১ বছরে বিদেশি ঋণ পরিশোধ বেড়েছে সাড়ে ৩২ শতাংশ

কয়েক বছর ধরে সরকারের বিদেশি ঋণ গ্রহণের পরিমাণ দ্রুত বাড়ছে। এর মধ্যে কঠিন শর্তের ঋণ অন্যতম। তুলনামূলক কম মেয়াদি ও উচ্চ সুদের এসব ঋণের বিষয়ে বারবার সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে তা উপেক্ষা করেই বায়ার্স বা সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট নামে এসেছে এসব ঋণ। এতে ২০২২-২৩ অর্থবছর সরকারের ঋণ পরিশোধ (ডেট সার্ভিসিং) বেড়ে গেছে ৩২ শতাংশের বেশি। যদিও শুধু ঋণের সুদ পরিশোধ ব্যয়ই দ্বিগুণ হয়েছে।

কয়েকজন অর্থনীতিবিদ পূর্বাভাস দিয়েছিলেন, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সরকারের বিদেশি ঋণ পরিশোধ পাঁচ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করবে। তবে দুই বছর আগেই তা পৌনে পাঁচ বিলিয়ন ছাড়িয়েছে। এজন্য মূলত দায়ী করা হচ্ছে কঠিন শর্তের ঋণের উচ্চ সুদহারকে। কারণ এসব ঋণের সুদহার সোফরের সঙ্গে দুই বা তিন শতাংশ যোগ করে নির্ধারণ করা হয়। আর গত অর্থবছর সুদের আন্তর্জাতিক হার সোফর (সিকিউরড ওভারনাইট ফাইন্যান্সিং রেট) বেড়ে প্রায় তিনগুণ হয়েছে।

গত অর্থবছরের শেষদিকে (২০২৩ সালের জুনে) সোফর পাঁচ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। অথচ অর্থবছরের শুরুতে (২০২২ সালের জুলাইয়ে) এ হার ছিল দেড় শতাংশের কিছু ওপরে। সোফরের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির ফলে বায়ার্স ও সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটের সুদহার অনেক বেড়ে গেছে। বর্তমানে সোফর আরও কিছুটা বেড়েছে। এতে চলতি অর্থবছর সরকারের ঋণ পরিশোধ ব্যয় ছয় বিলিয়ন ছুঁতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এদিকে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি কমায় ২০২১-২২ অর্থবছর বিদেশি ঋণ গ্রহণে কিছুটা ধীরগতি এসেছিল। তবে চলমান ও নতুন বিভিন্ন প্রকল্পে গত অর্থবছর বিদেশি ঋণ নেয়ার হার বেড়েছে। পাশাপাশি জ্বালানি তেল কেনা ও বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে সভরেন গ্যারান্টিযুক্ত বিদেশি ঋণগ্রহণ বেড়েছে। ফলে সার্বিকভাবে গত অর্থবছর আবারও বিদেশি ঋণ গ্রহণের হার বেড়েছে।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে সরকারের বিদেশি ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৭০ দশমিক ৭৬৭ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব ঋণের স্থিতি ছিল ৬২ দশমিক ৪০৬ বিলিয়ন ডলার এবং সভরেন গ্যারান্টিযুক্ত ঋণের স্থিতি ছিল ৮ দশমিক ৩৬১ বিলিয়ন ডলার। মূলত উড়োজাহাজ, জ্বালানি তেল ও সার কেনা এবং বিদ্যুৎ খাত ও আইএমএফের ঋণে সরকারের সভরেন গ্যারান্টি রয়েছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতেই সভরেন গ্যারান্টি রয়েছে পাঁচ দশমিক ২৩৯ বিলিয়ন ডলার।

এদিকে ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে সরকারের বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ৬৩ দশমিক ৫১৯ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব ঋণের স্থিতি ছিল ৫৫ দশমিক ৬০২ বিলিয়ন ডলার এবং সভরেন গ্যারান্টিযুক্ত ঋণের স্থিতি ছিল ৭ দশমিক ৯১৭ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ গত অর্থবছর সরকারের বিদেশি ঋণ বেড়েছে ৭ দশমিক ২৪৮ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ৬ দশমিক ৮০৪ বিলিয়ন বেড়েছে সরকারের নিজস্ব ঋণ। বাকি ১ দশমিক ১১৩ বিলিয়ন ডলার বেড়েছে সভরেন গ্যারান্টিযুক্ত ঋণ।

গত অর্থবছর শেষে বহুপক্ষীয় (মাল্টিলেটারাল) উৎস থেকে গৃহীত ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ৩৭ দশমিক ২৪৯ বিলিয়ন ডলার, আগের অর্থবছর যা ছিল ৩৩ দশমিক ৯২০ বিলিয়ন ডলার। আর দ্বিপক্ষীয় (বাইলেটারাল) উৎস থেকে গৃহীত ঋণ গত অর্থবছর শেষে দাঁড়িয়েছে ২৫ দশমিক ১৫৭ বিলিয়ন ডলার। আগের অর্থবছর এর পরিমাণ ছিল ২১ দশমিক ৬৮২ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ বিদায়ী অর্থবছর শেষে বহুপক্ষীয় উৎসের ঋণ দাঁড়িয়েছে ৬৪ দশমিক ৪৫ শতাংশ এবং দ্বিপক্ষীয় উৎসের ঋণ ৩৫ দশমিক ৫৫ শতাংশ।

ইআরডির তথ্যমতে, গত অর্থবছর সরকারের ঋণ পরিশোধের (আসল ও সুদ) পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ দশমিক ৭৭৯ বিলিয়ন ডলার। আগের অর্থবছর এর পরিমাণ ছিল ৩ দশমিক ৬১০ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ গত অর্থবছর বিদেশি ঋণ পরিশোধ বেড়েছে ১ দশমিক ১৬৯ বিলিয়ন ডলার বা ৩২ দশমিক ৩৮ শতাংশ। গত অর্থবছর ঋণ শোধের মধ্যে আসল ছিল ৩ দশমিক ৪৭৩ বিলিয়ন ডলার, যা আগের অর্থবছর ছিল ২ দশমিক ৯৫৪ বিলিয়ন ডলার। এ হিসাবে আসল পরিশোধ বেড়েছে ৫১৯ মিলিয়ন ডলার বা ১৭ দশমিক ৫৭ শতাংশ।

অন্যদিকে গত অর্থবছর সরকারকে বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ করতে হয় ১ দশমিক ৩০৬ বিলিয়ন ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছর এর পরিমাণ ছিল ৬৫৬ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে সুদ পরিশোধ ব্যয় প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। অথচ এর আগে চার বছরের ব্যবধানে সুদ পরিশোধ ব্যয় বেড়েছিল ৬৯ শতাংশ। এর মধ্যে ২০১৭-১৮ অর্থবছর সুদ পরিশোধ ব্যয় ছিল মাত্র ৩৮৮ মিলিয়ন ডলার।

জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমরা ২০২২ সালেই বলেছিলাম যে, বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ পরিস্থিতি বিপজ্জনক পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। আমরা এও বলেছিলাম যে, ২০২৪ সালের পর থেকে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হবে, যা রিজার্ভের ওপর অনেক বেশি বিরূপ প্রভাব ফেলবে। কিন্তু আমাদের সে বক্তব্যকে সরকারের নীতিপ্রণেতারা তখন গুরুত্ব দেননি এবং নানা যুক্তি দিয়ে তারা বুঝিয়েছিলেন যে, বিদেশি ঋণ নিয়ে বাংলাদেশের কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু প্রকৃত অর্থে এখন সমস্যা হচ্ছে এবং ঋণ পরিশোধের চাপ সামলানোর জন্য আমদানি সংকোচন করতে হচ্ছে। এ পরিস্থতির জন্য ওইসব নীতিপ্রণেতাই দায়ী। এখন তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত।’

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ পরিস্থিতির স্থিতিশীলতা (ডেট সাসটেইনেবিলিটি) এখন পুনর্মূল্যায়ন করা প্রয়োজন এবং সেই মূল্যায়নের ভিত্তিতেই আগামী দিনে ঋণগ্রহণের সীমা নির্ধারণ করা উচিত। বিদ্যমান ব্যবস্থা চলতে থাকলে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

সরকারের কয়েক বছরের ঋণের চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছর সরকারের বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ৩৮ দশমিক ২৩৬ বিলিয়ন ডলার। ২০১৮-১৯ তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৪ দশমিক ৪৭৯ বিলিয়ন ডলার। ওই অর্থবছর ঋণের স্থিতি বৃদ্ধি পায় ৬ দশমিক ২৪৩ বিলিয়ন ডলার বা ১৬ দশমিক ৩৩ শতাংশ। পরের অর্থবছর ঋণের স্থিতি বৃদ্ধির হার ছিল ১৪ দশমিক ৯৫ শতাংশ। এতে ২০১৯-২০ অর্থবছর বিদেশি ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ৫১ দশমিক ১২৭ বিলিয়ন ডলার।

করোনার কারণে ২০২১-২২ অর্থবছর সীমিত পরিসরে চলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। এর পরও ওই অর্থবছর বিদেশি ঋণ বৃদ্ধির হার ছিল সবচেয়ে বেশি। সে বছর বিদেশি ঋণের স্থিতি বাড়ে ৯ দশমিক ০২৬ বিলিয়ন ডলার বা ১৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এতে ২০২০-২১ অর্থবছর শেষে বিদেশি ঋণের স্থিতি বেড়ে দাঁড়ায় ৬০ দশমিক ১৫৩ বিলিয়ন ডলার।

২০২১-২২ অর্থবছর বিদেশি ঋণের স্থিতি বাড়ে মাত্র ৩ দশমিক ৩৬৬ বিলিয়ন ডলার বা পাঁচ দশমিক ৬০ শতাংশ। এতে ঋণের ওই অর্থবছর স্থিতি দাঁড়ায় ৬৩ দশমিক ৫১৯ বিলিয়ন ডলার। আর গত অর্থবছর বিদেশি স্থিতি বাড়ে ১১ দশমিক ৪১ শতাংশ।

বিদেশি ঋণ গ্রহণ গত কয়েক বছর দ্রুত বাড়ায় এখন তা পরিশোধের চাপও বাড়াচ্ছে। ইআরডির তথ্যমতে, ২০১৭-১৮ অর্থবছর সরকারের বিদেশি ঋণ শোধের পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ১৯৮ বিলিয়ন ডলার। পরের অর্থবছর তা বেড়ে হয় ২ দশমিক ৮২৩ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এক বছরে পরিশোধ বাড়ে ২৮ দশমিক ৪৩ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছর বিদেশি ঋণ আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৩ দশমিক ১৬১ বিলিয়ন ডলার, ২০২০-২১ অর্থবছর ৩ দশমিক ২৯৮ বিলিয়ন ডলার এবং ২০২১-২২ অর্থবছর ৩ দশমিক ৬১০ বিলিয়ন ডলার। এ হিসাবে পাঁচ বছরের ব্যবধানে সরকারের বিদেশি ঋণের স্থিতি বেড়েছে ৮৫ দশমিক ০৮ শতাংশ এবং পরিশোধ বেড়েছে ১১৭ দশমিক ৪২ শতাংশ।

sharebiz