১০ দিনে ভোটকেন্দ্রিক ৩৪৫ ঘটনা, ৭ জনের মৃত্যু

জিল্লুর রহমান হত্যার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। এ সময় স্থানীয় বাসিন্দারা ভিড় করেন। ৭ জানুয়ারি মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার মিরকাদিম পৌরসভার টেঙ্গর এলাকায়
জিল্লুর রহমান হত্যার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। এ সময় স্থানীয় বাসিন্দারা ভিড় করেন। ৭ জানুয়ারি মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার মিরকাদিম পৌরসভার টেঙ্গর এলাকায়ফাইল ছবি: প্রথম আলো

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন থেকে পরবর্তী ১০ দিনে ভোটকেন্দ্রিক সংঘাতে সাতজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন পুলিশের আট সদস্যসহ সাড়ে চার শতাধিক ব্যক্তি।সরকারের এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। ভোটের দিন ৭ জানুয়ারি থেকে ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত মোট ৩৪৫টি সংঘাতে এসব হতাহতের ঘটনা ঘটে।

এদিকে বেসরকারি সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) গত বুধবার জানিয়েছে, গত ১৫ নভেম্বর সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত দুই মাসে নির্বাচনী সহিংসতায় অন্তত ১৫ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ২ হাজার ২০০ জনের বেশি।

সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, সারা দেশের প্রায় সব কটি সংঘাতের ঘটনাই ঘটেছে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে। এই স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রায় সবাই ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা।

এদিকে সংসদ নির্বাচন ঘিরে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী রাখার কৌশলের প্রেক্ষাপটে দলের তৃণমূলে কোন্দল-বিরোধ বেড়েছে। ৭ জানুয়ারি চট্টগ্রামের লোহাগাড়া এবং সাতকানিয়ায় সাত বছরের শিশুর ভোট দেওয়ার বিষয়টিও বিব্রত করেছে আওয়ামী লীগকে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানফাইল ছবি

 

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন। দলের সাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে নিয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা বিভিন্ন জেলা সফর করবেন। এই সফরের মাধ্যমে তৃণমূলে বিভেদ মিটিয়ে ঐক্য সৃষ্টি হবে বলে আশা করছি। এ ছাড়া সংঘাত বন্ধে আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সুনির্দিষ্ট কিছু নির্দেশনা দিয়েছি।’

সংঘর্ষে নিহত

মুন্সিগঞ্জ–৩ আসনে ভোটকেন্দ্রের পাশে নৌকার প্রার্থীর সমর্থক মো. জিল্লুর রহমানকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তাঁর মরদেহ ঘিরে মুন্সিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে তিন মেয়ের আহাজারি।
মুন্সিগঞ্জ–৩ আসনে ভোটকেন্দ্রের পাশে নৌকার প্রার্থীর সমর্থক মো. জিল্লুর রহমানকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তাঁর মরদেহ ঘিরে মুন্সিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে তিন মেয়ের আহাজারি।ছবি: সুমন ইউসুফ

ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলার সিদ্ধকাঠি ইউনিয়নের স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি কাজী ফুয়াদকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। কুমিল্লার দেবীদ্বারের গুনাইঘর দক্ষিণ ইউনিয়নে নৌকা ও ঈগল প্রতীকের সমর্থকদের মধ্যে মারামারি হয়। ওই মারামারিতে নৌকা প্রতীকের সমর্থক নওয়াব আলী নিহত হন। মুন্সিগঞ্জ সদর-গজারিয়ার মিরকাদিম পৌরসভার রিকাবী বাজারের টেংগর এলাকায় জিল্লুর রহমানকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তিনি নৌকার সমর্থক ছিলেন। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে ভোটের দিন থেকে পরের ১০ দিনে সব মিলে সাতজন নিহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।

গুলিবিদ্ধ, আহত ও জখম

যশোর-৫ (মনিরামপুর) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর ঈগল প্রতীকের কর্মী সাধন কুমার বিশ্বাস
যশোর-৫ (মনিরামপুর) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর ঈগল প্রতীকের কর্মী সাধন কুমার বিশ্বাসছবি: সংগৃহীত

যশোরের মনিরামপুরে ঈগল প্রতীকের সমর্থক মশিয়ার রহমান নৌকার সমর্থক হাবিবুর রহমানকে আঘাত করেন। যশোরের শংকরপুর বিদ্যালয়ে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয় এবং একজন আনসার সদস্য আহত হন। পিরোজপুর মঠবাড়িয়ার স্বতন্ত্র প্রার্থী রুস্তম আলী ফরাজীর দুজন সমর্থককে পিটিয়ে আহত করা হয়। লালমনিরহাটে সংঘর্ষে নৌকা প্রতীকের দুজন ও ঈগল প্রতীকের একজন আহত হন। চট্টগ্রামে খুলশী থানায় নৌকা প্রতীক এবং ফুলকপি প্রতীকের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে একজন গুলিবিদ্ধ হন। লালমনিরহাটের পাটগ্রাম থানায় ভোটকেন্দ্রের নৌকা প্রতীকের সমর্থকেরা ঈগল প্রতীকের ওপর হামলা করেন। এতে ঈগলের সমর্থক তাহিজুল ইসলাম আহত হন। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে।

ভোট ছিনতাই ও অনিয়ম

নরসিংদীর বেলাব-সল্লাবাদ ইউনিয়নের ইব্রাহিমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভোটকেন্দ্র থেকে দুর্বৃত্তরা ১ হাজার ২০০ ব্যালট পেপার জোর করে ছিনতাই করে নিয়ে যায়। নাটোরের সিংড়া থানার সোনাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১১ জন ভুয়া এজেন্টকে গ্রেপ্তার করা হয়। ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে জাল ভোট দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। ফেনীর সোনাগাজীতে জাল ভোট দেওয়ার অভিযোগে উপজেলার ওলামা বাজার কেন্দ্রের ভোট স্থগিত করা হয়। কিশোরগঞ্জের ভৈরব-কুলিয়ারচরে ভোটকেন্দ্রে অনিয়মের কারণে ভোট গ্রহণ স্থগিত হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে জাল ভোট দেওয়ার কারণে একজনকে সাত দিনের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। বরিশালের মুলাদীতে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা দুই হাজার ভোট দেওয়ার সুযোগ করে দেন। অন্যদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানায় ব্যালটে সিল মেরে বাক্স ভর্তি করা হয়।

মারামারি-সংঘর্ষ

মাদারীপুর সদর ও কালকিনিতে ভোটকেন্দ্র দখল নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবদুস সোবহান গোলাপের সমর্থক বাধা সৃষ্টি করেন। পরে ঈগল প্রতীকের তাহমিনা বেগমের সমর্থক প্রতিবাদ করলে দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় চারজন আহত হন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটি কেন্দ্রে বুধল ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হক প্রকাশ্য ভোট দেন এবং ছবি তুলে তা ফেসবুকে দেন। সুনামগঞ্জের ছাতকের স্বতন্ত্র প্রার্থী শামিম আহমদ চৌধুরী ঈগল প্রতীকের সমর্থক কেন্দ্রে ঢুকতে গেলে নৌকার সমর্থক বাধা দেন, এতে তাঁদের মধ্যে হাতাহাতি হয়। বগুড়ার সোনাতলায় ঈগল প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমানের ওপর হামলা হয়।

ককটেল বিস্ফোরণ ও বোমা হামলা

মাদারীপুরে বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থী তাহমিনা বেগমের বিজয় মিছিল বের হওয়ার পর বোমা হামলায় আটজন আহত হন। লালমনিরহাটের পাটগ্রামে বুড়িমারী বাজার এলাকায় ও ভোটকেন্দ্রে ককটেল ফাটানো হয়। ভোটের দিন টাঙ্গাইল সদরের আওতাধীন ভোটকেন্দ্রে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। লালমনিরহাটের পাটগ্রামের তিনটি ভোটকেন্দ্রে আগুন দেওয়া হয়। সাতকানিয়ায় ভোটকেন্দ্রে ককটেল বিস্ফোরিত হয়। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়রের বাড়িতে হামলা ও ককটেল নিক্ষেপ করা হয়।

হামলা ও ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগ

গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, চট্টগ্রামের পটিয়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পোলিং এজেন্টদের ভয় দেখানোর অভিযোগ করা হয়েছে। কুষ্টিয়া সদরে ৩ নম্বর ওয়ার্ড আলিয়া মাদ্রাসায় নৌকার কর্মীরা ঈগলের কর্মীদের পোলিং এজেন্টের কাগজপত্র ছিঁড়ে হয়রানির অভিযোগ রয়েছে। চট্টগ্রামের চান্দগাঁওয়ে বিএনপির লোকজন এসে হামলা করেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, এবারের সংঘাতের প্রায় সব ঘটনাই ঘটেছে নৌকা প্রতীক এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে। নির্বাচনে অন্তত ২২০টি আসনে সাড়ে তিন শর বেশি স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন। এর মধ্যে ৬২ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জিতেছেন, অনেক আসনেই হেরেছেন নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা। ধারণা ছিল, যেহেতু বিএনপি এই নির্বাচনে আসেনি, সেহেতু হানাহানি কম হবে। বাস্তবতা হলো সংঘাতের ঘটনা ঘটছে। কোনো কোনো এলাকায় সংখ্যালঘু পরিবারকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।

বেসরকারি সংগঠন এইচআরএসএস জানিয়েছে, সংসদ নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে দেশের অন্তত ৩৯টি জেলায় সংঘর্ষ, সংঘাত, হত্যা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় নিহত হয়েছেন অন্তত ৫ জন। এ ছাড়া ৪৫০ জনের বেশি আহত, ৬০ জনের বেশি গুলিবিদ্ধ, ৩০০টির বেশি ঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। ভোট দেননি এমন কিছু মানুষের ওপর ও তাঁদের বাড়িতে হামলা হয়েছে।

প্রথম আলো