২০২২-২৩ অর্থ বছর টাকার অবমূল্যায়ন ১৩.৩৫%

 

দেশে ডলারের সংকট দেখা দেয় গত বছরের মার্চ থেকে। এতে অর্থনীতিও চাপে পড়ে যায়। তবে জুলাই থেকে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে সংকটের বিষয়টি স্বীকার করা হয়। সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণসহ নানা খরচ কাটছাঁট করা হয়। এ সময় রিজার্ভও ছিল নি¤œমুখী। এছাড়া খোলাবাজারে গত অর্থবছর রেকর্ড পরিমাণ ডলার বিক্রি করা হয়। বিনিময় হারও দফায় দফায় পরিবর্তন করা হয়। সব মিলিয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছর ডলারের বাজারে ছিল মন্দাবস্থা।

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ সময় ডলারের বিপরীতে নিজ নিজ মুদ্রার অবমূল্যায়ন হচ্ছে। এর মধ্যে গত অর্থবছর প্রতিদ্বন্দ্বী/সমকক্ষ দেশগুলোর মধ্যে এ হার সবচেয়ে বেশি ছিল বাংলাদেশে। এ সময় ডলারের বিপরীতে ১৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ টাকার অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই এ অবমূল্যায়ন প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরের শুরুতে ডলারের বিপরীতে সময়ে বাংলাদেশের মুদ্রার গড় বিনিময় হার ছিল প্রায় ৯৩ টাকা। জুন শেষে গিয়ে এ হার দাঁড়ায় প্রায় ১০৬ টাকা। অর্থাৎ মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয় ১৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ। এরপর সবচেয়ে বেশি অবমূল্যায়ন হয়েছে চীনের মুদ্রার। ২০২২-২৩ অর্থবছর দেশটির মুদ্রার (ইউয়ান) অবমূল্যায়ন হয়েছে সাত দশমিক ৭৯ শতাংশ। তৃতীয় অবস্থানে থাকা ভারতের রুপির গত অর্থবছর ডলারের বিপরীতে অবমূল্যায়ন হয় ৩ দশমিক ৭৮ শতাংশ।

বিদায়ী অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) বাংলাদেশের মুদ্রার অবমূল্যায়ন হয়েছিল সাড়ে ১২ শতাংশ, চীনের ইউয়ানের দুই দশমিক ৫৩ শতাংশ ও ভারতের রুপির তিন দশমিক ৭৮ শতাংশ। অর্থাৎ শেষ তিন মাসে (এপ্রিল-জুন) বাংলাদেশের মুদ্রার অবমূল্যায়নের হার কিছুটা কমেছে। তবে চীনের ইউয়ানের অবমূল্যায়ন বেড়েছে। আর ভারতের রুপির শেষ তিন মাসে কিছুটা অতিমূল্যায়ন হয়েছে। এতে সার্বিকভাবে অবমূল্যায়ন হার কমেছে দেশটির মুদ্রার।

এদিকে ২০২২-২৩ অর্থবছর ভিয়েতনামের মুদ্রার (ডং) অবমূল্যায়ন হয় দুই দশমিক ৯০ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ার মুদ্রার (রুপিয়া) অবমূল্যায়ন হয় ১ দশমিক ১৮ শতাংশ, কম্বোডিয়ান মুদ্রার (কম্বোডিয়ান রিয়াল) অবমূল্যায়ন হয় শূন্য দশমিক ৮৬ শতাংশ এবং ফিলিপাইনের মুদ্রার (পেসো) শূন্য দশমিক ৬২ শতাংশ অবমূল্যায়ন হয়েছে। যদিও অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে ফিলিপাইনের পেসোর ১ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ অতিমূল্যায়ন হয়েছিল। আর কম্বোডিয়ান রিয়ালের অতিমূল্যায়ন হয়েছিল শূন্য দশমিক ৯৬ শতাংশ। অর্থাৎ ওই দুই দেশের মুদ্রার শেষ তিন মাসে দ্রুত অবমূল্যায়ন হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত অর্থবছর বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে চাহিদা-সরবরাহের ব্যবধান থাকায় ব্যাপকভাবে টাকার অবমূল্যায়ন করা হয়। ডলার সংকট থাকার কারণে ব্যাংকগুলো চাহিদামতো ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারেনি। তাই নিয়মিত রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করা হয়েছে। এর ফলে রিজার্ভের ওপর চাপ তৈরি হয়েছে।

গত অর্থবছর খোলাবাজারে ডলার বিক্রি করা হয়েছে ১৩ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে শেষ তিন মাসেই বিক্রি করা হয়েছে দুই দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলার। এতে গত বছরের জুন শেষে মোট রিজার্ভ নেমে গেছে ৩১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারে। ২০২২ সালের জুনেও যার ছিল ৪১ দশমিক ৮৩ শতাংশ। তবে বিপিএম৬ (ব্যালান্স অব পেমেন্ট ৬) অনুযায়ী গত জুনে মোট রিজার্ভ ছিল ২৪ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার, ২০২২ সালের জুনে যা ছিল ৩৩ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলার।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গত অর্থবছর ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন নমিনাল অ্যাফেক্টিভ এক্সচেঞ্জ রেট ও রিয়েল অ্যাফেক্টিভ এক্সচেঞ্জ রেট উভয়ের ওপর প্রভাব ফেলে। এতে গত অর্থবছর নমিনাল অ্যাফেক্টিভ এক্সচেঞ্জ রেটের অবমূল্যায়ন হয়েছে প্রায় ১৩ শতাংশ এবং রিয়েল অ্যাফেক্টিভ এক্সচেঞ্জ রেট অবমূল্যায়ন হয়েছে প্রায় আট দশমিক ৬ শতাংশ।

সূত্রমতে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর গত বছরের মার্চ থেকে দেশে ডলার সংকট প্রকট হতে শুরু করে। এ সংকট মোকাবিলায় শুরুতে ডলারের দাম বেঁধে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে সংকট আরও বেড়ে যায়। পরে সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম নির্ধারণের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ায়। তখন এ দায়িত্ব দেয়া হয় এবিবি ও বাফেদার ওপর। এরপরও নিয়ন্ত্রণে আসেনি ডলারের বাজার। দফায় দফায় অবমূল্যায়ন হয়েছে টাকা। এতে গত অর্থবছরের রেকর্ড বৃদ্ধি পায় ডলারের বিনিময় হার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০০৮-০৯ অর্থবছর শেষে দেশে ডলারের বিনিময় হার ছিল ৬৮ টাকা ৮০ পয়সা। এরপর প্রতি বছর তা একটু একটু করে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে দুই বছর আবার টাকার কিছুটা অতি মূল্যায়নও হয়েছে। গত ১৪ বছরের মধ্যে ২০১১-১২ অর্থবছর সর্বোচ্চ ১১ শতাংশের বেশি অবমূল্যায়ন হয়েছিল ডলার। এরপর বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছর সর্বোচ্চ ১৩ শতাংশের বেশি অবমূল্যায়ন হয়েছে টাকা।

এদিকে ডলারের দর বৃদ্ধির ফলে দেশে জ্বালানি তেল ও ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এতে সার্বিকভাবে আমদানি খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে, যার প্রভাব পড়েছে সাধারণ মানুষের ওপর। ডলারের দর বৃদ্ধির কারণে শিল্প পণ্যের আমদানি খরচ বেড়ে যায়। এতে শিল্পোদ্যোক্তারা বিপদে আছেন। এছাড়া ডলারের দর বৃদ্ধিতে আমদানিকারকদের পুরোনো এলসির (ঋণপত্র) দায় পরিশোধ করতে হয় বেশি দরে।

মূলত ডলার সংকটের কারণে বাংলাদেশে চলতি হিসাবে রেকর্ড ঘাটতি দেখা দিয়েছে। কেননা বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রা যত আয় করছে, তার চেয়ে ব্যয় হচ্ছে অনেক বেশি। এছাড়া কমেছে রেমিট্যান্স ও বেড়েছে আমদানি ব্যয়। ফলে ডলারে টান পড়েছে। আর এতেই কমছে টাকার মান।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ডা. আহসান এইচ মনসুর শেয়ার বিজকে এ প্রসঙ্গে বলেন, কিছুটা ভুল নীতির জন্যই গত অর্থবছর ডলারের দর এতটা বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ গত ১২ বছর ধরে টাকাকে অতিমূল্যায়িত করে রাখা হয়েছিল। এখন একসঙ্গে সমন্বয় করা হচ্ছে। ফলে এত বেশি দর বৃদ্ধি পেয়েছে। এর প্রভাবে মূল্যস্ফীতিও বেড়ে গেছে।

মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকলে আগামীতে ডলারের দর আরও বাড়বে বলে মনে করেন ড. মনসুর। তিনি বলেন, এখনই মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। মূল্যস্ফীতি কমাতে না পারলে টাকার মান কমে যাবে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে।

এদিকে ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ী বিশেষত আমদানিকারকরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে দাবি করেছেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান। তিনি বলেন, ‘আমদানিনির্ভর দেশ হওয়ায় ডলারের দর এক লাফে এতটা বৃদ্ধিতে সব ধরনের পণ্যের আমদানি ব্যয় ২৫-৩০ শতাংশ বেড়ে গেছে। এছাড়া সরকার বিলাসপণ্য আমদানিতে কড়াকড়ি করেছে। কিন্তু যেসব পণ্য প্রয়োজনীয় তার দাম বেড়ে গেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ডলারের দর বৃদ্ধি যদিও রপ্তানির জন্য ভালো কিন্তু আমরা আমদানিনির্ভর দেশ হওয়ায় এটা মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ তৈরি করছে। তবে এভাবে বাড়তে থাকলে ডলারের দর কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা বলা যাচ্ছে না। আর ডলারের বাড়তি দর এখনই জ্বালানি তেল ও এলএনজি আমদানিতে বড় প্রভাব ফেলেছে। আগামীতে আরও অন্যান্য খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

সূত্র : শেয়ার বিজ