কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ ও স্থিতি দ্রুত বাড়ছে। সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতেই এ ঋণ নেয়ার প্রবণতা বেড়েছে। এতে ২০২৩ সাল শেষে বিদেশি ঋণের স্থিতি রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছায়। এ সময় সরকারের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৬৮ বিলিয়ন ডলার। মোট বৈদেশিক ঋণ দ্রুত বাড়ায় মাথাপিছু বিদেশি ঋণও বাড়ছে। গত বছর শেষে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪০১ ডলার।
জাতিসংঘ বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থার (আঙ্কটাড) ডেটাবেজ বিশ্লেষণ করে এ চিত্র পাওয়া গেছে। গতকাল সংস্থাটির ‘এ ওয়ার্ল্ড অব ডেট: এ গ্রোয়িং বারডেন টু গ্লোবাল প্রসপারিটি’ শীর্ষক প্রতিবেদনের পাশাপাশি বিশ্বের সব দেশের সরকারের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের ডেটাবেজটি প্রকাশ করা হয়।
গত এপ্রিলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রকাশিত গ্লোবাল ইকোনমিক আউটলুক ও বিশ্বব্যাংকের তথ্য ব্যবহার করে ডেটাবেজটি প্রণয়ন করেছে আঙ্কটাড। সে ডেটাবেজ বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৩ সাল শেষে বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৮ বিলিয়ন ডলার। ২০২২ সাল শেষে এর পরিমাণ ছিল ৬২ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এক বছরে সরকারের বিদেশি ঋণ বেড়েছে ছয় বিলিয়ন বা ৬০০ কোটি ডলার।
এ বৈদেশিক ঋণের মধ্যে ৫১ দশমিক ৯ শতাংশ বহুজাতিক সংস্থা বা উৎস, ৩৭ দশমিক ৪ শতাংশ দ্বিপাক্ষিক উৎস এবং ১০ দশমিক ৭ শতাংশ বেসরকারি বিদেশি ব্যাংক বা উৎস থেকে নেয়া হয়েছে। ২০২২ সাল শেষে এ অনুপাত ছিল ৫৩ দশমিক ৪ শতাংশ বহুজাতিক সংস্থা বা উৎস, ৩৮ শতাংশ দ্বিপাক্ষিক উৎস এবং আট দশমিক ৬ শতাংশ বেসরকারি বিদেশি ব্যাংক বা উৎস থেকে নেয়া। অর্থাৎ কঠিন শর্তের ঋণ বেড়েছে গত বছর।
বর্তমানে বৈদেশিক ঋণ দাঁড়িয়েছে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ।
আর বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু বিদেশি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৪০১ ডলার, যা ২০২২ সাল শেষে ছিল ৩৭৫ ডলার। অর্থাৎ এক বছরে মাথাপিছু বিদেশি ঋণ ২৬ ডলার বেড়েছে।
এদিকে বাংলাদেশ সরকারের মোট ঋণ (অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি মিলিয়ে) ২০২৩ সাল শেষে দাঁড়িয়েছে ১৭৮ বিলিয়ন ডলার। ২০২২ সাল শেষে এর পরিমাণ ছিল ১৮০ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ বিদেশি ঋণ বাড়লেও অভ্যন্তরীণ ঋণ কিছুটা কমেছে সরকারের। তবে মাথাপিছু মোট (অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি) ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ডলার, যা অপরিবর্তিতই রয়েছে।
অভ্যন্তরীণ ঋণ কমলেও বিদেশি ঋণ বাড়ায় বর্তমানে সরকারের মোট ঋণ দাঁড়িয়েছে জিডিপির ৩৯ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০২২ সাল শেষে এটি ছিল ৩৯ দশমিক ১ শতাংশ। আর সরকারের ঋণের জন্য যে সুদ দিতে হয় তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে জিডিপির দুই দশমিক ১ শতাংশ, যা ২০২২ সাল শেষে ছিল এক দশমিক ৮ শতাংশ। এছাড়া পরিশোধিত সুদ বর্তমানে সরকারের রাজস্ব আয়ের ২৫ শতাংশ, যা গত বছর ছিল ২০ দশমিক ৩ শতাংশ। এতে মাথাপিছু সুদ ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৫৪ ডলার, যা ২০২২ সাল শেষে ছিল ৪৮ ডলার।
প্রসঙ্গত, দ্রুত বৈদেশিক ঋণ বাড়ায় দক্ষিণ এশিয়ার দুই দেশ শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান বিপদে পড়েছে। এর মধ্যে পাকিস্তানের মাথাপিছু ঋণ গত বছর কিছুটা কমে দাঁড়িয়েছে ৪০৩ ডলার। ২০২২ সাল শেষে তা ছিল ৪২৫ ডলার। তবে শ্রীলঙ্কার মাথাপিছু দুই হাজার ডলার অপরিবর্তিতই রয়েছে। তবে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের চেয়ে মাথাপিছু ঋণ কম রয়েছে আফগানিস্তান (৫৪ ডলার), ভারত (১৪৫ ডলার) ও নেপাল (২৬০ ডলার)।
দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি মাথাপিছু ঋণ ভুটান ও মালদ্বীপের। দেশ দুটির মাথাপিছু ঋণ যথাক্রমে চার হাজার ডলার ও আট হাজার ডলার। এর মধ্যে মালদ্বীপের মাথাপিছু ঋণ বিশ্বের সব দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ। আর ভুটানের মাথাপিছু ঋণ বিশ্বে ১৩তম সর্বোচ্চ। যদিও দুই দেশেরই মোট বিদেশি ঋণ তিন বিলিয়ন ডলারের ঘরে। তবে ভুটানের বিদেশি ঋণ জিডিপির ১০০ দশমিক ৩ শতাংশ আর মালদ্বীপের ৪৯ দশমিক ২ শতাংশ।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সাল শেষে বিশ্বে মোট সরকারি ঋণের পরিমাণ বেড়ে ৯৭ ট্রিলিয়ন (৯৭ লাখ কোটি) ডলার। ২০২২ সালে এর পরিমাণ ছিল ৯২ ট্রিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এক বছরে বিশ্বব্যাপী সরকারি ঋণ বেড়েছে পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলার বা পাঁচ লাখ কোটি ডলার। আর ২০১০ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারি ঋণের পরিমাণ ছিল ৫০ ট্রিলিয়ন ডলারের ঘরে। অর্থাৎ ১৩ বছরে তা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
বর্তমানে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ঋণ যুক্তরাষ্ট্রের, ৩৩ হাজার বিলিয়ন ডলার। এরপর চীনের ঋণ ১৫ হাজার বিলিয়ন ডলার ও তৃতীয় স্থানে থাকা জাপান সরকারের ঋণ ১১ হাজার বিলিয়ন ডলার। চতুর্থ স্থানে থাকা ইতালি সরকারের ঋণ তিন হাজার বিলিয়ন ডলার ও পঞ্চম স্থানে থাকা জার্মান সরকারের ঋণ তিন হাজার বিলিয়ন ডলারের কিছু কম।
sharebiz