আবদুল লতিফ মাসুম
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। তপশিল প্রত্যাখ্যান করে অবরোধ-হরতাল চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপি ও তার সহযোগী দলগুলো। এ পরিপ্রেক্ষিতে নতুন যে রাজনৈতিক পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছে, সে সম্পর্কে কথা বলেছেন দু’জন অধ্যাপক।
বুধবার নির্বাচন কমিশন যেভাবে তপশিল ঘোষণা করল, এর মাধ্যমে তারা প্রকারান্তরে গণবিরোধী ভূমিকা নিয়েছে। গোটা জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে তাদের এই তপশিল ঘোষণা বেপরোয়া আচরণেরই নামান্তর। তারা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কথা বলছে বটে, কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, সংবিধান মানুষের জন্য; সংবিধানের জন্য মানুষ নয়। অতীতেও এমন সাংবিধানিক সংকট তৈরি হয়েছিল। জাতীয় সংকট থেকে উত্তরণে যদি জাতীয় জনমত তৈরি হয়, কোনো কিছুই অসম্ভব নয়।
দেশের জনসাধারণ এই সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। লাখ লাখ মানুষের জমায়েত আমরা দেখেছি। নির্বাচন কমিশনের জন্য সেটা একটা বিবেচ্য বিষয় ছিল। নির্বাচনের জন্য পরিবেশ জরুরি। বর্তমানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অফিসের অবস্থা কী, আর বিএনপির অফিসের অবস্থা কী? একদিকে জমজমাট, উৎসবমুখর অবস্থা। অন্যদিকে বিএনপি অফিসের সামনে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। সেখানে গেলে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। তার মানে, নির্বাচন কমিশন সরকারের আজ্ঞাবহ এবং ২০১৪ ও ’১৮ সালে যে নির্বাচন হয়েছে; এমন একটি নির্বাচনের নীলনকশা নিয়ে তারা এগোচ্ছে, যেটি আইন ও নীতিগতভাবে সমর্থনযোগ্য নয়।
সংকটের মূল যদি আমরা দেখি। সংবিধান বিশেষজ্ঞ-আইনবেত্তারা বলছেন, পদ্ধতিগতভাবে পঞ্চদশ সংশোধনী যেভাবে হয়েছে, অর্থাৎ যে সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার হলো, সেটা পদ্ধিতগতভাবে বেআইনি হয়েছে। সে ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ করলে সংশোধনীটা বাতিল হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু সেটা হয়নি। কারণ সরকারের সদিচ্ছা ছিল না।
এই সদিচ্ছার অভাব এখন পর্যন্ত আমরা দেখে আসছি। কেন্দ্রীয় নেতাদেরসহ সারাদেশে বিরোধী দলের নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সংলাপ করার মতো মানুষ আর বাকি নেই। আমার বাড়ি এক প্রত্যন্ত গ্রামে, যেখানে কোনো উত্তেজনার অবকাশ নেই। সেখানে গ্রাম পর্যায়ে, ইউনিয়ন পর্যায়ে বিএনপি নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। হাজার হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ অবস্থায় নৈতিক কিংবা আইনগতভাবে কীভাবে নির্বাচন হতে পারে? নির্বাচন কমিশন সবই জানে। এর পরও তারা মেরুদণ্ডহীনভাবে যেভাবে এ তপশিল ঘোষণা করল, তা জাতির জন্য
অত্যন্ত দুঃখজনক।
২০১৪ সালে এমন একতরফা নির্বাচন আমরা দেখেছি। সে সময় খোলা মাঠে গোল দেওয়ার আয়োজন সম্পন্ন করেছিল আওয়ামী লীগ। ১৫৩ আসনে ভোটই হয়নি। অন্য আসনগুলোতেও নামমাত্র নির্বাচন হয়েছে। জাতীয় পার্টি মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার প্রার্থিতা প্রত্যাহারের পরও নির্বাচিত হন। এমন নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির সামনে বলেছিলেন, এটি নিয়ম রক্ষার নির্বাচন; সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার নির্বাচন। আরেকটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা হবে। কিন্তু তিনি কি সেই কথা রক্ষা করেছিলেন? করেননি। ২০১৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচনও আমরা দেখেছি। মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। জাতি আবারও সংকটের মধ্যে পড়ে।
এর পর বিএনপিকে এমনকি আন্দোলন করতে দেওয়া হয়নি। তারপর আমরা দেখলাম বিদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক শক্তি আহ্বান জানিয়ে আসছিল। তারা দেশের মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। অবশেষে বিএনপি যখনই মাঠে নেমেছে, তাদের বাধা দেওয়া হয়েছে। ২৮ অক্টোবর আমরা যা দেখলাম, লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে বিএনপি সমাবেশ করেছে। সেখানে সরকার এজেন্ট লুকিয়ে অন্যায়ভাবে শক্তি প্রয়োগের উপলক্ষ তৈরি করে। তারা সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাস দিয়ে সভা ভন্ডুল করে। অথচ সভা-সমাবেশ মৌলিক অধিকার। সেই অধিকারও সরকার বিএনপিকে দেয়নি। সবাই দেখেছে, আওয়ামী লীগ কীভাবে ম্যাকিয়াভেলির পথে বা চাণক্যের নীতি নিয়ে রাজনীতি করছে। বিএনপি যাতে সভা থেকে সুফল পেতে না পারে, সে জন্য তারা বল প্রয়োগের পন্থা অবলম্বন করে। উল্টো তারা বলে বেড়াচ্ছে, বিএনপি সন্ত্রাসী শক্তি। বস্তুত আওয়ামী লীগ আইন কিংবা নীতি-নৈতিকতার কোনো তোয়াক্কা করছে না। যুক্তরাষ্ট্রের ডোনাল্ড লু সংলাপের চিঠি দিয়েছেন। সেটাও তারা অগ্রাহ্য করছে।
কিছুরই তারা তোয়াক্কা করছে না। এর মাধ্যমে তারা বহির্বিশ্বে বাংলাদেশকে খেলার মাঠে পরিণত করেছে।
গোটা জাতি এখন একটি বিশ্বাস-অবিশ্বাসের সন্ধিক্ষণে। প্রধানমন্ত্রী বারবার জাতিকে আশ্বস্ত করছেন– নির্বাচনটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে।
অথচ অতীতের দৃষ্টান্তে দেখা যায়, আওয়ামী লীগের অধীনে কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয়নি। গত দুটি নির্বাচনের কথা কিছুটা বলেছি। ২০১৪ ও ’১৮ সালের নির্বাচনে মানুষ প্রতারণার শিকার হয়েছে।
আমরা মনে করি, সম্ভাবনা একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। এখনও তপশিল পিছিয়ে দিয়ে সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতার পথ বের করা কঠিন নয়। শাসক দল ইচ্ছা করলে কিংবা প্রধানমন্ত্রী চাইলে একটি উপায় বের করতে পারেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার, জাতীয় সরকার বা অস্থায়ী সরকার, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার– যাই বলুক না কেন, একটি ব্যবস্থার মাধ্যমে নির্বাচনের আয়োজন করে সরকার জাতিকে আশ্বস্ত করতে পারে। ২০১৪ সালে যেমন একটা প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল– শেখ হাসিনাই প্রধানমন্ত্রী থাকবেন, কিন্তু অন্য মন্ত্রণালয়গুলো বিএনপিসহ অন্যান্য দলের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে এ অন্তর্বর্তীকালে পরিচালিত হবে। কিংবা প্রধানমন্ত্রী ছুটিতে গেলে তাঁর জায়গায় অন্য কেউ দায়িত্ব পালন করবেন। তাঁর বিশ্বস্ত মানুষ কেউ প্রধানমন্ত্রিত্বের দায়িত্ব পালন করুন এবং সব দলের সমন্বয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মাধ্যমে নির্বাচন হোক। দেশের নাগরিক অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। তারা এক দুঃসহ সময় অতিক্রম করছে। মানুষ সংঘাত দেখতে চায় না। সমঝোতার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ ব্যবস্থার দায় দেশের প্রধানমন্ত্রী ও অভিভাবক হিসেবে শেখ হাসিনার ওপর বর্তায়। আমরা এখনও সে প্রত্যাশাই করছি।
ড. আবদুল লতিফ মাসুম: প্রাক্তন অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়