হিসাবের গরমিল ও বিশৃঙ্খলা এতটা!

ছবি: রয়টার্স

কত টিকা কেনা হয়েছে, সঠিক হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না।

কোন টিকা কত দামে কেনা হয়েছে, সেই হিসাবে ভয়াবহ গরমিল।

কত টিকা কতদিনে কেনা হবে বা কত টিকা কেনা পরিকল্পনা করা হয়েছে, সেই হিসাব কারো কাছে আছে বলে মনে হচ্ছে না।

৭-১২ আগস্ট ছয় দিনে এক কোটি মানুষকে টিকা দেওয়ার গল্প বেশ কয়েকদিন যাবত একনাগাড়ে শোনানো হয়েছে। এ কথাও জানানো হয়েছে যে, সোয়া এক কোটি ডোজ টিকা মজুদ আছে। আগামী বছরের শুরুর মধ্যে ২১ কোটি ডোজ টিকা দেশে আসবে। প্রতি মাসে এক কোটি ডোজ টিকা দেওয়া অব্যাহত থাকবে। টিকার কোনো ঘাটতি নেই, ঘাটতি হবে না। এ বক্তব্য সরকারের পক্ষ থেকে যার বলার কথা তিনি বলেছেন, যার বলার কথা নয় তিনিও বলেছেন। এমন জমজমাট প্রচারণার একদিন আগে জানা গেল, টিকা স্বল্পতায় গণটিকাদান কর্মসূচি সীমিত করা হয়েছে। টানা ছয় দিন নয়, গণটিকাদান কর্মসূচি চলবে একদিন।

বোঝা গেল মজুদ থাকা সোয়া এক কোটি ডোজ টিকার পরে, আবার কবে এবং কী পরিমাণ টিকা আসবে তা নিয়ে সন্দেহ এবং অনিশ্চয়তা আছে। প্রশ্ন হলো- সন্দেহ এবং অনিশ্চয়তা রেখে এত বড় ঘোষণা এতজন মিলে দেওয়া হলো কেন?

অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, টিকার সঠিক হিসাব সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা মন্ত্রীর কাছে নেই। এমন পরিস্থিতিতে মানুষকে শাস্তির হুমকি দিয়ে, পরে আবার ‘বক্তব্য আমাদের নয়’ ‘বক্তব্য প্রত্যাহার’ করে লোক হাসানোর খোরাক যোগানো হলো, যার কোনো দরকার ছিল না।

২১ কোটি ডোজ টিকা আনার বক্তব্য দেওয়া হলেও, তথ্য দেওয়া হলো না। বক্তব্যের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার পরেও তথ্য বা ব্যাখ্যা জানা গেল না। ২১ কোটি ডোজ টিকার মধ্যে দাবি করা হয়েছে সাত কোটি ডোজ রাশিয়া থেকে আসবে এবং সাত কোটি ডোজ আসবে জনসন এন্ড জনসনের টিকা। রাশিয়া থেকে সাত কোটি ডোজ টিকা কেনার চুক্তি করেছে বাংলাদেশ, এমন কোনো তথ্য সরকারি বা বেসরকারি বা বিদেশি কোনো সূত্র থেকে জানা যায়নি। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র কাগজপত্রসহ চিঠি দিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানিয়েছিল, রাশিয়ার স্পুতনিক-ভি টিকার বাংলাদেশি এজেন্ট গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল। তারা সরকারকে দুই কোটি ডোজ টিকা কেনার প্রস্তাব দিয়েছিল। সরকার সেই প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি। সরকার নিজেও কোনো চুক্তি করেনি। তাহলে রাশিয়া থেকে সাত কোটি ডোজ টিকা কীভাবে আসবে? কবে আসবে?

এরপর প্রশ্ন, জনসন এন্ড জনসনের সাত কোটি ডোজ টিকা নিয়ে। জনসন এন্ড জনসন টিকা রপ্তানির মতো অবস্থায় আছে কিনা, সেটা নিয়েই প্রশ্ন আছে। বাংলাদেশ জনসন এন্ড জনসনের সঙ্গেও চুক্তি করেনি। তার মানে জনসন এন্ড জনসনের সাত কোটি ডোজ টিকার পুরো বিষয়টিই অনিশ্চিত। একটি সূত্র বলছে বাংলাদেশ কোভ্যাক্সের আওতায় জনসন এন্ড জনসনের সাত কোটি ডোজ টিকা পাবে। এই তথ্য যদি সঠিকও হয়ে থাকে তাও নিশ্চিত করে বলা যায় না যে, টিকা পাওয়া যাবেই। জনসন এন্ড জনসনের উৎপাদন, কোভ্যাক্সে জমা হওয়া এবং তারপর টিকা পাওয়ার সম্ভাবনা। পেলেও লাখ ডোজ হিসাবে পাওয়া যেতে পারে, কোটি ডোজ হিসাবে নয়।

২১ কোটি ডোজের মধ্যে ভারত থেকে তিন কোটি ডোজ পাওযার কথা বলা হয়েছে। ভারত নিজেই টিকা দেওয়ায় আশঙ্কাজনকভাবে পিছিয়ে আছে। এ বছরের মধ্যে ভারত টিকা রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবে, সেই সম্ভাবনা খুবই কম।

তারমানে ২১ কোটি ডোজ টিকা আনার দাবির মধ্যে ১৭ কোটি ডোজ টিকা পাওয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। কোভ্যাক্স ও চীন থেকে বাংলাদেশ কিছু টিকা পাবে। কিন্তু, তা দিয়ে গণটিকাদান কর্মসূচি চালানো সম্ভব নয়।

এবার আসি টিকার দাম প্রসঙ্গে।

এক কোটি এক লাখ ৫০ হাজার ডোজ টিকা তিন হাজার ৪৫ কোটি টাকায় কেনার যে দাবি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে করেছিল, তাতে হিসাবের বড় রকমের গরমিল ধরা পড়েছিল। সেখানে কোভ্যাক্সের বিনামূল্যের প্রায় ১১ লাখ ডোজ টিকাও কেনা টিকা হিসাবে দেখানো হয়েছিল। প্রতি ডোজ টিকার মূল্য দেখানো হয়েছিল তিন হাজার মানে প্রায় ৩৫-৩৬ ডলার। কিন্তু সরকার সেরামের থেকে ৭০ লাখ ডোজ কিনেছে পৌঁছে দেওয়ার খরচসহ প্রতি ডোজ পাঁচ ডলার দামে। চীনের থেকে প্রতি ডোজ কিনেছে ১০ ডলার দামে। এর সঙ্গে আনার খরচ যোগ হবে। প্রতি ডোজ টিকার মূল্যে ২৫ থেকে ৩০ ডলার বেশি দেখিয়েছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। হিসাবের এই গরমিলের ব্যাখ্যা আজও দেয়নি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

বাংলাদেশ সরকার ২৫ বছরের বেশি বয়সীদের টিকা দিচ্ছে। বয়স কমিয়ে ১৮ করার কথা আলোচনা হলেও কার্যকর হয়নি। দেশে ১৮ ঊর্ধ্ব মানুষের সংখ্যা প্রায় ১৪ কোটি এবং তাদের সবাইকে টিকা দিতে হবে। সেই হিসাবে টিকার দরকার কমপক্ষে ২৮ কোটি ডোজ। এখন পর্যন্ত একডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে এক কোটি ৪০ লাখ ও দুই ডোজ দেওয়া হয়েছে প্রায় ৪০ লাখ মানুষকে। এখনও প্রায় ১৩ কোটি মানুষকে টিকা দিতে হবে। প্রতি মাসে এক কোটি ডোজ করে টিকা দিলেও সময় লাগবে কমপক্ষে ২৬ মাস। তাও যদি সবসময় টিকার মজুদ থাকে। যা মজুদ নেই এবং ভবিষ্যতে থাকার সম্ভাবনাও অত্যন্ত ক্ষীণ।

বাংলাদেশে লকডাউন, সর্বাত্মক লকডাউন, বিধিনিষেধ সম্পূর্ণ অকার্যকর। কার্যকর করার রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা নেই। সংক্রমণ কমানোর কোনো উদ্যোগই আমরা সফল করতে পারিনি।

তাহলে বাংলাদেশের করণীয় কী?

খুব দ্রুত যোগ বিয়োগের সঠিক হিসাব করা শিখতে হবে, হিসাবের গরমিল দূর করে হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে স্বচ্ছতা। সবচেয়ে জরুরি রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি। টিকা সংগ্রহে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে, শুধু কথা নয়। এতেও শেষ রক্ষা হবে না। রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় দেশে টিকা উৎপাদন করতে হবে। সেটা চীনা, রাশিয়ান বা যে টিকাই হোক। বাংলাদেশের সামনে এর কোনো বিকল্প নেই।

s.mortoza@gmail.com