শেখ হাসিনার পরম বন্ধু ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) গত এক দশকের মধ্যে ২০২০ সালে সবচেয়ে বেশি নিরীহ বাংলাদেশীদের হত্যা করেছে। চলতি বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ৪৫ জন বাংলাদেশীকে সীমান্তে হত্যার মাধ্যমে এক দশকে নূতন রেকর্ড স্পর্শ করেছে বিএসএফ। ভারতের প্রতি নতজানু ফ্যাসিবাদি সরকার এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ তো করেই নাই, বরং ভারতের পক্ষেই সাফাই গেয়ে চলেছে। সরকারের মন্ত্রী ও সীমান্ত রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বিজিবি মহাপরিচালিক উল্টা বাংলাদেশের নাগরিকদেরই দোষারোপ করে চলেছেন। ফ্যাসিবাদি সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও অন্য মন্ত্রীরা ইন্ডিয়ার সাথে সম্পর্কের উন্নয়নের উচ্চতা নিয়ে বড়াই করছেন হরহামেশা।
২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি বিএসএফ সীমান্তে গুলি করে হত্যার পর কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলিয়ে রেখেছিল বাংলাদেশী কিশোরী ফেলানীর লাশ। সেই বর্বর দৃশ্য আজও দেশের মানুষকে ব্যথিত করে। সেই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ভারতের সাজানো বিচারে বিএসএফের হত্যাকারীরা সব বেকসুর খালাস পেয়েছে। সীমান্ত এলাকাগুলোতে বাংলাদশীদের নিয়মিত হত্যা করেই চলেছে বিএসএফ।
সীমান্তে হিন্দুত্ববাদী বিএসএফের এমন বর্বর আচরণের কড়া প্রতিবাদ কখনো বাংলাদেশের তরফ থেকে করা হয়নি। বরং বিভিন্ন সময় বিএসএফের সাফাই গেয়েছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে বর্ডার গার্ড (বিজিবি) এর প্রধান।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিএসএফের হত্যাযজ্ঞের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, যেবছর (২০১১ সালে) কিশোরী ফেলানীকে হত্যার পর কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলিয়ে রেখেছিলো বিএসএফ, সেই বছর তাদের নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হন নিরীহ ৩১ জন বাংলাদেশী। ফেলানীকে হত্যার পর বাংলাদেশের মানুষ ফুঁসে উঠলে আরো কর্তৃত্ববাদী আচরণ দেখায় ভারত। বাংলাদেশের মানুষের ক্রোধকে তোয়াক্কা না করে পরের বছর (২০১২ সালে) গুলি করে হত্যা করা হয় ৩৮ জন বাংলাদেশীকে। আওয়ামী লীগের গোলামী আচরণের কারণে বছরের পর বছর এমন বেপরোয়া আচরণ করে আসছে হিন্দুত্ববাদী ভারত।
২০১৩ সালে অবশ্য সীমান্তে মৃত্যুর সংখ্যা কিছুটা কমে আসে। সেই বছর বিএসএফের গুলিতে মারা যান ২৯ জন বাংলাদেশী। এর পরের বছর (২০১৪ সালে) ফের হিংস্র দানবের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় বিএসএফ। তাদের গুলিতে প্রাণ হারান ৩৫ জন বাংলাদেশী। ২০১৫ সালে বিএসএফ সীমান্তে খুনের সংখ্যা আরো বাড়িয়ে দেয়। সীমান্তে ৪৪ জন বাংলাদেশীকে গুলি করে উল্লাস করে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক বন্ধু ভারতের খুনী সীমান্তরক্ষী বাহিনী।
২০১৬ সালে ২৯ জন বাংলাদেশীকে গুলি করে হত্যা করে তারা। এ সংখ্যা কিছুটা কমে আসে ২০১৭ সালে। সে বছর বিএসএফের গুলিতে প্রাণ হারান ২৫ জন।
প্রশাসন, সেনাবাহিনী, পুলিশ ও র্যা বকে ব্যবহার করে যে বছর মধ্যরাতে ভোট ডাকাতি করেছিল শেখ হাসিনার সরকার, সেই বছর অবশ্য রহস্যজনক কারণে সীমান্তে খুনের মাত্রা কমিয়ে আনে ভারত। পরমবন্ধু শেখ হাসিনাকে গদিতে রাখতেই সম্ভবত সেই বছর (২০১৮ সালে) সীমান্তে কম খুন-খারাবি করে বিএসএফ। শেখ হাসিনার মুখ রক্ষা করতে ২০১৮ সালে অনেক সংযত ছিলো ভারতীয় এই বাহিনী। ভোট ডাকাতির বছর বিএসএফের গুলিতে সীমান্তে প্রাণ হারান ১১ জন বাংলাদেশী।
ভোট ডাকাতির পরের বছর (২০১৯ সালে) সীমান্তে ফের নিজেদের দানবীয় রূপ দেখায় বিএসএফ। তাদের গুলিতে নিরীহ ৪১ জন বাংলাদেশীর রক্তে রঞ্জিত হয় সীমান্ত এলাকা।
তবে, গত এক দশকের খুনের সব রেকর্ড করোনা মহামারীর বছর ভেঙ্গেছে বিএসএফ।
শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকীর বছরে ভারত তাদের কর্তৃত্ববাদী আচরণ দেখাতে সীমান্ত এলাকায় (১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত) ৪৫ জনকে হত্যা করে। বাংলাদেশের বিজয় দিবসেও সীমান্ত এলাকা রক্তে রঞ্জিত হয় এক বাংলাদেশী তরুণের তাজা রক্তে।
সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশী তরুণের মৃত্যুর পরদিনই গুজরাটের কসাই বলে পরিচিত ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে ভার্চুয়াল সম্মেলনে যোগ দেন শেখ হাসিনা। এই বৈঠককে ‘বন্ধনের সোনালি অধ্যায়’ বলেও অভিহিত করেন হিন্দুত্ববাদী মোদীর বন্ধু শেখ হাসিনা।
আওয়ামী লীগ নেত্রীর সাথে বৈঠকের আগের দিন সীমান্তে বাংলাদেশীকে ঠাণ্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করার মাধ্যমে বাংলাদেশের ওপর নিজেদের কর্তৃত্ববাদী চরিত্র ইচ্ছাকৃত জাহির করার চেষ্টা করেছে ভারত।
নির্মম সেই হত্যাকাণ্ডের পরদিন ভারতের পক্ষেই নির্লজ্জ সাফাই গান বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। তিনি বলেন, ‘সীমান্ত হত্যায় ভারত একতরফাভাবে দায়ী নয়। আমাদের কিছু দুষ্টু ব্যবসায়ী অবৈধভাবে সীমান্তের ওপারে যায় এবং তাদের কাছে অস্ত্র থাকে। তখন ভারত বাধ্য হয়ে ভয়ে ওদের গুলি করে।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের কিছুদিন আগে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেছিলেন, ‘ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। কাঁটাতারের বেড়া কেটে গরু আনতে গিয়ে ইন্ডিয়ার গুলি খেয়ে মারা যায়, তার জন্য দায়-দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকার নেবে না।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও খাদ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিজিবি প্রধান যখন ভারতের প্রতি নতজানু আচরণ দেখান, তখন আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে বিএসএফ। অতীতে এর খেসারত বিভিন্নভাবে দিয়েছে বাংলাদেশে। চলতি বছরের ১০ই নভেম্বর র্যা বের দুই সদস্যকে চড়, ঘুষি ও লাথি মেরে এবং পরে জামাকাপড় ছিঁড়ে টেনে ভারতে নিয়ে যায় বিএসএফ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মারধর খাওয়া র্যা ব সদস্যদের ছবিও প্রকাশ হয়েছিল। বিএসএফ সদস্য কর্তৃক বাংলাদেশে ফেনসিডিল সহ মাদক পাচারের তথ্য সংগ্রহ করতে সীমান্ত এলাকায় বিজিবির সাথে গিয়েছিলেন র্যাবের সদস্যরা।
সীমান্তের সার্বভৌমত্ব রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. সাফিনুল ইসলামকেও প্রতিবাদের পরিবর্তে বিভিন্ন সময় নজতানু ভূমিকায় দেখা গেছে। বাংলাদেশীদের হত্যার প্রতিবাদ বা দেশের সার্বভৌমত্বের পক্ষে অবস্থান নেয়া তো দূরের কথা ভারতের পক্ষেই সাফাই গাইতে শোনা গেছে তাঁকে।
“সন্ত্রাসীরা সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের ভেতরে ঢুকে পড়ছে। সে কারণে বিএসএফ-এর গুলিতে বাংলাদেশী হত্যার ঘটনা ঘটছে”- অতীতে এমন বক্তব্য দিয়ে বিএসএফের খুনের বৈধতা দিয়েছিলেন বিজিবি প্রধান।
সম্প্রতি রাজধানীর পিলখানায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদর দপ্তরে বিজিবি ও বিএসএফের মহাপরিচালক পর্যায়ে সীমান্ত সম্মেলন শেষে বিএসএফ এর মহাপরিচালক রাকেশ আস্থানা সাংবাদিকদের কাছে বলেন যে, সীমান্তে পরিস্থিতি চরমে পৌঁছলে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি রয়েছে তাদের।
অপরদিকে বিজিবি কর্তৃক সরাসরি গুলি করার অনুমোদন নেই বলে জানা গেছে। বিজিবি অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বা আক্রান্ত হলেও ওপরের অনুমতি ছাড়া গুলি ছুঁড়তে মানা। গুলি ছুঁড়তে হলে ওপর মহলের অনুমতি নিতে হয় বিজিবিকে। ফলে বিএসএফ-এর আগ্রাসন প্রতিরোধের পরিবর্তে বিজিবিকে বাংলাদেশী নাগরিক হত্যায় তাদের সহযোগিরূপে দেখা যাচ্ছে।