১০ ডিসেম্বর ২০২২
নিজস্ব প্রতিনিধি
রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও দলীয় গুণ্ডা-সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করে নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরির পরও রাজধানীর গোলাপবাগ মাঠে অনুষ্ঠিত বিএনপি’র মহাসমাবেশে লাখো মানুষের সমাগম ঘটেছিল। বিএনপি’র নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে পূর্ব নির্ধারিত সমাবেশ করতে দেয়নি ফ্যাসিবাদি শেখ হাসিনার সরকার। নানা নাটকীয়তার পর গোলাপবাগ মাঠে সমাবেশের জন্য অনুমোদন দেয় পুলিশ। শুক্রবার বিকালে অনুমোদনের পরপরই বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মত গোলাপবাগ মাঠে ছুটে আসেন বিএনপি নেতা-কর্মীরা। একপর্যায়ে রাতেই মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। সকালে সমাবেশের বিস্তৃতি ছড়িয়ে পড়ে গোলাপবাগ থেকে একদিকে সায়েদাবাদ অতিক্রম করে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত। অপরদিকে কমলাপুর পর্যন্ত সমাবেশ তিল ধারণের ঠাই ছিল না। পুরো এলাকা জুড়ে ৮ কিলোমিটার রাস্তা জুড়ে জনসমুদ্র তৈরি হয়।
ঢাকার রাজপথে এতবড় সমাবেশ নিকট অতীতে দেখা যায়নি। যদিও সমাবেশের আগে বিএনপি’র কেন্দ্রীয় পুলিশি কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে একজনকে নিহত ও শতাধিক লোক আহত করা হয়েছিল। আটক করা হয়েছে বিএনপি’র শতাধিক নেতাকে। পরের দিন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে গ্রেফতার হয় তাদের বাড়ি থেকে। ঢাকার আশে-পাশের জেলা গলোর নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি পুলিশ হানা দিয়ে গ্রেফতার করেছে অনেককে। এরকম নানা প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করেই নেতাকর্মীরা বিএনপি’র মহাসমাবেশকে জনসমুদ্রে পরিণত করেছিল।
জনসমুদ্রে রূপ নেওয়া এই মহাসমাবেশে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপি’র সভাপতি আমান উল্লাহ আমান। প্রধান অতিথি হিসাবে বক্তব্য রাখেন বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। এছাড়া দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং অঙ্গ সংগঠনের সিনিয়র নেতারা সমাবেশে বক্তব্য রাখেন।
সকাল ১১টায় সমাবেশ শুরুর আগেই ঢাকার গোলাপবাগ এলাকা লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠে। বিশাল এই জনসমুদ্রে শেখ হাসিনার সাজানো সংসদ থেকে বিএনপি’র ৭জন সদস্য পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। এছাড়া প্রধান অতিথির বক্তব্যে ১০ দফা দাবী পেশ করা হয়েছে। যদিও নেতাকর্মীদের দাবী ছিল শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদ পতনের জন্য একদফা দাবীতে কর্মসূচি। কিন্ত দলটি ফ্যাসিবাদ পতনের একদফা ঘোষণা না দিয়ে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এই ১০ দফা দাবি আদায়ে আন্দোলন করবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে।
শনিবার (১০ই ডিসেম্বর) বিকেল ৪টার দিকে গণসমাবেশের প্রধান অতিথি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন এই ১০ দফা ঘোষণা করেন।
বিএনপির মিত্র রাজনৈতিক দল ও সংশ্লিষ্ট সব গোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনা করে এ ১০ দফা ঠিক করা হয়েছে বলেও জানান খন্দকার মোশাররফ হোসেন।
তিনি বলেন, সরকার আজকের গণসমাবেশে বাধা দেওয়ার জন্য নানান ষড়যন্ত্র করেছে। আমাদের সাড়ে চারশোর বেশি নেতাকর্মীকে আটক করেছে পুলিশ। তবে সব বাধা-বিপত্তি মোকাবিলা করে আজকের ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ সফল হয়েছে।
বিএনপির এই সমাবেশটি আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় সকাল ১০ টা ২০ মিনিটে, যদিও নেতা-কর্মীরা আগের দিন বিকাল ৪টার পর থেকেই ময়দানে যেতে থাকেন।
দীর্ঘ বক্তৃতা-পর্বের মাঝামাঝি সময়ে বগুড়া-৬ আসনের সংসদ সদস্য গোলাম মোহাম্মদ সিরাজ এবং সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা জানান, তাদের দলের সাত সংসদ সদস্য পদত্যাগ করবেন। রোববারই জমা পড়বে তাদের পদত্যাগপত্র।
পরে সমাবেশের প্রধান অতিথি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন ঘোষণা করেন তাদের ১০ দফা দাবি।
গণসমাবেশ থেকে ঘোষিত বিএনপির ১০ দফা:
(১) বর্তমান জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত করে ক্ষমতাসীন সরকারের পদত্যাগ।
(২) ১৯৯৬ সালে সংবিধানে সংযোজিত ধারা ৫৮-খ, গ ও ঘ-এর আলোকে একটি দল নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার বা অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন।
(৩) নির্বাচনকালীন দল নিরপেক্ষ সরকার বা অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার, বর্তমান নির্বাচন কমিশন বাতিল করে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন। সেই নির্বাচন কমিশন অবাধ নির্বাচনের অনিবার্য পূর্বশর্ত হিসেবে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিশ্চিত করতে আরপিও সংশোধন, ইভিএম পদ্ধতি বাতিল ও পেপার ব্যালটের মাধ্যমে ভোটের ব্যবস্থা এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার বাতিল।
(৪) খালেদা জিয়াসহ বিরোধীদলীয় সব নেতাকর্মী, সাংবাদিক এবং আলেমদের সাজা বাতিল। সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও রাজনৈতিক কারাবন্দিদের অনতিবিলম্বে মুক্তি। দেশে সভা, সমাবেশ ও মতপ্রকাশে কোনো বাধা সৃষ্টি না করা। সব দলকে স্বাধীনভাবে গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনে প্রশাসন ও সরকারি দলের কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ বা বাধা সৃষ্টি না করা। স্বৈরাচারী কায়দায় বিরোধী কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করার লক্ষ্যে নতুন কোনো মামলা ও বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার না করা।
(৫) ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ এবং বিশেষ ক্ষমতা আইন-১৯৭৪ সহ মৌলিক মানবাধিকার হরণকারী আইন বাতিল করা।
(৬) বিদ্যুৎ, জ্বালানি, গ্যাস ও পানিসহ জনসেবা খাতের মূল্যবৃদ্ধির গণবিরোধী সিদ্ধান্ত বাতিল।
(৭) নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনা এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারকে সিন্ডিকেট মুক্ত করা।
(৮) ১৫ বছর ধরে বিদেশে অর্থপাচার, ব্যাংকিং ও আর্থিক খাত, বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাত ও শেয়ার-বাজারসহ রাষ্ট্রীয় সব ক্ষেত্রে সংঘটিত দুর্নীতি চিহ্নিত করতে একটি কমিশন গঠন। দুর্নীতি চিহ্নিত করে দ্রুত যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ।
(৯) গত ১৫ বছরে গুমের শিকার সব নাগরিককে উদ্ধার এবং বিচারবহির্ভূত হত্যা ও রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের প্রতিটি ঘটনার দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করে যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর, উপাসনালয় ভাঙচুর এবং সম্পত্তি দখলের জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ।
(১০) আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসন ও বিচার বিভাগকে সরকারি হস্তক্ষেপ পরিহার করে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ করে দেওয়া।
গোলাপবাগ ওয়ার্মআপ, শেষ যুদ্ধ আসছে:
সমাবেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ঢাকায় তারা যে সমাবেশটি করেছেন, সেটি গা গরমের। সামনে ‘শেষ যুদ্ধ’ হতে চলেছে, আর সেই যুদ্ধে বিএনপি জয়লাভ করবে।
তিনি বলেন, আমরা ১০ টা মিটিং করেছি। আজকে শেষ মিটিং। এই মিটিংকে আমরা বলব, আমরা ওয়ার্মআপ করেছি। আজকের সমাবেশ থেকে আমাদের প্রধান অতিথি সরকার পতনের ১০ দফা ঘোষণা করবেন। পরবর্তী কর্মসূচির রূপরেখা ঘোষণা হবে। তারপর থেকে শুরু হবে রাজপথের সংগ্রাম। এর পরে হবে আমাদের শেষ যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে আমরা জয়লাভ করব।
তিনি বলেন, গত ৭ তারিখে আমাদের উপর সরকারের কর্মচারীরা যে হামলা করেছে, তা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের হানাদার বাহিনীর হামলার থেকে কম কিছু না। আমরা বলতে চাই, ক্ষমতা বেশিদিন থাকবে। ইতিহাস পড়েন। শিক্ষা নেন। মানুষ ক্ষেপে গেছে, যত বাধায় দেন, যত গুলিই করেন, মানুষের কাছে সেটা কিছুই না। যার কারণে কাল অনুমতি পাওয়ার পরপর এই মাঠ কানায় কানায় ভরে গিয়েছিল।
১০ দফার ঘোষণার পর বিএনপি আর পিছু হটবে না জানিয়ে স্থায়ী কমিটির আরক সদস্য সেলিমা রহমান বলেন, আমাদের পার্টি অফিসে হামলা করে, আহত করে, নিহত করে ভয় দেখাতে চেয়েছিল। আমাদের কেউ ভয় পায়নি।
তিনি বলেন, চল চল চল ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল। এই মাদল কে বাজাচ্ছে? এই মাদল বাজাচ্ছেন আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সেই মাদল বাজাচ্ছেন চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। আপনারা সেই ছন্দে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। আপনারা উজ্জীবিত হয়েছেন। এটি ধরে রাখুন। সামনে কাজে লাগব। তারা আমদের যতই খেলে দেয়ার চেষ্টা করুক। এবার কেউ পিছু হটবে না। আজকের ঘোষণার পর একদফা আন্দোলনে যাব। জনগণকে নিয়ে সরকার পতনের লড়াই করে যাব।
স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, আজকে ঢাকায় হরতাল পালন হচ্ছে। এই হরতাল ডেকেছে সরকার। বাস নাই গাড়ি নাই। থমথমে। কী বুঝলেন? এই আওয়ামী সন্ত্রাসীরা হাতে মাল নিয়ে পিকেটিং করছে। এই মাল মানে বুঝেন? এই মাল হলো অস্ত্র। তারা ঢাকার এন্ট্রি গেটে পিকেটিং করছে।
তিনি বলেন, এই পিকেটিং মানুষ কখন করে? হরতাল কখন করে? সরকার কী আছে? সরকার নেই। বাংলাদেশে কোনো সরকার আছে বলে মনে হয় না।
১০ দফা ঘোষণা এলে বুকের রক্ত দিয়ে হলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা করতে বাধ্য করার কথাও বলেন তিনি।
বিএনপি এই সমাবেশটি করতে চেয়েছিল নয়াপল্টনের দলীয় কার্যালয়ের সামনে। কিন্তু পুলিশ তাদেরকে অনুমতি দেয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। সেখানে না গিয়ে অনুমতি ছাড়াই নয়াপল্টনে সমাবেশ করার ঘোষণা দেয়ার পর বুধবার সেখানে নির্মম হামলা চালায় পুলিশ। এতে স্বেচ্ছাসেবক দলের একজন পুলিশের গুলিতে নিহত হন।
এক পর্যায়ে বিএনপি কার্যালয়ে অভিযানে যায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। গ্রেপ্তার করা হয় প্রায় পাঁচ শ নেতা-কর্মীকে, যাদের মধ্যে আছেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
গুম, খুন ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদে এবং দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া, মির্জা আলমগীর, মির্জা আব্বাস সহ মিথ্যা মামলায় গ্রেফতারকৃত নেতা-কর্মীদের মুক্তি ও নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে গত ৮ই অক্টোবর থেকে বিএনপি প্রতিটি বিভাগীয় শহরে ধারাবাহিকভাবে যে সমাবেশ করে আসছে, তার শেষ কর্মসূচি হিসেবে হলো এই জমায়েত।
প্রথমে চট্টগ্রাম, এরপর ময়মনসিংহ, তারপর খুলনা, রংপুর, বরিশাল, ফরিদপুর, কুমিল্লা এবং রাজশাহীতে হয় এই সমাবেশ।