১০০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছল বাংলাদেশের বিদেশী ঋণ

১০০ বিলিয়ন (১০ হাজার কোটি) ডলারে পৌঁছেছে বাংলাদেশের বিদেশী ঋণ। এর মধ্যে সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদেশী ঋণের পরিমাণ ৭৯ বিলিয়ন ডলার। বাকি ২১ বিলিয়ন ডলার বিদেশী ঋণ নিয়েছে দেশের বেসরকারি খাত। বিদেশী বিভিন্ন উৎস থেকে নেয়া ঋণের প্রায় ৮৪ শতাংশ দীর্ঘমেয়াদি। বাকি ১৬ শতাংশ বা ১৬ বিলিয়ন ডলারের ঋণ স্বল্পমেয়াদি। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হালনাগাদকৃত বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদেশী ঋণের পরিসংখ্যানে এ তথ্য উঠে এসেছে।

বিদেশী ঋণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ২০১৮ সালের পর। ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষে বিদেশী ঋণের স্থিতি ৬৮ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকে। ২০২০-২১ অর্থবছরে এ প্রবৃদ্ধি ১৯ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। ওই অর্থবছর শেষে বিদেশী ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ৮১ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলারে। ২০২১-২২ অর্থবছরে বিদেশী ঋণের প্রবৃদ্ধি হয় ১৬ দশমিক ৯ শতাংশ। অর্থবছর শেষে এ ঋণের স্থিতি ৯৫ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। এরপর আন্তর্জাতিক বাজারে সুদহার বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ থেকে বিদেশী অনেক প্রতিষ্ঠান স্বল্পমেয়াদি ঋণ প্রত্যাহার করে নেয়। এতে বিদেশী ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধিও কমে যায়। ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে বিদেশী ঋণের স্থিতি ৯৮ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক শেষে তথা সেপ্টেম্বরে এসে বিদেশী ঋণের স্থিতি ১০০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, প্রতি ত্রৈমাসিক শেষে বিদেশী ঋণসংক্রান্ত প্রতিবেদন গভর্নরের অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হয়। সেপ্টেম্বর প্রান্তিকের এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন এরই মধ্যে গভর্নরের দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। এখনো অনুমোদন না হওয়ায় ঋণের তথ্য প্রকাশ করা যাচ্ছে না। তবে সেপ্টেম্বরে বিদেশী ঋণ ১০০ বিলিয়ন ডলারের ঘর অতিক্রম করেছে। গত এক বছরে দেশের বেসরকারি খাতে কমলেও সরকারের বিদেশী ঋণ বেড়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবায়ন অনুযায়ী, দেশের সরকারি-বেসরকারি বিদেশী ঋণ স্থিতি মোট জিডিপির প্রায় ২২ শতাংশ। ঋণের এ অনুপাতকে অর্থনীতির জন্য মোটেই উদ্বেগজনক নয় বলে মনে করে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, ‘‌বিদেশী ঋণ ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়ালেও দেশের জিডিপির আকারের তুলনায় এটি খুব বেশি নয়। এখনো অনেক বিদেশী ঋণ নেয়ার সক্ষমতা আমাদের রয়েছে। বিশ্ববাজারে সুদহার বাড়ায় দেশের বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ কমে গেছে। এটি না হলে বিদেশী ঋণের স্থিতি অনেক আগেই ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেত।’

তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের এ বক্তব্যের সঙ্গে মোটেও একমত নন অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর। বাংলাদেশের মতো দেশে বিদেশী ঋণ-জিডিপির অনুপাত হিসাব করাই অর্থহীন বলে মনে করেন তিনি। বণিক বার্তাকে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘বাংলাদেশের কর-জিডিপির অনুপাত মাত্র ৮ শতাংশ। এর অর্থ হলো সরকার নিজস্ব আয় দিয়ে ঋণ পরিশোধে সক্ষম না। এজন্য এখানে জিডিপির সঙ্গে ঋণের অনুপাত হিসাব করে কোনো লাভ নেই। বাংলাদেশে ঋণের অনুপাত তুলনা করতে হবে সরকারের রাজস্ব আয়ের সঙ্গে। কোনো দেশের ঋণ-রাজস্ব অনুপাত ২০০-২৫০ শতাংশ পর্যন্ত মেনে নেয়া যায়। কিন্তু বাংলাদেশে ঋণ-রাজস্ব অনুপাত ৪০০ শতাংশের বেশি। সে হিসাবে সরকারের ঋণ বিপজ্জনক মাত্রা অনেক আগেই ছাড়িয়ে গেছে।’

আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘‌বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার নিট রিজার্ভ এখন ১৫ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। বিপরীতে স্বল্পমেয়াদি বিদেশী ঋণ রিজার্ভের চেয়ে বেশি। এদিক থেকেও বিদেশী ঋণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ঝুঁকিপূর্ণ। আগামী বছর থেকে বিদেশী ঋণের কিস্তি পরিশোধের চাপ বাড়তে থাকবে। ডলারের জোগান না বাড়লে পরিস্থিতি খুবই খারাপ দিকে মোড় নিতে পারে।’

সরকারি বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের পাশাপাশি গত এক দশকে বিদ্যুৎ খাতেও বিপুল পরিমাণ বিদেশী ঋণ এসেছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ এসেছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণের জন্য ১১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলারের ঋণ দিয়েছে রাশিয়া। পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ২ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেয়া হয়েছে চীন থেকে। আর রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার ঋণসহায়তা দিয়েছে ভারত। এছাড়া মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ অন্যান্য প্রকল্প ঘিরে জাপান থেকে ৪৩ হাজার ৯২১ কোটি টাকার সমপরিমাণ ঋণসহায়তা নেয়া হচ্ছে। সরকারের পাশাপাশি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও বিদেশী বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ নিচ্ছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদেশী ঋণের স্থিতিও এখন ১২ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এর মধ্যে স্বল্পমেয়াদি বিদেশী ঋণ রয়েছে প্রায় আড়াই বিলিয়ন ডলার।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামী বছর থেকে অনেক মেগা প্রকল্পের ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে। এতে বিদেশী ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বাড়বে। এমনিতেই দেশে ডলারের তীব্র সংকট চলছে। বিদেশী ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ায় আরো বেশি পরিমাণে ডলারের প্রয়োজন হবে। যদিও রেমিট্যান্স, রফতানি আয়সহ দেশে ডলার সংস্থানের উৎসগুলো সংকুচিত হয়ে এসেছে। বিপরীতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্ষয়ও ক্রমাগত বাড়ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৫ নভেম্বর আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী (বিপিএম৬) দেশের রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবে বাংলাদেশের নিট রিজার্ভ এখন ১৫ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রিজার্ভ ছিল ২০২১ সালের আগস্টে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব হিসাবায়ন পদ্ধতি অনুযায়ী, ওই সময় রিজার্ভের পরিমাণ ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। এর পর থেকেই রিজার্ভের ক্ষয় শুরু হয়। গত দুই বছরে প্রতি মাসে গড়ে এক বিলিয়ন ডলার করে রিজার্ভ কমেছে।

দেশের অর্থনৈতিক সংকট তীব্র হয়ে ওঠায় ডলারের বিনিময় হার বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে। গত বছরের জানুয়ারিতেও দেশের ব্যাংক খাতে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল সর্বোচ্চ ৮৫ টাকা। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদিত দর অনুযায়ী প্রতি ডলার ১১১ টাকায় লেনদেন হচ্ছে। যদিও ঘোষিত দরে দেশের ব্যাংকগুলোয় ডলার মিলছে না। আমদানিকারকদের কাছ থেকে ব্যাংকগুলো ডলারপ্রতি ১২৪-১২৫ টাকাও আদায় করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সে হিসাবে এ সময়ে ডলারের বিনিময় হার বেড়েছে প্রায় ৪৭ শতাংশ। আর কার্ব মার্কেটে (খুচরা বাজার) প্রতি ডলারের মূল্য ১২৮ টাকা পর্যন্ত উঠেছে।

ডলার সংকট কমাতে ২০২২-২৩ অর্থবছরের শুরু থেকেই আমদানির লাগাম টেনে ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক। এজন্য ঋণপত্র (এলসি) খোলার শর্ত কঠোর করা হয়। ব্যাংকগুলোও ডলার সংকটের কারণে নিজেদের এলসি খোলা কমিয়ে দেয়। ফলে অর্থবছর শেষে আমদানির পরিমাণ প্রায় ১৬ শতাংশ কমে গেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) আমদানির পরিমাণ ২৩ দশমিক ৯০ শতাংশ কমেছে।

আমদানি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমার পরও দেশে যে পরিমাণ ডলার ঢুকছে, বেরিয়ে যাচ্ছে তার চেয়ে বেশি। এ কারণে ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট বা আর্থিক হিসাবের ঘাটতি বড় হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) আর্থিক হিসাবে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩৯৩ কোটি ডলার। দেশের ইতিহাসে এ পরিমাণ ঘাটতি এর আগে কখনই দেখা যায়নি। আর্থিক হিসাবে ঘাটতি বেড়ে যাওয়ায় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্ষয় থামানো যাচ্ছে না। বরং দিন দিন রিজার্ভের পরিস্থিতি আরো বেশি নাজুক হয়ে উঠছে।

কোনো দেশে আন্তর্জাতিক সম্পদের মালিকানায় হ্রাস-বৃদ্ধির বিষয়টি পরিমাপ করা হয় আর্থিক হিসাবের মাধ্যমে। এ হিসাবে ঘাটতি তৈরি হলে দেশের রিজার্ভ ও বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হারের ওপর চাপ বাড়ে। চলতি শতকের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত বেশির ভাগ সময়ই বাংলাদেশের আর্থিক হিসাব উদ্বৃত্ত ছিল। বিশেষ করে ২০১০ সাল পরবর্তী এক যুগে কখনই আর্থিক হিসাবে ঘাটতি দেখা যায়নি। কিন্তু ডলার সংকট তীব্র হয়ে ওঠায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে আর্থিক হিসাবে বড় ধরনের ঘাটতি তৈরি হয়। গত অর্থবছর শেষে এ ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ২১৪ কোটি ২০ লাখ ডলারে। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে আর্থিক হিসাবে ১ হাজার ৫৪৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার উদ্বৃত্ত ছিল।

তবে এ মুহূর্তে অর্থনীতি নয়, বরং রাজনীতি নিয়েই বেশি ভয় ও শঙ্কা কাজ করছে বলে মনে করেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘‌দেশের অর্থনীতির সার্বিক গতিবিধি অনুযায়ী আমি মোটেই শঙ্কিত নই। অর্থের সংকট চিরস্থায়ী হয় না। আজ ডলার নেই, কাল চলে আসবে, এটিই জগতের নিয়ম। আমরা এরই মধ্যে আইএমএফ থেকে ঋণ নিয়েছি। প্রয়োজনে অন্য উৎস থেকেও ঋণ নেয়া হবে। কিন্তু আমি শঙ্কিত অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে। কলহ ও বিবাদের রাজনীতি যেকোনো দেশের অর্থনীতিকে বিপদে ফেলে দেয়। দেশে এখন হরতাল-অবরোধ আর জ্বালাও-পোড়াওয়ের রাজনীতি চলছে। রাজনীতি স্থিতিশীল না হলে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’

সূত্র : বনিক বার্তা