ক্রেমলিনে ভ্লাদিমির পুতিনের তৃতীয় দফা নির্বাচনের তারিখ ছিল ২০১২ সালের ৪ মার্চ। তার ঠিক আগের মাসে, অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি মাসের ৮ তারিখে রাশিয়ান অর্থোডক্স চার্চের সর্বোচ্চ পুরোহিত প্যাট্রিয়ার্ক কিরিল একটি সভায় পুতিনকে ‘মিরাকল অব গড’ বা ‘ঈশ্বরের কুদরত’ বলে অভিহিত করেছিলেন।
সভাটির আয়োজন করা হয়েছিল মস্কোর প্রাচীন ঐতিহাসিক অর্থোডক্স গির্জা সেন্ট দানিলভ (পশ্চিমারা বলেন, ‘সেন্ট দানিয়েল’) মনাস্ট্রিতে। সেখানে পুতিন ও প্যাট্রিয়ার্ক কিরিল ছাড়াও ইহুদি ও মুসলমানদের ধর্মীয় নেতারাও ছিলেন। সভায় উপস্থিত ছিলেন রাশিয়ার ইহুদি সম্প্রদায়ের প্রধান রাব্বি বেরেল লাজার। ছিলেন, মুসলমানদের শীর্ষস্থানীয় মুফতি রাভিল গাইনুৎদিন এবং উত্তর ককেশাসের শীর্ষস্থানীয় মুফতি ইসমাইল বারদিয়েভ। এ ছাড়া ছিলেন একজন বৌদ্ধ লামা, একজন আর্মেনীয় লামা এবং রোমান ক্যাথলিক ও অন্য খ্রিষ্ট চার্চের প্রতিনিধিরা। ওই সময় পুতিন ক্রেমলিনে তার তৃতীয় মেয়াদের জয়ের জন্য ধর্মীয় নেতাদের সমর্থন চাচ্ছিলেন।
পুতিন চাইলেই এই ধর্মীয় নেতাদের ক্রেমলিনে ডাকতে পারতেন। সেখানেই বৈঠকটি হতে পারত। কিন্তু তিনি তা করেননি। তিনি নিজে এই গির্জায় গিয়েছিলেন। তার মানে এর মধ্য দিয়ে তিনি বিশেষ একটি বার্তা দিতে চেয়েছিলেন।
সভাস্থল হিসেবে যে দানিলভ মনাস্ট্রিকে নির্বাচন করা হয়েছিল, তার বিষয়ে দু’কথা বলা দরকার। ১২৮২ সালে এই মঠ বা আশ্রমটি বানিয়েছিলেন ইতিহাসখ্যাত সাধু প্রিন্স দানিলভ (দানিয়েল)। এই মঠটি অর্থোডক্স খ্রিষ্টান ও রুশ জাতীয়তাবাদীদের কাছে মহাপবিত্র স্থান। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এই মঠের কবরস্থানটি রাশিয়ার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের অন্তিম শয়ানস্থল হয়ে ওঠে। বিশ্বখ্যাত লেখক নিকোলাই গোগল, রুশ কবি নিকোলাই মিখাইলোভিচ ইয়াজিকোভ, রুশ চিত্রশিল্পী ভাসিলি গ্রিগোরেভিচ পেরোভ, রুশ পিয়ানো বাদক ও সংগীতায়োজক নিকোলাই গ্রিগোরিয়েভিচ রুবিনস্তেইন, রুশ দার্শনিক, ধর্মতাত্ত্বিক, কবি ও শিল্প সমালোচক ভ্লাদিমির সেরগিয়েভিচ সোলোভিয়েভসহ অনেককে এখানে সমাধিস্থ করা হয়েছে।
১৯৩০ সালে সোভিয়েত আমলে জোসেফ স্তালিন তাঁর ধর্মবিরোধী প্রচারণার অংশ হিসেবে এই মঠের সব খ্রিষ্ট প্রতীক ভেঙে দিয়েছিলেন। ভবনটিকে যাতে কোনোভাবে খ্রিষ্টান উপাসনালয় বলে চেনা না যায় সেজন্য ভবনের কাঠামো বদলে ফেলা হয়েছিল এবং এটিকে একটি এতিমখানায় রূপ দেওয়া হয়েছিল। ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত ‘রাশিয়ান মংকস ট্রাই টু গেট বেল ব্যাকস’ শিরোনামের একটি প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, স্তালিনের নির্দেশে ওই মঠের ৩ জন সাধু বাদে সব সাধুকে হত্যা করা হয়েছিল। এরপর নানা ঘটনা-দুর্ঘটনার পর ১৯৮৮ সালে এটি আবার অর্থোডক্স মঠ হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা পায়। এটি বর্তমানে রাশিয়ান অর্থোডক্স খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের প্রধান পুরোহিত প্যাট্রিয়ার্ক কিরিলের আবাসস্থল।
সেই দানিলভ মনাস্ট্রিতে নিজের নির্বাচনী প্রচারণার জন্য পুতিন ধর্মগুরুদের সঙ্গে বৈঠক করে তাঁদের আশীর্বাদ চেয়েছিলেন।
শুভ্র শ্মশ্রুমণ্ডিত প্যাট্রিয়ার্ক কিরিল পুতিন ও তাঁর শাসনকে ‘ঈশ্বরের কুদরত’ হিসেবে আখ্যায়িত করে তাঁকে রাশিয়ার অবিসংবাদিত নেতা বলে অভিহিত করেছিলেন। কিরিল বলেছিলেন, ‘একজন প্যাট্রিয়ার্ক (অর্থোডক্স খ্রিষ্টানদের প্রধান পুরোহিতের পদ) হিসেবে আমার খোলাখুলি বলা উচিত যে, আপনি ব্যক্তিগতভাবে আমাদের ইতিহাসের কুটিল মোড়ককে সংশোধন করতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছেন।’ কিরিল বলেছিলেন, পুতিনের যাঁরা বিরোধী, পশ্চিমাদের ভোগবাদী সংস্কৃতি তাঁদের কাছে প্রশংসনীয়। তাঁরাই রাশিয়ার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি।
মুফতি রাভিল গাইনুৎদিন সেদিন পুতিনকে বলেছিলেন, ‘মুসলমানেরা আপনাকে চেনে, মুসলমানেরা আপনাকে বিশ্বাস করে, মুসলমানেরা আপনার সাফল্য চায়।’ উত্তর ককেশাসের শীর্ষস্থানীয় মুফতি ইসমাইল বারদিয়েভ বলেছিলেন, ‘আপনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তার জায়গা দেখিয়ে দিয়েছেন।’
‘ধর্মদ্রোহী’ পুসি রায়ট কি পশ্চিমা এজেন্ট?
এই ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে পুতিন বৈঠক করার দিন কয়েক পর ২১ ফেব্রুয়ারি মস্কোয় ক্রেমলিন থেকে একটু দূরে অবস্থিত অর্থোডক্স খ্রিষ্টানদের উপাসনালয় ক্যাথেড্রাল অব ক্রাইস্ট দ্য সেইভর-এর একেবারে ভেতরে ঢুকে নারীবাদী ব্যান্ড দল পুসি রায়ট গানবাজনা করে একটা হুলুস্থুল কাণ্ড বাঁধিয়ে ফেলে। এ নিয়ে গণমাধ্যমে অনেক দিন হইচই হয়েছিল। সে ঘটনা অনেকেরই মনে থাকার কথা।
মোট ১১ জন নারী পুসি রায়ট নামের এই দলটি গড়ে তুলেছিলেন ২০১১ সালের আগস্টে। পুসি রায়ট কোনো সাধারণ ‘পাঙ্ক রক’ দল নয়। ইন্টারনেটে এদের গানের ভিডিও পাওয়া যায়। তারা মূলত অ্যাকটিভিস্ট। তাদের গানের মূল থিম নারীবাদ ও সমকামিতার অধিকারের পক্ষ এবং অর্থোডক্স চার্চ ও পুতিনের শাসনের বিপক্ষকে কেন্দ্র করে। ক্যাথেড্রাল অব ক্রাইস্ট দ্য সেইভর এর ভেতরে ‘বিধিবহির্ভূত’ পোশাক পরে উদ্দাম ভঙ্গিমায় গান গাওয়ার পর পুসি রায়টের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, পুতিনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অর্থোডক্স চার্চের ধর্মগুরুরা প্রচারণায় নামার প্রতিবাদে তাঁরা সেখানে গান গেয়েছেন।
পরের মাসে, অর্থাৎ মার্চ মাসের ১২ তারিখে পুসি রায়টের দুই সদস্য নাদেজদা তোলোকোন্নিকোভা এবং মারিয়ও আলিওখিনাকে সমাজে নৈরাজ্য ছড়ানোর চেষ্টা এবং খ্রিষ্ট ধর্ম অবমাননার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৬ মার্চ জেকাতেরিনা সামুৎসোভিচ নামের আরেক সদস্যকে আটক করা হয়। এদের পক্ষে তখন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ পশ্চিমা বিশ্বের বহু মানবাধিকার সংগঠন উচ্চকিত হয়েছিল। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। তিনজনেরই জেল হয়েছিল। সামুৎসোভিচ অনুকম্পার আবেদন করে ওই বছরের অক্টোবরে ছাড়া পেলেও বাকি দুজনকে দুই বছর জেল খাটতে হয়েছে।
পুসি রায়ট নিয়ে উইকিপিডিয়া যে সারসংক্ষেপ লিখেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে পুসি রায়টের প্রতি পশ্চিমাদের যতটা সহমর্মিতা আছে, রাশিয়ার সাধারণ মানুষের কাছে সে ধরনের সহমর্মিতা তারা পান না। বিশেষ করে যারা ধর্মপ্রাণ অর্থোডক্স খ্রিষ্টান, তাঁরা এই দলটিকে পশ্চিমা এজেন্ট মনে করেন। তাঁরা মনে করেন, সমকামিতা ও পশ্চিমা ধারার নারীবাদ রাশিয়ায় ঢুকিয়ে ইউরোপ ও আমেরিকার নেতারা রুশ অর্থোডক্স খ্রিষ্টিয়ানিটিকে ভূলুণ্ঠিত করতে চায়। সেই কাজে তারা পুসি রায়টকে ব্যবহার করছে।
এই ধারণা ভুল হোক বা ঠিক হোক, বাস্তবতা হলো পুসি রায়ট নামের এই পাঙ্ক রক গ্রুপটি ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযানের প্রতিবাদে নিউইয়র্কে কনসার্ট করছে। তারা ইউক্রেনের যুদ্ধকবলিত মানুষের জন্য ইতিমধ্যে ৬৭ লাখ ডলার চাঁদা তুলে ফেলেছে। তাদের বিশ্বাস ও দর্শন যে পশ্চিমাদের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ এবং অর্থোডক্স চার্চবিরোধী—এটি একেবারেই স্পষ্ট।
পুতিনের এই যুদ্ধের পেছনে ধর্মীয় আদর্শও কাজ করছে
ভ্লাদিমির পুতিনের ইউক্রেন অভিযান যে শুধুই রাজনৈতিক নয়, এর পেছনে যে অর্থোডক্স খ্রিষ্টিয়ানিটি ও রুশ সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ একটি বিরাট ভূমিকা রাখছে তা যত দিন যাচ্ছে, ততই তা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে।
গত ১০ মার্চ রাশিয়ার অর্থোডক্স খ্রিষ্টানদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা প্যাট্রিয়ার্ক কিরিল সাপ্তাহিক ধর্মীয় বক্তব্য (সারমন) দেওয়ার সময় ইউক্রেনে মস্কোর হামলাকে ‘বিশেষ শান্তি অভিযান’ বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমরা এমন একটি সংগ্রামে প্রবেশ করেছি যা শুধু “ফিজিক্যাল” নয়, এর একটি “ম্যাটাফিজিক্যাল” তাৎপর্য আছে।’ তার মানে তিনি বলতে চাইছেন, শুধুই রাজনৈতিক বা ভূরাজনৈতিক কারণে এই অভিযান চালানো হচ্ছে না। এটি একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠার লড়াই। কিরিল বলেছেন, পশ্চিমারা মানবাধিকারের নামে তাদের মূল্যবোধ রাশিয়ার ওপর চাপিয়ে দিয়ে রাশিয়ার প্রাচ্যমুখী সংস্কৃতি ও অর্থোডক্স ক্রিশ্চিয়ানিটিকে ধ্বংস করতে চায়। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেছেন, পূর্ব ইউক্রেনের দনবাসে সমকামীদের শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়েছে। এটি আয়োজনের পেছনে পশ্চিমাদের সরাসরি হাত রয়েছে।
জার্মানির ইউনিভার্সিটি অব মুনস্টার-এর ইস্টার্ন চার্চেস স্টাডিজ বিষয়ের অধ্যাপক টমাস ব্রেমার সম্প্রতি আল জাজিরাকে বলেছেন, কিরিল আসলে বলতে চেয়েছেন, ইউক্রেনের যুদ্ধের পেছনে পশ্চিম এবং অর্থোডক্স জগতের মধ্যে আধ্যাত্মিক দিক থেকে পার্থক্য রয়েছে এবং এটি স্পষ্ট যে কিরিলের মতে অর্থোডক্স আদর্শ পশ্চিমাদের উদার ভোগবাদী আদর্শের চেয়ে ভালো। সুতরাং কিরিলের মতে, এই যুদ্ধটি রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন বা প্রভাব খাটানো নিয়ে নয়, বরং এটি অনেক বেশি আধ্যাত্মিক বিষয়সংশ্লিষ্ট। এটিকেই তিনি মেটাফিজিক্যাল বা ‘আধিভৌতিক’ লক্ষ্য হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। একইভাবে তিনি সরকারি রাশিয়ান দৃষ্টিকোণকে একটি ধর্মতাত্ত্বিক ভিত্তি দিয়েছেন।
লক্ষ্য করার মতো বিষয় হলো, পুতিন যেভাবে ইউক্রেনকে ‘রাশিয়ার অংশ’ মনে করেন, তেমনি প্যাট্রিয়ার্ক কিরিলও নিজেকে ইউক্রেন এবং বেলারুশের অর্থোডক্স চার্চের অভিভাবক দাবি করেন।
পোপ ফ্রান্সিস কী বলছেন?
অর্থোডক্স খ্রিষ্টানদের প্রধান ধর্মগুরু প্যাট্রিয়ার্ক কিরিল যখন পুতিনকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন, তখন পশ্চিমা সমাজের তথা ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিসও বসে নেই। তিনি গত ১৬ মার্চ কিরিলের সঙ্গে ভিডিও মিটিং করেছেন। তিনি কিরিলকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, কিরিল যেন পুতিনের আগ্রাসনকে ন্যায্যতা দিতে গিয়ে কোনো ধর্মীয় ব্যাখ্যা ব্যবহার না করেন। তাঁদের মিটিংয়ের পর ভ্যাটিকানের প্রেস অফিস পোপ ফ্রান্সিসের বক্তব্য তুলে ধরে একটি বিবৃতি দিয়েছে। সেই বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, পোপ বলেছেন, ‘একসময় আমাদের গির্জাগুলোতেও পবিত্র যুদ্ধ বা ন্যায়সংগত ধর্মযুদ্ধ নিয়ে আলোচনা হতো। কিন্তু আজ আমরা এভাবে কথা বলতে পারি না।’
কিন্তু কথা হলো, পোপ যাকে ঠিক বলে মনে করেন তার সবটাকেই প্যাট্রিয়ার্ক কিরিলের কাছে ঠিক বলে মনে হওয়ার কারণ নেই। কারণ এই দুই সম্প্রদায়ের মাঝে আসমান বরাবর ঐতিহাসিক পার্থক্যের দেয়াল তোলা আছে। এর পাশাপাশি রাশিয়ার প্রাচ্যকেন্দ্রীক রক্ষণশীল সংস্কৃতির সঙ্গে পশ্চিমের উদার ভোগবাদের সংঘাত তো আছেই।
পুতিন বাইজান্টিয়াম আমলে ফিরতে চান?
এই পার্থক্য ভালোভাবে বুঝতে হলে এক ঝলক ইতিহাসের দিকে তাকাতে হবে। আমাদের ফিরে তাকাতে হবে, ইতিহাসখ্যাত রুশ সম্রাট ‘ভ্লাদিমির দ্য গ্রেট’-এর দিকে। তিনি ‘সেইন্ট ভ্লাদিমির’ বা ‘সাধু ভ্লাদিমির’ নামেও পরিচিত। ৯৮০ থেকে ১০১৫ সাল পর্যন্ত তিনি রাশিয়া শাসন করেছিলেন।
সেন্ট ভ্লাদিমিরের সময়ে বাইজান্টিয়াম শাসনের সূর্য মধ্যগগনে ছিল। সুবিশাল রোমান সাম্রাজ্যকে শাসনের সুবিধার জন্য দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। এক ভাগে ছিল ইতালির রোমকেন্দ্রীক রোমান সাম্রাজ্য। অন্যটি ছিল আজকের তুরস্ক বা কনস্টান্টনোপলকেন্দ্রিক রোমান সাম্রাজ্য। তবে দুটিই রোমান সাম্রাজ্য নামে পরিচিত ছিল। কনস্টান্টিনোপলকে কেন্দ্র করে যে রোমান সাম্রাজ্য তৈরি হয়, সেটিকে বলা হয় বাইজান্টিয়াম সাম্রাজ্য।
ডব্লিউ. বি. ইয়েটসের ‘সেইলিং টু বাইজান্টিয়াম’ কবিতায় এই সাম্রাজ্যের বিপুল সমৃদ্ধির কথা পাওয়া যায়। বিশেষ করে শিক্ষা দীক্ষা ও প্রজ্ঞার পাদপীঠ ছিল বাইজান্টিয়াম সাম্রাজ্য। ‘সেইলিং টু বাইজান্টিয়াম’ কবিতায় একজন বয়স্ক লোকের জবানিতে বাইজান্টিয়াম বা আজকের ইস্তাম্বুলের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। কবিতার পটভূমি হাজার বছর আগেকার। সেখানে কবিতার ধারাভাষ্যকার বলছেন, ইউরোপের ভোগবাদী সমাজ বিত্তবৈভবে ও মদ-নারীর আসক্তিতে মেতে আছে। তারা আধ্যাত্মিকভাবে দীন-হীন। তাই তিনি বাইজান্টিয়ামে চলে এসেছেন। সেখানে মানুষ আধ্যাত্মিক জ্ঞান সাধনায় মগ্ন থাকে। সেখানকার সমাজ এক আলোকিত সমাজ।
এই বাইজান্টিয়াম সাম্রাজ্যকে কেন্দ্র করে যে রোমান সভ্যতা গড়ে ওঠে সেই সভ্যতার মানুষ ছিল অর্থোডক্স খ্রিষ্টান। আর রোম নগরকে কেন্দ্র করে যে রোমান সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে, সেখানকার বাসিন্দারা হলেন ক্যাথলিক খ্রিষ্টান। এই দুই সাম্রাজ্যের মধ্যে বেশি শক্তিধর ছিল বাইজান্টিয়াম সাম্রাজ্য।
রাশিয়ার ঐতিহাসিক প্রাণপুরুষ ভ্লাদিমির দ্য গ্রেট বাইজান্টিয়ামের অর্থোডক্স খ্রিষ্টানদের সংস্পর্শে এসে অর্থোডক্স খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন এবং অর্থোডক্স খ্রিষ্টান হিসেবে বাইজান্টিয়াম শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে নিজের সাম্রাজ্যকে যুক্ত করেছিলেন।
পুতিনের আদর্শিক গুরু কট্টরপন্থী রুশ দার্শনিক আলেকসান্দর দুগিন সেই হাজার বছর আগের বাইজান্টিয়াম শাসনামলের অর্থোডক্স খ্রিষ্টানদের মূল্যবোধে ফিরে যেতে চান। দুগিন সেই অর্থোডক্স রোমান সাম্রাজ্যে ফিরে যেতে চান যে সাম্রাজ্যটি অর্থোডক্স ক্রিশ্চিয়ানিটি ও ধর্মীয় জাতীয়তাবাদকে ধারণ করে এবং লালন করে। দেশীয় কৃষ্টি কালচার ও দেশীয় সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে যা পরিচালিত হবে। রাশিয়ার অর্থোডক্স চার্চ দুগিনের সেই মতাদর্শকে সম্পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে। পুতিনও সেই আদর্শ, অর্থাৎ উদার ভোগবাদ থেকে বের হয়ে আলোকিত সেই হাজার বছর আগের বাইজান্টিয়াম সাম্রাজ্যের আদর্শে ফিরে যেতে চান।
অর্থাৎ শীতল যুদ্ধে সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমাদের যে দ্বন্দ্ব ছিল তার সঙ্গে আজকের পুতিনের রাশিয়ার দ্বন্দ্বের আদর্শগত ফারাক আছে। সেই রাশিয়া ছিল রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে বিচ্ছিন্ন করা কমিউনিস্ট রাশিয়া। কিন্তু আজকের পুতিনের রাশিয়া রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতিটি স্তরে সেই হাজার বছর আগেকার বাইজান্টিয়াম সাম্রাজ্যের মূল্যবোধ রুয়ে দেওয়ায় বিশ্বাসী রাশিয়া। পুতিন নিজে ব্যক্তিজীবনে কতটা ধর্মীয় অনুশাসন মানেন, সেটি বড় বিষয় নয়। কারণ তিনি ধর্মীয় আদর্শকেই তাঁর রাজনীতিতে ব্যবহার করছেন এবং সেটি করছেন কোনো রকম রাখঢাক না করেই।
পুতিনের সেই ইচ্ছার পথে সবচেয়ে বড় বাধা হলো ইতালির রোমকেন্দ্রিক ক্যাথলিক খ্রিষ্টান দর্শন। কারণ ক্যাথলিকদের সঙ্গে অর্থোডক্সদের চিরন্তন শত্রুতা রয়ে গেছে। কারণ এই দুই পক্ষের বিশ্বাস, জীবনাচার ও ধর্মীয় আচার ব্যবহারে বিশাল পার্থক্য রয়েছে। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, পুতিনের ইউক্রেন নীতির কারণে অর্থোডক্স সম্প্রদায়ের মধ্যেও বিভক্তি তৈরি করে ফেলেছে।
ইউক্রেনের অর্থোডক্স চার্চ সেই দশম শতক থেকে মস্কোর প্যাট্রিয়ার্কের অভিভাবকত্বের অধীনে ছিল। কিন্তু ২০১৮ সালে তারা মস্কোর অর্থোডক্স চার্চের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং প্যাট্রিয়ার্ক কিরিলের অভিভাবকত্ব থেকে বেরিয়ে যায় এবং তাদের সমর্থন দেয় ইস্তাম্বুলভিত্তিক ইস্টার্ন অর্থোডক্স চার্চ। এতে মস্কো ক্ষুব্ধ হয়ে ইস্টার্ন অর্থোডক্স চার্চের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে। অর্থোডক্স সম্প্রদায়ের এই বিভক্তি রাশিয়ার অর্থোডক্স খ্রিষ্টানদেরও দারুণভাবে ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ করেছে।
অধ্যাপক টমাস ব্রেমার আল জাজিরাকে বলেছেন, ‘আজ আসল বিভেদটি রাশিয়ান অর্থোডক্স চার্চ এবং ইউক্রেনে তার (অবশিষ্ট) শাখা বা ইউক্রেনীয় অর্থোডক্স চার্চের মধ্যে বলে মনে হচ্ছে।’ রাশিয়ার অর্থোডক্স সাধুরাও ইউক্রেনীয় অর্থোডক্স চার্চের সঙ্গে রাশিয়ার অর্থোডক্স চার্চের বিবাদকে ভালোভাবে দেখছেন না।
রাশিয়ার প্রাক্তন সামরিক কর্মকর্তারা ও পুরোহিতসহ প্রায় ৩০০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি সম্প্রতি ‘রাশিয়ান প্রিস্ট ফর পিস’ শিরোনামে একটি খোলা চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন। সাক্ষরকারীদের বেশির ভাগই রাশিয়ার বাইরে থাকেন। এই চিঠিতে সই করলে পুতিনের রোষানলে পড়তে হবে—এই ভয়ে বহু মানুষ তাতে সই করতে রাজি হননি।চিঠিতে লেখা হয়েছে, ‘আমরা মানুষের ঈশ্বর প্রদত্ত স্বাধীনতাকে সম্মান করি এবং আমরা বিশ্বাস করি যে ইউক্রেনের জনগণকে পশ্চিম বা প্রাচ্যের চাপ ছাড়াই তাদের পছন্দ মতো চলতে দেওয়া উচিত।’
ইতিমধ্যে রোমানিয়ার প্যাট্রিয়ার্ক ড্যানিয়েল, ফিনল্যান্ডের আর্চবিশপ লিও, আলেকজান্দ্রিয়া এবং সমস্ত আফ্রিকার প্যাট্রিয়ার্ক দ্বিতীয় থিওডোর এবং প্যারিস ও এস্তোনিয়াতে রাশিয়ান অর্থোডক্স চার্চের প্রধানসহ বিশ্বব্যাপী অর্থোডক্স পাদ্রীরা রাশিয়ার এই আক্রমণের নিন্দা করেছেন।
গত ৯ মার্চ একটি খোলা চিঠিতে পশ্চিম ইউরোপের রাশিয়ান অর্থোডক্স চার্চের আর্চবিশপ মেট্রোপলিটন জন অব ডুবনা প্যাট্রিয়ার্ক কিরিলকে ‘এই ভয়ংকর এবং বুদ্ধিহীন যুদ্ধের বিরুদ্ধে’ আওয়াজ তুলতে অনুরোধ করেছেন।কিন্তু কিরিল বা পুতিন তাঁদের সে আহ্বানে সাড়া দেবেন বলে মনে হয় না।
১৯২০ এর দশকের গোড়ার দিকে রুশ গৃহযুদ্ধের পর ক্ষমতায় আসা কমিউনিস্টরা শাসকেরা গির্জা পুড়িয়ে এবং ধর্মযাজকদের গুলি করে ধর্মকে বিলুপ্ত করার চেষ্টা করেছিল, সেই রাশিয়ায় এখন ঠিক উল্টো বাতাস বইছে।
ধর্মহীনতার সোভিয়েত শাসনের অবসানের পর সেখানে ধর্ম এমনভাবেই ফিরে এসেছে যে, সেখানে যদিও খুব কমসংখ্যক মানুষ নিয়মিত গির্জায় প্রার্থনা করতে যায়, কিন্তু ৭০ শতাংশেরও বেশি রাশিয়ান নিজেদের অর্থোডক্স বলে পরিচয় দেন।
পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, অর্থোডক্স পুতিন চার্চকে রাশিয়ান জাতীয়তার প্রতীক হিসাবে দেখেন। তাঁর ক্রেমলিন ‘ঐতিহ্যগত মূল্যবোধ’কে একটি আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছে, সমকামী সম্পর্কের ‘প্রচারের’ বিরুদ্ধে আইন পাস করেছে।
পুতিন মনে করছেন, ইউক্রেন হচ্ছে রাশিয়ায় পশ্চিমা ভোগবাদী উদারনীতি ঢোকার প্রধান দরজা। সেই দরজা বন্ধ করতে হলে ইউক্রেনকে তাঁর কবজায় রাখতেই হবে।
কিন্তু দ্বিতীয় চেচেন যুদ্ধে যে পুতিন চেচনিয়াসহ ককেশাস অঞ্চলের মুসলমানদের ওপর নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়েছিলেন; চেচেন মুসলমানদের লাশের ওপর পা রেখে যে পুতিন আজকের এই ক্ষমতাধর পুতিন হয়ে উঠেছেন; ইউক্রেন যুদ্ধে সেই ‘কসাই’ পুতিনের পাশে কেন চেচেন মুসলিম নেতা রমজান কাদিরভকে দেখা যাচ্ছে? কেন ‘অর্থোডক্স রুশ সেনাদের’ সঙ্গে একাত্ম হয়ে চেচেন মুসলমানেরা এই যুদ্ধে জড়িয়েছেন?
সে আরেক গল্প। সে আরেক ইতিহাস। সুযোগ পেলে আগামী লেখায় তা বলব।
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
ই-মেইল: sarfuddin2003@gmail.com