একনায়কতন্ত্রের পতন: কিভাবে ঘটল এই রূপান্তর?

স্বাধীনতার পর দীর্ঘ একনায়কতন্ত্রের ছায়ায় থাকা শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জমছিল বহু বছর ধরেই। বিশেষ করে ২০২৪ সালের জুলাইয়ে চাকরিতে কোটা সংস্কার নিয়ে শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন ছিল এই বিস্ফোরণের সূচনা বিন্দু। হাইকোর্টের রায়ে পুরনো ৫৬% কোটা পুনর্বহাল হলে তা মেধাবী শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রবল ক্ষোভের জন্ম দেয়।

আওয়ামী লীগ সরকার যখন এই ক্ষোভ দমন করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও দলের ক্যাডারদের নামিয়ে দেয়, তখনই শুরু হয় আন্দোলনের রূপান্তর। আন্দোলনটি আর শুধুমাত্র কোটা সংস্কারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, এটি পরিণত হয় একটি পূর্ণমাত্রিক গণঅভ্যুত্থানে—যা আন্দোলনকারীরা ‘জুলাই বিপ্লব’ হিসেবে অভিহিত করে।

‘৩৬ জুলাই’ ও ‘মার্চ টু ঢাকা’: প্রতিবাদের চূড়ান্ত মুহূর্ত

শেখ হাসিনার সরকার ৩ ও ৪ আগস্ট ঢাকার রাজপথে নিজেদের ‘ক্ষমতার শক্তি’ প্রদর্শন করতে গিয়ে ব্যাপক সহিংসতা চালায়। দুই দিনে সরকারি হামলায় অন্তত ১৫৯ জন নিহত হয় বলে প্রতিবেদন উঠে আসে। আন্দোলনের সমন্বয়কারীরা তখন ৬ আগস্টের পরিবর্তে ৫ আগস্টেই চূড়ান্ত কর্মসূচি এগিয়ে আনার ঘোষণা দেন।

‘জুলাই শেষ হয়নি’ এই বার্তা নিয়ে আন্দোলনকারীরা ৫ আগস্ট দিনটিকে ‘৩৬ জুলাই’ হিসেবে ঘোষণা করেন। সকাল থেকেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হাজার হাজার মানুষ ঢাকামুখী যাত্রা শুরু করেন। সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে বাধা না থাকায় এবং পুলিশ-র‍্যাবের বহু ইউনিট মাঠে কার্যত অনুপস্থিত থাকায় রাজধানী অচিরেই জনসমুদ্রে রূপ নেয়।

শাহবাগ, ফার্মগেট, ধানমন্ডি, মতিঝিল, গুলিস্তান—প্রতিটি মোড়ে লাখো মানুষ সমবেত হন। সরকারি বাহিনীর বিচ্ছিন্ন গুলিচালনা ও দমনপীড়ন ব্যর্থ হয়। দুপুরের দিকে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জাতির উদ্দেশে এক বিবৃতিতে শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিশ্চিত করেন।

শেখ হাসিনার দেশত্যাগ ও পতনের মুহূর্ত

সেই মুহূর্তেই জনতা জেগে ওঠে বিজয়ের উল্লাসে। রাজধানীর রাজপথ দখলে নেয় জনতা। হাজার হাজার মানুষ শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবন ‘গণভবনে’ প্রবেশ করে পতন উদযাপন করে। এরপরই জানা যায়, শেখ হাসিনা একটি সামরিক হেলিকপ্টারে করে ছোট বোন শেখ রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকা ছাড়েন এবং ভারতের উদ্দেশে রওনা হন।

তাকে নিয়ে যে ‘শেখ হাসিনা পালায় না’ —এই অহংকার অনেকবারই তিনি নিজে প্রকাশ করেছিলেন। এমনকি পদত্যাগের মাত্র ২ সপ্তাহ আগে, ২২ জুলাই ব্যবসায়ীদের এক বৈঠকে তিনি বলেছিলেন, ‘শেখ হাসিনা পালায় না’। কিন্তু ইতিহাস তার উল্টো সাক্ষ্য দিল।

জুলাই গণঅভ্যুত্থান: ছাত্র আন্দোলন থেকে গণবিদ্রোহ

শুরুটা ছিল চাকরির কোটাব্যবস্থার বিরুদ্ধে। কিন্তু দ্রুত তা হয়ে ওঠে দীর্ঘকালীন দমন-পীড়ন, গুম, বন্দি, দুর্নীতি, এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণের বিরুদ্ধে গণজাগরণ।

আন্দোলনের ৬ জন কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক—নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ, আসিফ মাহমুদ, নুসরাত তাবাসসুম এবং আবু বাকের মজুমদারকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তুলে নেয়, কিন্তু তা আন্দোলনের গতি থামাতে পারেনি। বরং তাদের মুক্তির দাবিতে সারা দেশে জনতা আরও উত্তাল হয়ে ওঠে।

৩ আগস্ট, মুক্তিপ্রাপ্ত নাহিদ ইসলাম শহীদ মিনারে ‘এক দফা—শেখ হাসিনার পদত্যাগ’ ঘোষণা করেন। এই আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘোষণা হিসেবে বিবেচিত হয়।

সহিংসতা ও আত্মত্যাগের করুণ চিত্র

জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের তথ্যানুসারে, জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সময়ে অন্তত এক হাজার ৪০০ জন নিহত এবং ২০ হাজারোও এর বেশি আহত হন। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, ৫ আগস্টই ছিল সবচেয়ে রক্তাক্ত দিন।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, শাহবাগ, মহাখালী, মতিঝিল ও মিরপুরে সবচেয়ে বেশি সহিংসতা হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্বিচার গুলিতে বহু শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ নিহত হন। অসংখ্য আহত ব্যক্তি চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যুবরণ করেন। এরপরও জনগণের প্রতিবাদ থামেনি।

নতুন অধ্যায়ের শুরু?

৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে শুরু হয় এক নতুন রাজনৈতিক অধ্যায়। অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয় সেনাবাহিনীর সহায়তায়। তত্ত্বাবধায়ক প্রশাসনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন ড. মুহাম্মদ ইউনুস।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here