যেকোনো মুহূর্তে দেশ ছাড়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলে আতঙ্কে ভুগছিলেন তারা। দুই দেশের কূটনীতিতে ক্রমবর্ধমান অস্বস্তি তাদের এ আশঙ্কাকে আরো জোরালো করে তোলে। তারা ভয় পাচ্ছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপ বাড়ানো হলে এর ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে দীর্ঘসময় টিকে থাকা সম্ভব না-ও হতে পারে
বাংলাদেশের পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক এক সভাপতি এখন সিঙ্গাপুরে অবস্থান করছেন। শুধু বিজিএমইএর এ সাবেক সভাপতি নয়; দেশের দুই বড় অলিগার্কও সেখানে অবস্থান করছেন। বেশ কয়েকটি ব্যাংকের চেয়ারম্যানরা থাকছেন দুবাইয়ে। কানাডায়ও আছেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত কয়েকজন বড় ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতা। সাবেক আমলা ও ব্যবসায়ীদের একটি অংশ আছেন যুক্তরাষ্ট্রে। রাজনীতিবিদদের বড় একটি অংশ এখন অবস্থান করছেন ভারতে। ২০২১ সালে র্যাবের সাত কর্মকর্তার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা আসার পর থেকেই বিদেশে দীর্ঘসময় অবস্থানের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তারা। পাচারের মাধ্যমে স্তূপ করছিলেন বিপুল পরিমাণ অর্থ।
যেকোনো মুহূর্তে দেশ ছাড়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলে আতঙ্কে ভুগছিলেন তারা। দুই দেশের কূটনীতিতে ক্রমবর্ধমান অস্বস্তি তাদের এ আশঙ্কাকে আরো জোরালো করে তোলে। তারা ভয় পাচ্ছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপ বাড়ানো হলে এর ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে দীর্ঘসময় টিকে থাকা সম্ভব না-ও হতে পারে। এজন্য তারা প্রস্তুতি নিতে থাকেন স্বল্প সময়ের নোটিসে বাংলাদেশ ছাড়ার। এ কারণে ওই নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরপর পরিকল্পিতভাবেই বাংলাদেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাচার ব্যাপক মাত্রায় বেড়ে যায়। বিষয়টির সমর্থন পাওয়া যায় দেশের পণ্য আমদানি-রফতানির পরিসংখ্যান এবং রিজার্ভ স্থিতির গতিপ্রকৃতিতেও।
আর্থিক খাতের পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সরকারের পতনের পর দীর্ঘসময় দেশের বাইরে পালিয়ে থাকতে হতে পারে বলে মনে করছিলেন অর্থ পাচারকারীদের অনেকেই। এ অবস্থায় অবৈধ-অপ্রাতিষ্ঠানিক চ্যানেলের পাশাপাশি আমদানি-রফতানিসহ বৈধ চ্যানেল ব্যবহার করেও দেশের বাইরে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করতে থাকেন তারা।
বাংলাদেশে পণ্য আমদানিতে বড় ধরনের উল্লম্ফন দেখা দেয় মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে পণ্য আমদানি হয়েছিল ৬ হাজার ১৯৪ কোটি ২৪ লাখ ডলারের। ২০২১-২২ অর্থবছরে তা আকস্মিকভাবে ৪৪ দশমিক ২২ শতাংশ বেড়ে ইতিহাসের সর্বোচ্চ ৮৯ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। সেবার দেশে পণ্য আমদানি হয়েছিল ৮ হাজার ৯৩৩ কোটি ৬৯ লাখ ডলারের। এরপর ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার মুখে বাংলাদেশে পণ্য আমদানিতে নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। যদিও অর্থ পাচার ও রিজার্ভের ক্ষয় কোনোটিই থামানো যায়নি। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশে পণ্য আমদানি ১০ দশমিক ৬ শতাংশ কমে হয়েছিল ৬ হাজার ৩২৪ কোটি ২০ লাখ ডলার। আগের অর্থবছরে (২০২২-২৩) এর পরিমাণ ছিল ৭ হাজার ৭৪ কোটি ৮০ লাখ ডলার।
মিথ্যা আমদানি ঘোষণার পাশাপাশি নানা কারসাজির কারণে বাংলাদেশের সরকারি তথ্যের সঙ্গে এখানে পণ্য রফতানি করা দেশগুলোর পরিসংখ্যানে বড় ধরনের ব্যবধান দেখা গেছে। বিশেষ করে দেশে পণ্য আমদানির প্রধান উৎস চীনের ক্ষেত্রে এ ব্যবধান দেখা গেছে সবচেয়ে বেশি। এর কারণ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দেশে আমদানি পণ্যের শুল্কায়ন হয় প্রধানত এলসি মূল্যের ওপর। শুল্ক ফাঁকির উদ্দেশ্যে আমদানিকারক ব্যবসায়ীদের অনেকেই আন্ডার ইনভয়েসিং বা আমদানি মূল্য কম দেখানোর কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েসিংয়ের (আমদানি মূল্য প্রকৃতের চেয়ে বেশি দেখানোর কৌশল) মাধ্যমে চীন হয়ে তৃতীয় কোনো দেশে অর্থ পাচারের ঘটনাও ঘটছে। মূলত এ দাম বাড়িয়ে-কমিয়ে দেখানোর প্রবণতার কারণেই দুই দেশের বাণিজ্য পরিসংখ্যানে বড় ধরনের ব্যবধান দেখা গেছে।
একই সময়ে ব্যাপক আকারে বৃদ্ধি পেয়েছে বাংলাদেশ থেকে রফতানির পরিমাণও। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, কভিড-১৯ মহামারী দেখা দেয়ার আগের অর্থবছরে (২০১৮-১৯) বাংলাদেশ থেকে মোট পণ্য রফতানি হয়েছিল ৪ হাজার ৫৩ কোটি ৫০ লাখ ডলারের। মহামারীর প্রাদুর্ভাবে ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা নেমে এসেছিল ৩ হাজার ৩৬৭ কোটি ৪০ লাখ ডলারের ঘরে। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়ায় ২০২০-২১ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৮৭৫ কোটি ৮৩ লাখ ডলারে।
র্যাবের সাবেক ও তৎকালীন সাত কর্মকর্তার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপ হয় ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথমার্ধে। এর পরপরই বাংলাদেশ থেকে পণ্য রফতানির মাত্রা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। ওই অর্থবছরেই প্রথম বাংলাদেশের রফতানি আয় ৫০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। সেবার বাংলাদেশ থেকে মোট পণ্য রফতানির পরিমাণ দাঁড়ায় ৫ হাজার ২০৮ কোটি ২৬ লাখ বা ৫২ দশমিক শূন্য ৮ বিলিয়ন ডলারের বেশিতে। এরপর ২০২২-২৩ অর্থবছরে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ হাজার ৬৪৯ কোটি ৪৮ লাখ ডলারে। আর গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৪৪৭ কোটি ৫১ লাখ ডলার।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের এ তথ্যের সঙ্গে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যে বরাবরই বড় ধরনের ব্যবধান দেখা গেছে। ইপিবির পরিসংখ্যানে সবসময়ই রফতানির তথ্য ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হয়েছে। আবার পণ্য আমদানিকারী বিভিন্ন দেশের আমদানি পরিসংখ্যানের সঙ্গেও বাংলাদেশের রফতানি নিয়ে সরকারি তথ্যগুলোর বড় ব্যবধান দেখা গেছে সব সময়।
পাচার যে খাতেই হোক না কেন; অপরাধীকে অপরাধী হিসেবেই দেখতে হবে বলে মনে করছেন দেশের নিটওয়্যার খাতের পোশাক রফতানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক। বণিক বার্তা তিনি বলেন, ‘রফতানি হওয়া পণ্যের বিপরীতে প্রাপ্য অর্থের একটা ছোট অংশ হলেও আসেনি। যারা বড় অংকের টাকা বা যারা দীর্ঘদিন ধরে অর্থ পাচার করেছেন, তাদের বিকল্প পরিকল্পনা তো ছিলই। ছিল বলেই করেছেন। হরহামেশাই শোনা যায় কারো মালয়েশিয়ায় কারো দুবাইয়ে, কারো যুক্তরাজ্যে সেকেন্ড হোম আছে। আবার কেউ তুরস্ক, কানাডা বা সিঙ্গাপুরে সেকেন্ড হোম গড়ে তুলেছেন। যারা সেকেন্ড হোম করে তারা তো একটা সেকেন্ড প্ল্যান থেকেই তা করে। এটা দুর্ভাগ্যজনক যে যাদের উত্থান হলো দেশে, তাদের সেকেন্ড হোম থাকে। সেকেন্ড প্ল্যানও থাকে। এটা তাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনারই অংশ। এক্ষেত্রে পোশাক খাত বা খাতভিত্তিক আলাদা করার কিছু আছে এমনটা আমি মনে করি না। যারা অপরাধ করে তারা অপরাধী।’
দেশের পণ্য রফতানির সিংহভাগজুড়ে রয়েছে তৈরি পোশাক খাত। খাতটির রফতানিকারক কয়েক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে বিগত সরকারের আমলে বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচারের অভিযোগ উঠেছে। তবে বিজিএমইএর সাবেক সহসভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু মনে করছেন, এ খাতের প্রকৃত রফতানিকারক ব্যবসায়ীদের জন্য অর্থ পাচারের সুযোগ কম।
বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘নিয়মিত রফতানিকারকদের জন্য এটি একদমই অসম্ভব বলে আমি মনে করি। এটি একমাত্র তারাই পারবে, যাদের অর্থ পাচারের গন্তব্য দেশগুলোয় অফশোর অফিস আছে। দেশের বাইরে যাদের নিজস্ব অফিস আছে, তাদের সেই সুযোগ আছে। আবার যাদের অফিস আছে, তাদের সবাই এর অপব্যবহার করেননি। পোশাক রফতানির এফওবি মূল্যের উল্লেখযোগ্য একটি অংশই ব্যবহার হয় কাঁচামাল আমদানিতে। এক্ষেত্রেও খুব বড় পরিমাণে অর্থ পাচারের সুযোগ রয়েছে বলে আমি মনে করি না। বরং অন্যান্য পণ্য আমদানিতে অর্থ পাচারের সুযোগ রয়েছে। তবে সেখানেও যে সবাই করেন তাও নয়।’
সেন্ট্রাল ব্যাংকার এবং আর্থিক খাতসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কাগজে-কলমে রফতানির পরিমাণ সবসময় অনেক বেশি দেখানো হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এর মূল্য বাবদ অর্থ দেশে প্রত্যাবাসিত হয়েছে খুবই নগণ্য। ফলে দেশের ট্রেড ক্রেডিটও ব্যাপক মাত্রায় বেড়েছে। এ ট্রেড ক্রেডিটের ঘাটতি স্ফীত হতে থাকার কারণেই সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশে আর্থিক হিসাবের ঘাটতিও বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছর শেষেও দেশে ট্রেড ক্রেডিটের উদ্বৃত্ত ছিল দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষ হতে না হতেই দেশে ট্রেড ক্রেডিটের নিট ঘাটতি বেড়ে দাঁড়ায় ৬ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলারে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক গত জুলাইয়ের শুরুতে রফতানির তথ্য সংশোধন করে ১৪ বিলিয়ন ডলার বাদ দেয়ায় এ ট্রেড ক্রেডিটের পরিমাণ উদ্বৃত্তে চলে আসে। সে অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের ট্রেড ক্রেডিটের নিট উদ্বৃত্ত ছিল ২ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলার। তবে এর পরও সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে নিট ট্রেড ক্রেডিটের পরিমাণ আবার ঘাটতিতে চলে যায়, যার পরিমাণ ১ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার।
আমদানি-রফতানির মতো ব্যাংকিং চ্যানেলনির্ভর বৈধ কার্যক্রমের আড়ালে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হওয়ায় টান পড়েছে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে। র্যাব কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের আগে আগে ২০২১ সালের আগস্টে দেশের রিজার্ভের পরিমাণ বেড়ে পৌঁছেছিল ইতিহাসের সর্বোচ্চে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব হিসাবায়ন অনুযায়ী, সে সময় দেশের গ্রস রিজার্ভের পরিমাণ ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছিল। কিন্তু ডিসেম্বরে র্যাব কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর থেকেই রিজার্ভের ব্যাপক মাত্রায় ক্ষয় হতে থাকে। আমদানিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপসহ নানা পদক্ষেপ নিয়েও এ ক্ষয় ঠেকানো যায়নি।
এমনকি রিজার্ভ গণনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব হিসাবায়ন পদ্ধতি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে বারবার। এক পর্যায়ে রিজার্ভের ক্ষয় ঠেকাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দ্বারস্থ হয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী রিজার্ভের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে বিপিএম৬ পদ্ধতিতে হিসাবায়ন শুরু হয় গত বছর।
আইএমএফের শর্তে বিভিন্ন সময়সীমায় রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেয়া হলেও অর্থ পাচার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা পূরণে ব্যর্থ হয় বাংলাদেশ। বিশেষ করে গত নির্বাচনের আগে পাচারের মাত্রা ব্যাপকভাবে বেড়েছিল বলে সে সময় ব্যাংকার ও সংশ্লিষ্ট পর্যবেক্ষকরা জানিয়েছিলেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ১ আগস্ট প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগ মুহূর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব হিসাবায়ন অনুযায়ী দেশে গ্রস রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৫ দশমিক ৯২ বিলিয়ন ডলার। আর বিপিএম৬ পদ্ধতিতে এর পরিমাণ ছিল ২০ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার।
কানাডা, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও দুবাইয়ের প্রপার্টি খাতে বিনিয়োগ হয়েছে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া বিপুল পরিমাণ অর্থ। সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ একাই ২০১৬ সাল থেকে যুক্তরাজ্যে ৩৬০টি বাড়ি ক্রয় করেছেন। বাড়ি ক্রয়ের এসব অর্থ বাংলাদেশের বাইরে থাকা বৈধ ব্যবসা থেকে নিয়ে এসেছেন বলে সেখানে জানিয়েছেন তিনি। যদিও বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী, কোনো রাজনীতিবিদের দেশের বাইরে সম্পদ থাকলে তা হলফনামায় উল্লেখ করতে হয়। কিন্তু সাইফুজ্জামান চৌধুরীর দেশের বাইরে থাকা সম্পদ সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই সরকারের কাছে।
সাইফুজ্জামান জাভেদের মতো ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশের প্রপার্টি খাতে বিলাসবহুল সম্পদের বড় ক্রেতা হয়ে উঠেছিলেন আওয়ামী লীগ আমলের প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও আমলারা। দেশের প্রচলিত আইনে এভাবে বিদেশে বিনিয়োগ করার সুযোগ নেই বললেই চলে। আবার সরকারের কাছেও এ বিনিয়োগের আনুষ্ঠানিক কোনো তথ্য নেই।
বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে জাতীয় শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির এক খসড়া প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি (১৪ বিলিয়ন) ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। আগামীকালই এ-সংক্রান্ত একটি চূড়ান্ত প্রতিবেদন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেয়ার কথা রয়েছে। আর পরদিন সোমবার তা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ হতে পারে বলে জাতীয় শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য গত বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন।
বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার জন্য ব্যাপক তৎপরতা শুরু হয়েছে বলে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বারবার জানানো হয়েছে। যদিও অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বিশ্বের যেকোনো দেশের জন্যই পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনা এমনিতেই বেশ জটিল। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ জটিলতা বাড়িয়ে দিয়েছে আমদানি-রফতানির মতো বৈধ প্রক্রিয়ার আড়ালে ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করে অর্থ পাচার। আবার ব্যাংকিং চ্যানেল ছাড়াও চালান জালিয়াতি, দেশে কর্মরত বিদেশী কর্মীদের পাঠানো অর্থ, ভিসা ও অভিবাসন বাবদ, মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (এমএফএস) এবং হুন্ডির মাধ্যমেও প্রচুর অর্থ পাচার হয়েছে। এ অর্থ ফেরত অত্যন্ত কঠিন এবং প্রায় অসম্ভবের কাছাকাছি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম মনে করছেন, এ অর্থ সহজে দেশে ফেরত আসবে না। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আমলা সবাই নানা পথে টাকা পাচার করেছে। এ অর্থ ফেরত আসবে না। পাচারকারীরা যদি বিদেশে চলে যায় তাহলে তারাও দেশে ফেরত আসবে না। এটাই হলো বাস্তবতা।’
আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতাও বলছে, বিশ্বের যেকোনো দেশ থেকে পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ উদ্ধার প্রক্রিয়াটি খুবই জটিল ও সময়সাপেক্ষ বিষয়। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের পক্ষে পাচারকৃত অর্থ উদ্ধার আরো বেশি কঠিন। অর্থ পাচারের নথিপত্র সংগ্রহ, পাচারের গতিপথ নির্ধারণ, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও পাচার হওয়া দেশের আইনগত প্রক্রিয়া শেষ করতে সর্বনিম্ন পাঁচ বছর সময় লাগবে। আর বিষয়বস্তু ও প্রক্রিয়া জটিল হলে কোনো কোনো মামলা শেষ হতে ১৫-২০ বছরও সময় লাগতে পারে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী শাহীন আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘টাকা ফেরত আনার ব্যাপারে অনেক আলোচনা চলছে। এটি খুবই কঠিন একটি পদ্ধতি। যদিও অসম্ভব কিছু নয়। এ টাকাগুলোর বেশির ভাগই বিভিন্ন চ্যানেলে চলে গেছে। বিভিন্ন খাতে পাচারকারীরা বিপুল পরিমাণ অর্থ এরই মধ্যে ব্যবহার করে ফেলেছে। যেগুলো তারা বিভিন্ন খাতে খরচ করে ফেলেছে সেগুলো আনা প্রায় অসম্ভব। এছাড়া পাচার হওয়া দেশের সরকারেরও আন্তরিক সহযোগিতা খুবই প্রয়োজন। কিন্তু আজকাল এসব বিষয়ে কোনো দেশের সরকার খুব একটা আগ্রহ দেখায় না। যেগুলো বেসরকারি খাতে চলে গেছে, সেগুলোর বিষয়ে কোনো দেশের সরকার নাক গলায় না। যদি কোনো দেশ টেকনিক্যাল সাপোর্ট দেয় ও আন্তরিক হয় তাহলে হয়তো সম্ভব হতে পারে।’
যুক্তরাষ্ট্রের বিধিনিষেধ ও গত নির্বাচনের আগে ভিসানীতি আরোপের কারণে পাচারকারীরা তাদের পাচারকৃত অর্থ অন্য দেশে সরিয়ে ফেলারও তথ্য রয়েছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে বড় অংকের অর্থ গচ্ছিত রাখা নিরাপদ মনে করছিলেন না ধনাঢ্য বাংলাদেশী ও অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থের মালিকরা। মার্কিন প্রভাববলয়ের পশ্চিমা দেশগুলো নিয়েও ভরসা কম পাচ্ছিলেন তারা। এর মধ্যেই আবার বিদেশীদের জন্য প্রপার্টিতে বিনিয়োগ কঠিন করে তোলে কানাডা। এমনকি তীব্র গোপনীয়তার নীতির কারণে বিশ্ববাসীর কাছে গোপন অর্থ সঞ্চয়ের সবচেয়ে নিরাপদ স্থানগুলোর অন্যতম হিসেবে পরিচিত সুইজারল্যান্ডেও অর্থ রাখতে ভরসা পাচ্ছিলেন না তারা। এমন পরিস্থিতিতে অর্থ পাচারকারীদের অনেকেই পাচারকৃত অর্থ তুরস্ক, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, রোমানিয়া, স্লোভেনিয়া ইত্যাদির মতো পূর্ব ইউরোপের কিছু দেশে সরিয়ে ফেলেছেন।
এ বিষয়ে সূত্রগুলোর ভাষ্য অনুযায়ী, এসব দেশে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব তুলনামূলক কম। আবার পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর আর্থিক খাতের অপরাধ শনাক্ত বা নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতাও বিভিন্ন সময়ে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ডাবলিনভিত্তিক আর্থিক অপরাধ পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা এএমএল ইন্টেলিজেন্সের ভাষ্যমতে, ইউরোপ মহাদেশের অবৈধ অর্থ স্থানান্তরের অন্যতম প্রধান করিডোর হিসেবে পূর্ব ইউরোপীয় অঞ্চলের নাম বারবার সামনে এসেছে। বিভিন্ন সময় নানামাত্রার আর্থিক অপরাধের তথ্য উদ্ঘাটন এ অঞ্চলে অর্থ পাচারের সমস্যার মাত্রাকে সামনে নিয়ে এসেছে। বিশেষ করে এসব দেশের আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা নিয়েও নানা সময়ে প্রশ্ন উঠেছে। এসব দেশ থেকে পাচারকৃত অর্থ উদ্ধার করা একপ্রকার অসম্ভব বলে বৈশ্বিক আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞদের।
পাচারকৃত অর্থ উদ্ধার করা অনেকাংশেই কঠিন হবে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক কূটনীতির পর্যবেক্ষকরা। সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এ অর্থ ফেরত আনার ক্ষেত্রে সফলতা নির্ভর করে অনেকগুলো উপাদানের ওপর। একটা হচ্ছে যে আমাদের সরকার কতটা কমিটেড। কারণ এখানে দীর্ঘসূত্রতার ব্যাপার আছে। আমাদের দেশের আইন, যেসব দেশে টাকা গেছে সেসব দেশের আইন মেনে তারপর এর জন্য কাজ করতে হবে। ফলে লম্বা সময়ের জন্য আমাদের সরকার যদি তাদের অঙ্গীকার ধরে রাখতে পারে, তাহলে হয়তো সম্ভব। অন্যদিক থেকে যে দেশ থেকে আমরা আনব, সে দেশের সরকার বা প্রতিষ্ঠানগুলোরও সহযোগিতার প্রয়োজন হবে। আর যাদের বিরুদ্ধে পাচারের অভিযোগ, তাদের নিয়ে আইনি প্রক্রিয়ারও প্রয়োজন আছে। তাদের অপরাধ প্রমাণের বিষয় আছে। এছাড়া এসব বিষয়ে আমাদের এখানে যারা কাজ করবেন তাদেরও টেকনিক্যাল নলেজ থাকা দরকার আছে।’
Bonik Barta