৬ ডিসেম্বর ২০২২
বিল্লাল হুসাইন
বর্তমান পরস্পর নির্ভরশীলতার এই বিশ্ব-ব্যবস্থায় বিভিন্ন উপায়ে গণতান্ত্রিক দেশগুলো চেক এন্ড ব্যালেন্স বজায় রাখে। শক্তিশালী দেশ গুলোর পক্ষ থেকে স্যাংশন বা নিষেধাজ্ঞা অনেকটাই পথচ্যুত দেশকে সঠিক পথে রাখতে ভূমিকা রেখে থাকে। বাকস্বাধীনতা, মানবাধিকার, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের স্বাধীনতা, জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকারসহ শাসককে তাঁর ভুলের জন্য জবাবদিহিতার কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর অধিকার আধুনিক সভ্যতার স্বীকৃত অধিকারের মধ্যে পড়ে। যখন কোনো দেশের জনসাধারণকে এই অধিকারগুলো থেকে বঞ্চিত করা হয়, তাঁদের কণ্ঠকে চেপে ধরা হয়, ভূলুণ্ঠিত করা হয় তাদের বাকস্বাধীনতা ও মানবাধিকার, তখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় চুপ থাকতে পারে না। যদি গণতান্ত্রিক বিশ্ব বর্তমান বাংলাদেশের মত একটি ফ্যাসিবাদি শাসকের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করে সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করতে চায়, সেই ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক দেশ গুলোকে মুক্তিকামী মানুষের পক্ষে অবশ্যই দাঁড়াতে হবে।
একটি গণতান্ত্রিক সরকারের বৈশিষ্ট্য, আর একটি স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট সরকারের বৈশিষ্ট্য কেমন হয় পাঠক নিশ্চয়ই সে বিষয়ে অবগত। গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় জনগণের চাহিদা ও মতের প্রতিফলন ঘটে। আর স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থায় ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর ইচ্ছা ও স্বার্থ প্রতিফলিত হয়। শেখ হাসিনা সরকার মূলত: একটি স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিস্ট সরকার। বিনা ভোটে ক্ষমতা দখলে রাখা শেখ হাসিনা সরকার এহেন কোন অপকর্ম নেই যা করছে না বা করেনি। জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে, জোর করে ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও তার ফ্যাসিস্ট সরকার বাংলাদেশের মানুষের উপর জগদ্দল পাথরের ন্যায় বসে আছে। শেখ হাসিনা ও তার ফ্যাসিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা এখন সময়ের দাবি; কেন আন্তর্জাতিক মহলের এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা উচিত সে বিষয়ে আজকের লেখায় আলোকপাতের চেষ্টা থাকবে।
প্রথমে পিলখানা হত্যাকাণ্ড নিয়ে আলোচনা করা যাক। আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর ক্ষমতায় আসার পর পরই ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বিডিআর সদর দফতরে হত্যাকাণ্ড চালায়। এই হত্যাকাণ্ড রাজধানীর পিলখানা হত্যাকাণ্ড আলোচিত। এই হত্যাকাণ্ডে ৫৭ জন দেশপ্রেমিক অফিসারকে নৃশংস ভাবে হত্যা করা হয়। স্বাধীন সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রতীক এই বাহিনীকে ফ্যাসিবাদের সহায়কে রূপান্তর করা হয় এই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে। এই হত্যাকাণ্ডের সাথে যে শেখ হাসিনা ও তার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় সরাসরি জড়িত ছিল তা জয়ের একটি লেখা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের আগে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকায় জয় বলেছিলেন, বাংলাদেশের সেনাবাহিনী এবং বাংলাদেশ প্যারামিলিটারি বাহিনীতে ইসলামিক জঙ্গি প্রবেশ করানো হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে একটা প্রতিশোধ নিতে হবে। এর বিরুদ্ধে একটা এ্যাকশন নিতেই হবে। সেদিন যুদ্ধের সকল সরঞ্জাম নিয়ে সেনাবাহিনী মূর্তির মতো পিলখানার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। শুধু হাসিনার অনুমতির অভাবে এই ৫৭ জন দেশ প্রেমিককে রক্ষায় সেনাবাহিনী কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি।
ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার দ্বিতীয় ধাপে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের ‘রাজাকার’, ‘স্বাধীনতা বিরোধী’, ‘মানবতাবিরোধী’ তকমা লাগিয়ে জুডিশিয়াল হত্যাকাণ্ড চালায়। যা আইনের ভাষায় ‘জুডিশিয়াল কিলিং’ বলে পরিচিত। মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ সাজিয়ে এই বিচারের মাধ্যমে বিরোধী কণ্ঠকে চুপ করানোর প্রথম ধাপ সম্পাদন করে ফ্যাসিস্ট হাসিনা। ২০১০ সালে কথিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে সরকারের এ হীন উদ্দেশ্য সফল হয়। হাজার হাজার মানুষকে গ্রেফতার করা হয়। দলটির নায়েবে আমির দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডের রায়ের পর দেশের মানুষের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালিয়ে শতাধিক মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়।
এরপর আসা যাক স্বাধীন বাংলাদেশের সবচেয়ে নির্মম গণহত্যার আলোচনায়। ২০১৩ সালের ৫ মে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি যৌথভাবে রাজধানীর শাপলা চত্বরে হেফাজতের উপর এক নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায়। যার নাম দেয়া হয় ‘অপারেশন সিকিউর শাপলা।’ যদিও সরকারের হিসাবে এতে ৬৯ জন নিহত হয় কিন্তু হেফাজতের দাবি তা হাজারেরও ওপর। মূলত শান্তিপূর্ণ একটি সমাবেশে এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট এই সরকার তার ফ্যাসিজমকে আরো একধাপ এগিয়ে নেয়।
শেখ হাসিনা সরকারের আরেকটি বড় অপকর্ম হচ্ছে তার পোষা বাহিনী দিয়ে বিরোধী মতের মানুষকে গুম, খুন ও নির্যাতন করা। তার এ কুকর্মের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গত বছরের ডিসেম্বরে ‘গুরুতর মানবাধিকার লংঘনমূলক কাজে জড়িত থাকার’ অভিযোগে বাংলাদেশের এলিট ফোর্স নামে পরিচিত র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং এর ছয়জন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। যুক্তরাষ্ট্র জানায়, র্যাব এবং অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ২০০৯ সাল থেকে প্রায় ৬০০টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ৬০০-রও বেশি লোকের গুম হয়ে যাওয়া, এবং নির্যাতনের জন্য দায়ী। যদিও আওয়ামী লীগ সরকার তাদের স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বরাবর এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।
শেখ হাসিনা সরকার জানে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকলে, সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থা থাকলে তারা আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। যার কারণে ফ্যাসিস্ট হাসিনা নির্বাচন ব্যবস্থাকে পুরোপুরি হত্যা করেছে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের রাতের ভোট ডাকাতির মাধ্যমে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের গণতন্ত্রের ভিত্তিকে হত্যা করে ক্ষমতায় টিকে থাকাটা কি নিষেধাজ্ঞা পাওয়ার যোগ্য নয়?
আমরা জানি গণমাধ্যম একটি রাষ্ট্রের আয়না হিসেবে কাজ করে; গণমাধ্যম একটি গণতান্ত্রিক দেশের চতুর্থ খুঁটি হিসেবে সরকারের দোষ-ত্রুটি তুলে ধরে। কিন্তু, হাসিনা গণমাধ্যমকে শুধু নিয়ন্ত্রণেই রাখেনি। গলাটিপে হত্যা করেছে নিরপেক্ষ ও বিরোধী মতাদর্শের গণমাধ্যমগুলোকে। চ্যানেল ওয়ান, দিগন্ত টেলিভিশন, ইসলামিক টিভি, ও আমার দেশের মত জনপ্রিয় ও সরকারের অপকর্ম প্রকাশকারী গণমাধ্যমগুলোকে বেআইনিভাবে বন্ধ করেই থেমে থাকেনি ফ্যাসিস্ট হাসিনা জেলে পুড়েছে সাংবাদিকদের।
দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে টাকা আত্মসাতের সাজানো একটি মিথ্যা অভিযোগে জেলখানায় পাঠিয়ে ফ্যাসিস্ট হাসিনা তার স্বেচ্ছাচারিতাকে আরো স্পষ্ট করেছে। যদিও অসুস্থ এই মানুষটি দীর্ঘদিন কারাবন্দী থাকার পর ‘মানবিক দিক’ বিবেচনায় নিয়ে শর্ত সাপেক্ষে তাঁকে নিজের বাসভবনে থাকার অনুমতি দেয় হাসিনা। কিন্তু মাঝে মধ্যেই ফ্যাসিস্ট কায়দায় বিএনপি বেশি বাড়াবাড়ি করলে খালেদা জিয়াকে আবারো জেলে পাঠানোর কথা বলে শাসাতে ভুল করেননা। বিচার বিভাগও যে ফ্যাসিস্ট শাসকের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে এটাই তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
মানুষের কণ্ঠরোধে ফ্যাসিস্ট হাসিনা পুরোপুরি সফল, মানুষের বাকস্বাধীনতা আজ নির্মম ইতিহাস। দেহ আছে কিন্তু প্রাণ নেই এরকম অবস্থায় এখন দেশের সাধারণ মানুষ। এর বহুবিধ কারণের একটি হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের দমনমূলক আইন। এর মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ অন্যতম। সোশ্যাল মিডিয়ায় সরকারের অপকর্মের সমালোচনা না করতে পারে সে লক্ষ্যে মূলত এ আইনের সূত্রপাত। এছাড়াও রয়েছে কমিউনিকেশন টেকনোলজি অ্যাক্ট ২০০৬ (পরিশোধিত ২০১৩), এন্টি টেরোরিস্ট অ্যাক্ট ২০০৯ এবং বিশেষ ক্ষমতা অধ্যাদেশ ‘৭৪ । এসব কালো আইনের মাধ্যমে এই ফ্যাসিস্ট সরকার দেশের মানুষের মধ্যে একধরনের ভীতি সঞ্চার করে রেখেছে।
পাঠককে মনে করিয়ে দিচ্ছি উত্তরবঙ্গের বগুড়ায় ফ্যাসিস্ট হাসিনার পরিচালিত গণহত্যা সম্পর্কে। ২০১৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সরকার নিরীহ জনগণের উপর এক বিভীষিকাময় হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে শতাধিক মানুষকে হত্যা করে। এছাড়া দক্ষিণের জেলা সাতক্ষীরার হত্যাকাণ্ডও হয়তো সবার জানা। ২০১৩ সালে বিজয়ের মাসে সরকারের হীন উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের হাতিয়ার র্যাব, পুলিশ ও বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি) একটি হত্যাযজ্ঞ চালায়। যেই হত্যাকাণ্ডে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সেনাবাহিনীরও সংশ্লিষ্টতা ছিল বলেও গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়াও ফ্যাসিস্ট এ সরকার নাটকীয় কায়দায় ২৬৬৯ জন নিরীহ মানুষকে বিচারবহির্ভূত হত্যা করেছে। সেই সাথে ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, উন্নয়নের নামে বিদেশে টাকা পাচার, ব্যাংক লুট, শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারির মতো অসংখ্য ঘটনা তো আছেই।
ফ্যাসিস্ট এই শাসকের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করতে দেশের মানুষ তাঁদের সর্বস্ব দিয়ে গণতান্ত্রিক উপারে লড়াই অব্যাহত রেখেছে। বন্দুকের মুখে দীর্ঘদিন গণতান্ত্রিক আন্দোলন চালিয়ে নেওয়া অসম্ভব; গণতান্ত্রিক ধারায় এই ফ্যাসিস্ট সরকারকে হঠানো এখন অসম্ভব; যেহেতু, গণতন্ত্রের সবগুলো দ্বার আজ রুদ্ধ। স্বভাবসিদ্ধ তাড়নাতেই মানুষ মুক্তির জন্য সহিংস পথ বেছে নেবে যদিনা গণতন্ত্রের দ্বার উন্মুক্ত হয়।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আমাদের আহবান, একটি মুক্ত পৃথিবীতে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে ফ্যাসিস্ট এই শাসককে বাধ্য করুন গণতন্ত্রের দ্বারগুলো উন্মুক্ত করে দিতে; নয়তো ভবিষ্যৎ সহিংস বাংলাদেশের দায় আপনাদের ঘাড়েও বর্তাবে। আপনারাই সিদ্ধান্ত নিন, আপনারা কি আরেকটি উত্তর কোরিয়া বা মিয়ানমার চান? মুসোলিনি হিটলারের প্রেতাত্মাদের অবাধ বিচরণের সুযোগ করে দেবেন, নাকি গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে আপনারা আপনাদের দায়িত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবেন!
লেখক: গণমাধ্যম কর্মী ও একটিভিস্ট