হেফাজতের সমাবেশে গণহত্যা : হাসিনাসহ ৪৪ জনের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ

শেখ হাসিনা – ফাইল ছবি
ঢাকার মতিঝিলের শাপলা চত্বরে ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠনের অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীরসহ ৪৪ জনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।

সেই সমাবেশে অংশ নিয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী রেহান আহসানের মা ইফ্ফাত আরা রোববার (২৪ নভেম্বর) এই অভিযোগ দায়ের করেন।

অন্য যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা তারা হলেন- আওয়ামী লীগ নেতা শেখ ফজলে করিম সেলিম, আব্দুল লতিফ সিদ্দীকি, মাহবুবুল আলম হানিফ, বাহাউদ্দিন নাছিম, ড. আব্দুর রাজ্জাক, ড. হাসান মাহমুদ, মৃনাল কান্তি দাস, তৎকালীন আইজিপি হাসান মাহমুদ খোন্দকার, এআইজি শহীদুল ইসলাম, ডিএমপি কমিশনার বেনজির আহমেদ, বিজিবির তৎকালীন প্রধান, র‌্যাবের ডিজি, র‌্যাবের ইন্টেলিজেন্স উইংয়ের কমান্ডার তৎকালীন লে. কর্নেল জিয়াউল আহসান, তৎকালীন ছাত্রলীগের সভাপতি ও সেক্রেটারি, যুবলীগের সভাপতি ও সেক্রেটারিসহ ৪৪ জন।

ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দায়ের করার পর রেহান আহসানের মা ইফ্ফাত আরা বলেন, ‘রেহান হত্যার ঘটনার বিষয়ে বিগত সরকারের সময় আমি মুখ খুলতে পারিনি। থানা বা আদালতে মামলা করার সাহস পাইনি। ছেলের লাশ পাওয়ার পর আমাকে প্রশাসন থেকে চাপ দেয়া হয়েছিল তাড়াতাড়ি দাফন করার জন্য।’

তিনি আরো বলেন, ‘রেহানের মতো একটি মেধাবী ছেলেকে হারিয়ে আমি পারিবারিকভাবে নানা সমস্যার সম্মুখিন হয়েছি। আমি সন্তান হারিয়েছি। দেশও তার একটি অমূল্য সম্পদ হারিয়েছে। রেহান (২৩) বুয়েটের কম্পিউটার সাইন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিংয়ারিংয়ের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিল।’

‘আমার ছেলে কোনো রাজনীতির সাথে ছিল না, সে ছিল মূলত ধর্মভীরু,’ বলেন তিনি।

রেহানের মা বলেন, ‘আমার ছেলে ছিল ওর বাবার কলিজার টুকরা। ওর বাবা এই শোক সামাল দিতে পারেনি। পরের বছর ওর বাবা মারা যায়। সন্তানের শোক সামাল দেয়ার আগে আমি আমার স্বামীকে হারিয়েছি। এই ১১টা বছর আশাই ছেড়ে দিয়েছিলাম আমি আর দাঁড়াতে পারব না। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর আমরা বাকস্বাধীনতা পেলাম। সেই সাহসে সাহসী হয়ে আজ রেহানের হত্যার অভিযোগ দায়ের করলাম। আশাকরি প্রশাসন আমাকে সহায়তা করবে। আমি যেন সঠিক বিচার পাই। আমার মতো কোনো মা যেন আর কখনো সন্তানকে না হারায়। ছেলে হেফাজতের আন্দোলনে মারা গেছে, একথা এতদিন আমি বলতে পারিনি। আজ আমি বলতে পারছি।’

অভিযোগে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের নেতৃত্বে প্রেসিডিয়াম সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলে করিম সেলিম, আব্দুল লতিফ সিদ্দীকি, মাহবুবুল আলম হানিফ, বাহাউদ্দিন নাছিম, ড. আব্দুর রাজ্জাক, ড. হাসান মাহমুদ, মৃনাল কান্তি দাস গণভবনে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সরাসরি সাক্ষাৎ করেন এবং হেফাজতের কর্মসূচিকে নির্মমভাবে দমন করার নির্দেশনাপ্রাপ্ত হয়ে আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর ধানমন্ডির কার্যালয়ে বিকেলে সংবাদ সম্মেলন করেন এবং হেফাজতের নেতাকর্মীদের রাজাকার, আলবদর, আলসামস ও স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং হেফাজতের নেতা-কর্মীদেরকে বিএনপি-জামায়াতের দোসর হিসেবে আখ্যায়িত করে ঘোষণা দেন হেফাজতের নেতাকর্মীদেরকে দমনের জন্য আওয়ামী লীগই যথেষ্ট এবং হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীদের ঢাকা ছাড়ার জন্য কড়া হুঁশিয়ারি দেন।

অভিযোগে বাদি ইফ্ফাত আরা উল্লেখ করেন, ‘২০১৩ সালের ৫ মে সারা দেশ থেকে আলেম-ওলামা, সাধারণ ছাত্র-জনতা ও সকল শ্রেণি-পেশার ইসলামপ্রিয় তৌহিদী জনতার সাথে আমার ছেলে রেহান আহসান তার অন্যান্য বন্ধুবান্ধবসহ ঢাকার শাপলা চত্বর অভিমুখে যাত্রা করলে বিভিন্ন স্থানে পুলিশ, বিজিবি-র‌্যাব, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও সরকারের অন্যান্য শরীক দলের নেতাকর্মীরা তৌহিদী জনতাকে বাধা দেয়, হামলা চালায় এবং ঢাকা শহরসহ সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদেরকে আহত ও নিহত করে।’

‘আমার ছেলে রেহান আহসান ও তার বন্ধুরা সকাল থেকে ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক একাধিক স্থানে হামলার শিকার হয়ে আহত ও বিধ্বস্ত অবস্থায় বিকেলে মতিঝিল শাপলা চত্বর এলাকায় পৌঁছায়। উক্ত স্থানে থাকাবস্থায় সন্ধ্যার পরে শাপলা চত্বরের দক্ষিণ পার্শ্বস্থ দৈনিক বাংলা অভিমুখী সড়কে শাপলা চত্বর থেকে সামান্য দূরে রাস্তায় পুলিশ-যৌথবাহিনী, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সন্ত্রাসীরা গোলাগুলি করে আকস্মিক হামলা করলে আমার ছেলেসহ তার বন্ধুরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এসময় আমার ছেলেসহ আরো কয়েকজন রাস্তার পার্শ্বস্থ একটি গলিতে ঢুকে আশ্রয় নেয়। উক্ত গলিতে আশ্রয় নেয়ার পর আনুমানিক রাত সাড়ে ৮টা থেকে সাড়ে ৯টার মধ্যে উক্ত গলির দিকে পুলিশ-যৌথবাহিনী, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সন্ত্রাসীরা সমন্বিতভাবে গুলি করতে করতে এগোতে থাকলে একটি গুলি আমার ছেলে রেহান আহসানের মুখের বাম পাশে ওষ্ঠের সামান্য ওপরে একটি বুলেট এসে বিদ্ধ হয়ে মাথার পেছনের অংশ দিয়ে বের হয়ে ঘটনাস্থলে গুরুতর জখম হয়ে আহত হয়। কিছুক্ষণ পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে উক্ত গলিতে অবস্থানকারী বাকি জীবিত লোকজনসহ রেহানের অন্যান্য বন্ধুরা রেহানসহ আরো কয়েকজন বুলেটবিদ্ধ গুরুতর আহত ব্যক্তিকে উদ্ধার করে রিকশায় উঠিয়ে দিলে রেহানকে প্রথমে মতিঝিল ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক রেহান জরুরিভিত্তিতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে প্রেরণ করলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে।’

‘আমরা প্রথমে মতিঝিল ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে রেহানের খোঁজ করতে যাই সেখানে না পেয়ে আশেপাশে অন্যান্য হাসপাতালগুলোতে খোঁজ নিয়েও সেখানে রেহানের সন্ধান না পেয়ে এক পর্যায়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে খোঁজ করলে সেখানে মর্গে রেহানের লাশের সন্ধান পাওয়া যায়। পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল আমার ছেলে রেহান আহসানের পোস্টমর্টেম সম্পন্ন করে লাশ আমাদের কাছে হস্তান্তর করলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কিংবা পুলিশ আমাদেরকে পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট দেয়নি। পরবর্তী সময়ে আমার পারিবারিক সিদ্ধান্তক্রমে আমাদের নিজ গ্রামের বাড়ি নওগাঁ জেলায় আমার ছেলের লাশ দাফন সম্পন্ন করি।’

Nayadiganta