২০২৩ সালে বাংলাদেশ কতটা নিরাপদ

  • ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
  •  ২৭ ডিসেম্বর ২০২২, ১৯:৪৫
বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা – ছবি : সংগৃহীত

দেশের মানুষ ২০২৩-এর বিশ্বমন্দা পরিস্থিতির ভাবনায় আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে। ইতোমধ্যে ২০২২ সাল প্রায় শেষ। ৩১ ডিসেম্বর রাত ১২টার পর একটি নতুন বছরের সূচনা হবে। বাংলাদেশ এরই মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পর্যায়ে। ২০২৬ সালে এর স্বীকৃতি পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে সেটা সহজ নয়। আছে নানা প্রতিবন্ধকতা ও চ্যালেঞ্জ। ইতোমধ্যেই নানা সঙ্কটে আবর্তিত হচ্ছে বিশ্ব। অর্থনৈতিক মহামন্দা পৃথিবীকে গ্রাস করবে এমনটাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা। পরিবেশ দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে অনেক দেশের সাথে আমরাও ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকব। পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো কোনো ঘটনা আমাদের অর্থনীতিকে ক্রমাবনতির দিকে নিয়ে যেতে পারে। কাজেই ২০২৩ সালে উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ হিসেবে দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান, সুষ্ঠু অভিবাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সেবা খাতের উন্নয়নসহ, খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিতকরণে আমাদের যত্নবান হতে হবে।

কেউ বলছে মন্দার সূচনা হবে ২০২৩ সাল থেকে। কেউ বলেন, ২০২৪ সালে বিশ্ব মন্দা প্রকট আকার ধারণ করবে। যাই হোক, বিশ্ব মন্দার কাছে হেরে যাবার কোনো সুযোগ নেই। তেমন হলে আমাদের এ যাবৎকালের অর্জনে বিশাল ছন্দপতন হবে। ২০২৩ সাল বাংলাদেশের জন্য হবে একটি বিশেষ বছর। ২০২২ সালে স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হয়েছে, চলবে ট্রেনও। প্রায় একই সময় রাজধানীর উত্তর থেকে দক্ষিণে ছুটবে মেট্রোরেল। বন্দরনগরী চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশের সুড়ঙ্গপথও চালু হয়ে যাবে শিগগিরই। এটা হলে ২০২৩ সালে অবকাঠামো সামর্থ্যে ভিন্ন এক বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হবে। স্বপ্নের এ তিন মেগা প্রকল্প নিয়ে দেশের মানুষের অনেক আশা, উৎসাহ, উদ্দীপনা। এগুলো শুধু অগ্রগতির প্রতীক হয়ে উঠবে না, এর সুফল দেশের অর্থনীতিতেও নতুন গতি আনবে। বাংলাদেশের অর্থনীতির দিগন্ত বদলে যাবে। এর সুস্পষ্ট প্রভাব পড়বে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে। সেই সঙ্গে এগুলো বাড়িয়ে দেবে দেশবাসীর মনোবল। ‘বাংলাদেশও পারে’- এমন সাহস সঞ্চার হবে মানুষের মধ্যে।

বঙ্গবন্ধু যে সঙ্কট মোকাবিলা করতে হিমশিম খেয়েছেন, সে সঙ্কট ৫০ বছর পরও বাংলাদেশের উন্নয়নের পথে বড় বাধা হয়ে আছে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমাদের সমস্যাগুলোর মধ্যে এক নম্বর হলো, দুর্নীতিবাজ খতম করা, দুই নম্বর, কল-কারখানায়, ক্ষেতে-খামারে উৎপাদন বাড়ানো, তিন নম্বর, পপুলেশন প্ল্যানিং, চার নম্বর হলো, জাতীয় ঐক্য। আজও বাংলাদেশের জনসাধারণের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য এ চারটি বিষয় গুরুত্বপ‚র্ণ। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর পেছন ফিরে তাকালে অনেক অর্জন আমাদের আশান্বিত করবে। কিন্তু তৃপ্ত হবার সুযোগ নেই। জাতীয় উন্নয়ন অগ্রগতিতে আমরা এখনো ঐক্যবদ্ধ হতে পারিনি হীন ব্যক্তিস্বার্থ ও দলীয় সঙ্কীর্ণতায়। আমাদের অগ্রগতির পথে বড় বাধা আমরা ৫০ বছর পরেও সবার জন্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে পারিনি। চিকিৎসার সুযোগ বেড়েছে বটে। কিন্তু সরকারি হাসপাতালে স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্রগুলোতে গরিব মানুষের চিকিৎসা সেবার সুযোগ সঙ্কুচিত। প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্নীতিমুক্ত নয়, চিকিৎসকদের অধিকাংশই অর্থলিপ্সায় নিমজ্জিত। সরকারি হাসপাতালের চেয়ে প্রাইভেট ক্লিনিকে চিকিৎসা দিতে তারা বেশি আগ্রহী। এ সঙ্কট নিরসনের কথা ভাবতেই হবে। বিকল্প পথ তৈরি করতে হবে গরিব মানুষের কল্যাণে। শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যাপক প্রসার ঘটেছে সন্দেহ নেই কিন্তু শিক্ষা এখন বাণিজ্য। শিক্ষাকে মানসম্পন্ন করতে সরকারি উদ্যোগ সফল হচ্ছে না। অর্থ-সম্পদে ধনী হলেই একটি জাতি সমৃদ্ধশালী হয় না। আমাদের উগ্র ভোগবাদী মূল্যবোধ থেকে বের হতে হবে। মানবিক মূল্যবোধের পথ রচনা করতে হবে, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মানুষের মতো মানুষ হিসেবে ৩০ লাখ শহীদের রক্তস্নাত এই মাটিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে।

আগামী বছর হবে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার সবচেয়ে খারাপ সময়। আর আমাদের দেশে এই মন্দার প্রভাব মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী যে সুনির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলেছেন, যেমন উৎপাদন বৃদ্ধি, দৈনন্দিন জীবনে সাশ্রয়ী হওয়া এবং রফতানি বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া-মূলত এসবই মন্দা মোকাবেলার জন্য এ মুহূর্তে সর্বোৎকৃষ্ট পদক্ষেপ। আর সে কারণেই এ পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করতে হবে এখন থেকেই। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা। তারা যত দ্রুত এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করবে ততই আগামী বছরের সম্ভাব্য মন্দা মোকাবেলার কাজটি সহজতর হবে।

দীর্ঘ পরিসরে চলা করোনা মহামারীর নেতিবাচক প্রভাব ও ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানাবিধ কারণেই সার্বিক বৈশ্বিক পরিস্থিতি মন্দার দিকেই যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই তার কিছু আলামতও স্পষ্ট। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মন্দার প্রভাবে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হ্রাস পাবে; কমে যাবে বিনিয়োগ। ফলে কর্মসংস্থানের গতিও কমবে; বাড়বে বেকারত্ব। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাবে। কমবে বিশ্ব বাণিজ্যের পরিধিও। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশের মুদ্রার মানে অস্থিরতা অব্যাহত থাকবে। জ্বালানি সঙ্কটের কারণে কৃষি উপকরণের দাম বাড়বে। এতে কৃষি উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয়ে বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বড় হুমকি হয়ে দেখা দেবে। ফলে খাদ্য নিরাপত্তাহীন মানুষের সংখ্যা বাড়বে। উদ্ভ‚ত পরিস্থিতিতে সার্বিকভাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার কমে যাবে। জাতিসঙ্গের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা আঙ্কটাডের প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

জানা গেছে, উন্নত দেশগুলো চলতি বছর থেকেই মুদ্রার প্রবাহ কমানোর ঘোষণা দিয়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাব ইতোমধ্যে পড়তে শুরু করেছে। আগামী বছর এর প্রভাব আরো প্রকট আকার ধারণ করবে বলে মনে করা হচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ‘বিশ্ব অর্থনীতি মন্দায় পড়লে বাংলাদেশের রফতানিতে এর প্রভাব পড়বে। কারণ, তৈরী পোশাকের চাহিদা এতে ব্যাপকভাবে হ্রাস পাবে। তবে সঠিকভাবে এগুতে পারলে এখানে কিছুটা ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হবে। এ ছাড়া বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে খাদ্য পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করা। কারণ, অনেক গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যপণ্য বাংলাদেশকে আমদানি করতে হয়। আমদানি করা পণ্যের দাম বাড়বে।

সম্ভাব্য বৈশ্বিক মন্দার প্রভাবে যদি দেশের সার্বিক রফতানি আয় কমে আর আমদানি আয় বেড় যায় তাহলে চলতি বছরের মতো আবারও ডলার সঙ্কট সৃষ্টি হতে পারে। ফলে বিপর্যস্ত হয়ে উঠতে পারে জাতীয় অর্থনীতি। বিশে^র উন্নত দেশগুলো এই চাপ অনেকটা সামাল দিতে পারলেও সমস্যা হবে বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর। তাই উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমাদেরকে বেশি বেশি খাদ্য উৎপাদনের দিকে নজর দিতে হবে। অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসবহুল আমদানি বন্ধ করে রফতানি আয় বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। একই সাথে প্রয়োজন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও জাতীয় ঐক্য। জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে ব্যর্থ হলে সম্ভাব্য মন্দার নেতিবাচক প্রভাব কোনোভাবেই মোকাবেলা করা যাবে না। আর এ দায়িত্বটা সরকারেরই বেশি।

প্রধানমন্ত্রীর স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যানের আওতায় স্থানীয় অর্থনীতি শক্তিশালী করা প্রয়োজন। খালি জায়গায় খাদ্যসহ অন্যান্য পণ্যাদি উৎপাদনে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান অত্যন্ত যৌক্তিক। এটি বাস্তবায়নে অবশ্যই স্থানীয় প্রশাসনকে নিষ্ঠার সাথে জনগণকে নিয়ে কাজ করতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে ডাটাবেজ তৈরি করে বেকারদের সামাজিক অন্তর্ভুক্তির আওতায় কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির মতো বিভিন্ন কর্মসূচি ন্যায্যতা ও দুর্নীতিমুক্তভাবে চালু করতে হবে। পাশাপাশি সঞ্চয় প্রক্রিয়ায় সবাইকে অংশগ্রহণ করতে হবে। কৃষি, খাদ্য এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে একযোগে কাজ করতে হবে, যাতে দেশের জনগণের চাহিদা অনুপাতে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়।

ইতোমধ্যে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে যে, জাপান ও চীন ছাড়া এশিয়ার দেশগুলোতে বার্ষিক ভিত্তিতে প্রকৃত মোট দেশজ উৎপাদন ২০২১ সালের ৬ দশমিক ২ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ২০২২ সালে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ হবে এবং ২০২৩ সালে হবে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। যদিও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আর্থিক কাঠামো ও পরিবেশ ভিন্ন কিন্তু কিছু দেশ ছাড়া অন্য সব দেশই মন্দার থাবা থেকে বেরোতে পারবে না। ইতোমধ্যে ইউরোপে উচ্চমূল্যস্ফীতি ঘটেছে, মধ্যপ্রাচ্যে ম‚ল্যস্ফীতির হার বেশি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও মূল্যস্ফীতির উচ্চহারের দিকে ধাবিত। দেশে এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী আছেন যারা সিন্ডিকেট করে, মজুদদারি করে পণ্যের দাম বিভিন্ন সময়ে বাড়াচ্ছেন। এদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া দরকার।

২০২৩ সাল আশীর্বাদ নাকি অভিশাপের? ২০২৩ সালে দেশের মানুষের আশা ও প্রত্যাশা কতটা পূরণ হবে? চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকার কতটা সফল হবে? ২০২৩ সালে বাংলাদেশ কতটা নিরাপদ ও ঝুঁকিমুক্ত থাকবে? এসব প্রশ্নের আলোকে আমাদের অভিমত এই যে, এখন থেকেই বাস্তবায়নযোগ্য সব কর্মপরিকল্পনা ও কর্মসূচি হাতে নিয়ে তার নিবিড় পর্যবেক্ষণ, পরিবীক্ষণ ও মনিটরিং রূপরেখা প্রস্তুত করতে হবে। আর এ লক্ষ্যে ২০২৫ সালকে ধাপ-১ হিসেবে এবং ২০৩৫ সাল ধাপ-২ হিসেবে বিবেচনায় এনে মূল্যায়ন ও কার্যপত্রের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। আগামীর বাংলাদেশে উৎপাদনমুখী কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা করা ছাড়া আমাদের কোনো পথ নেই।

লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক, সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি