
নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে জুলাই বিপ্লবের বর্ষপূর্তি দিবস পালিত হয়ে গেল গত ৫ আগস্ট। গত বছর এ দিনে জনরোষে আওয়ামী ফ্যাসিবাদী শাসনের পতন ঘটেছিল অভাবিতভাবে। পালিয়ে গিয়েছিলেন নিষ্ঠুর শাসক হিসেবে বিশ্বে পরিচিত শেখ হাসিনা ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা, যেটি ইতিহাসে একটি দৃষ্টান্তমূলক ঘটনা হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়ে থাকবে। কারণ, বিশ্বের অন্যান্য আজ্ঞাবহ স্বৈরশাসক যারা গণ-বিপ্লবের মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন তাদের মধ্যে খুব কম শাসক প্রভু দেশে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছেন। সে দিক থেকে শেখ হাসিনা ভাগ্যবান। কারণ, জুলাই বিপ্লবে উৎখাত হওয়ার পর প্রায় নিজের দেশের মতো করে ভারতে থাকছেন।
অথচ অনেক দেশের বহু অনুগত শাসক গণ-অভ্যুত্থানে উৎখাত হওয়ার পর আগের মতো আর মর্যাদা পান না। যেমন- যুক্তরাষ্ট্রের অনুগত ইরানের রেজা শাহ পাহলভীর কথা ধরা যাক। ইসলামী বিপ্লবের মুখে ১৯৭৯ সালে দেশ থেকে পালিয়ে প্রথমে মিসরে তারপর মরক্কো, বাহামা, মেক্সিকো, যুক্তরাষ্ট্র ও পানামায় কিছুকাল অবস্থান করেন। অবশেষে মিসরে অবস্থানকালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৮০ সালের ২৭ জুলাই মারা যান তিনি।
অন্য দিকে ফিলিপাইনের স্বৈরশাসক মার্কোস একইভাবে ১৯৮৬ সালে গণ-অভ্যুত্থানে দেশ থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই অঙ্গরাজ্যের হনলুলু দ্বীপে থাকার সুযোগ পেয়েছিলেন। সেখানে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। এখানে উল্লেখ করতে হয়, উভয় স্বৈরশাসক আমেরিকার আজ্ঞাবহ হলেও গণ-আন্দোলনে উৎখাত হওয়ায় ওয়াশিংটনে তাদের আর আগের মতো সমাদর থাকেনি; কিন্তু শেখ হাসিনা দুই-দুবার রাজকীয়ভাবে ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছেন। একবার ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর, আর এবার জুলাই বিপ্লবে উৎখাত হয়ে।
ভারতের প্রতি শেখ হাসিনা ও তার দলের নিঃশর্ত আনুগত্যের পুরস্কার দিল্লি ঠিকভাবে দিয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তার অনুগত যেসব শাসক জনগণ দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়ে বিদায় নিয়েছেন তাদের প্রতি আগের মতো আর আপ্যায়ন পরিলক্ষিত হয়নি। বলা যায়, তারা পরিত্যক্ত হন। তবে যেসব দেশে মার্কিন সেনারা যুদ্ধ করে পরাজিত হয়ে বিদায় নিয়েছে সেসব দেশের শাসকদের কেউ কেউ আশ্রয় পেয়েছেন, আবার কেউ পাননি। যেমন- ভিয়েতনাম যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয়ের পর তৎকালীন দক্ষিণ ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট নগুয়েন ভ্যান দিও আমেরিকার বোস্টন শহরে আশ্রয় পেয়েছিলেন। আবার আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি সে সুযোগ পাননি। তালেবান কাবুল দখল করলে প্রথমে ওমানে পালিয়ে যান, তারপর সংযুক্ত আরব আমিরাতে আশ্রয় পান ঘানি।
সাধারণভাবে কোনো বড় দেশের তল্পিবাহক শাসক জনগণ দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হলে কিংবা সিকিমের লেন্দুপ দর্জির মতো অবস্থা হলে আগের মতো আর মর্যাদা পান না। এ ক্ষেত্রে ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্য বিশ্বাসঘাতক হিসেবে পরিচিত লেন্দুপ দর্জির কথা আমরা বলছি। তিনি নিজের স্বাধীন একটি দেশকে ভারতের কাছে তুলে দিয়ে বিশ্বাসঘাতকতার যে নজির স্থাপন করেন; তা ইতিহাসে একটি বিরল ঘটনা। ভারতের সাথে সংযুক্ত হওয়ার আগে লেন্দুপ দর্জি যখন দিল্লিতে যেতেন, তখন নেহরু এবং পরবর্তী সময়ে তার কন্যা ইন্দিরা গান্ধী তাকে রাজকীয় অভ্যর্থনা জানাতেন। পরবর্তী সময়ে মাসের পর মাস চেষ্টা করেও একজন ডেপুটি সেক্রেটারি কিংবা কংগ্রেসের দ্বিতীয় সারির কোনো নেতার সাথে দেখা করতে পারতেন না। কাজ হয়ে গেলে যা হয়। আর বিশ্বাসঘাতকদের পরিণতি সবসময় এ রকমই হতে দেখা যায়। শেষ বয়সে অত্যন্ত নিঃসঙ্গ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
এ পটভূমিতে যে বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ উঠেছে তা হচ্ছে- প্রায় ৪৮ বছরের ব্যবধানে শেখ হাসিনার দু’বার ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রাপ্তি তার জন্য কতটা তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠবে তা-ও ভেবে দেখার বিষয়। অনেকে বলে থাকেন, প্রথম রাজনৈতিক আশ্রয় তার জন্য একটি অসম্ভব রাজনৈতিক সুবিধা এনে দিলেও দ্বিতীয়বারে কতটা সফলতা বয়ে আনবে নিজ দেশে- সেটি ভেবে দেখার বিষয়।
১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর শেখ হাসিনা যেভাবে ভারতে আশ্রয় পেয়েছিলেন, পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করে যে রাজনৈতিক সুবিধা লাভ করেছিলেন এবং বিজয়ী হয়েছিলেন; ঠিক সেভাবে এবার দ্বিতীয় দফায় ভারতে আশ্রয় প্রাপ্তি ভবিষ্যতে তাকে কতটা রাজনৈতিক সুবিধা এনে দেবে তা নিয়ে নিজের দলের অনেকে শঙ্কিত। কারণ প্রথমবার তিনি দেশে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে, তার চোখে ছিল অশ্রু, যা বাংলাদেশের বিপুল মানুষকে প্রভাবিত করেছিল।
বাংলাদেশের মানুষ শেখ হাসিনার সে অশ্রুর মূল্য দিয়েছিলেন ১৯৯৬ সালে। ২০০৮-এর নির্বাচনে বিজয়ী করে ক্ষমতায় বসিয়ে। কিন্তু তিনি সুশাসনের পথে না হেঁটে অত্যাচার, নির্যাতন এবং গুম-খুনের মাধ্যমে নিবর্তনমূলক এক শাসন কায়েম করে হাজার হাজার পরিবারে অশ্রুর বন্যা বইয়ে দিয়েছিলেন। সৃষ্টি করেছিলেন ভয়াবহ শ্বাসরোধক পরিস্থিতি। মানুষ মুক্তির পথ খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তবে এটি চির সত্য যে, একদিন না একদিন সব জুলুমের অবসান ঘটে। মজলুম মানুষের আর্তনাদ তখন আল্লাহর আরশে দ্রুত পৌঁছায় যায়। আর সেই পুঞ্জীভূত অভিশাপের আগুনে ভস্ম হয়ে যান নির্যাতনকারীরা। যেমন আমাদের চতুর্থ খলিফা হজরত আলী রা: বলেছেন, ‘অত্যাচারীর বিরুদ্ধে অত্যাচারিতের অন্তরে যে আগুনের জন্ম হয়, তা অত্যাচারীকে পুড়িয়ে ভস্ম করে কেবল ক্ষান্ত হয় না, সে আগুনের শিখায় আরো অনেক কিছু দগ্ধ হয়ে যায়।’
গত বছরের জুলাই বিপ্লব ছিল নিপীড়িত মানুষের অন্তরে জন্ম নেয়া আগুনের শিখা, যা শেখ হাসিনার লৌহ-কঠিন শাসন ভস্মীভূত করে দিয়েছিল। তিনি পরিস্থিতি বেগতিক দেখে শেষ পর্যন্ত দলবল নিয়ে চিরচেনা, চির প্রিয় ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। সেখানে আরো জড়ো হয়েছেন তার শাসনামলের সেসব পদচ্যুত সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা এবং গোয়েন্দা প্রধান। সেই সাথে আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাকর্মীরা তো আছেনই।
ভারতের মাটিতে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর এ ধরনের আশ্রয়-প্রশ্রয়ের বিষয়টি আমাদের নানা আঙ্গিকে ভাবতে সাহায্য করছে। অর্থাৎ কতদিন তারা এভাবে ভারতে বাস করবেন এবং তাদের পরবর্তী কর্মপরিকল্পনা বা কী? তারা কি তিব্বতের দালাইলামার মতো পরিণতি লাভ করবেন, নাকি তাদের সামনে আরো অনেক পথ খোলা আছে। দালাইলামার কথা বলার পেছনে একটি কারণ আছে। অনেকের এটি জানা আছে, ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরু চীনের হাত থেকে তিব্বত পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে দালাইলামা ও তার সঙ্গী-সাথীদের ভারতে আশ্রয় দিয়েছিলেন। সুতরাং একই লক্ষ্যে ভারত যদি শেখ হাসিনা ও তার শীর্ষস্থানীয় নেতাদের আশ্রয় দিয়ে থাকে; তাহলে দালাইলামা প্রসঙ্গটি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে। আবার অন্যভাবে বলা যায়, শেখ হাসিনা ও তার শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে যে বিচার চলছে, তাতে যদি তারা সাজাপ্রাপ্ত হন; তাহলে তাদের দেশে ফেরা কঠিন হয়ে পড়বে। সে অবস্থায় তারা হয় দালাইলামার পরিণতি ভোগ করবেন, নয়তো অন্য দেশে চলে যাবেন অথবা ’৭৫ সালের মতো বাংলাদেশের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করতে পারে। তবে বর্তমানে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের গোপন তৎপরতার যে বিষয়গুলো পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, তাতে মনে হয়- তারা সরকারকে অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে অন্তর্ঘাতমূলক কাজ করার পরিকল্পনা আঁটছে।
অন্য দিকে ভারত যদি চায়, তাহলে ভিয়েতনাম যেমন কম্বোডিয়ায় আগ্রাসন চালিয়ে হুনসেনকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল, ঠিক সে রকম একটি সিদ্ধান্ত নিতে পারে। অনেকের এটি জানা আছে, খিউসাম্পান ও পলপটের নেতৃত্বে কমিউনিস্টরা তৎকালীন কাম্পুচিয়া অর্থাৎ বর্তমানের কম্বোডিয়া দখলের পর হুনসেনের সাথে অন্য নেতাদের বিরোধ দেখা দেয়। এ অবস্থায় হুনসেন তার সমর্থকদের নিয়ে ভিয়েতনামে পালিয়ে যান। পরবর্তী সময়ে ভিয়েতনামের সেনাবাহিনী কম্বোডিয়া আক্রমণ করে দখল করে নেয়। একইসাথে হুনসেনকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেয়। ঠিক এভাবে সোভিয়েত লালফৌজ আফগানিস্তান দখল করে বারবাক কারমালকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল। আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী এভাবে ভাবতে পছন্দ করেন। সোস্যাল মিডিয়ায়ও এ ধরনের ভাবনার কথা লক্ষ করা যায়।
তবে জুলাই বিপ্লবের পর আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীর এ ধারণা ছিল, কয়েক মাসের মধ্যে একটি সামরিক অভ্যুত্থানে অন্তর্বর্তী সরকার উৎখাত হবে। শেখ হাসিনা ও তার দোসরদের সসম্মানে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হবে। এ রকম একটি ধারণা দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে নেতাকর্মীদের দেয়া হয়েছিল; কিন্তু এক বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর ওই ধরনের ঘটনার কোনো আলামত না থাকায় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা নেমে এসেছে। তাই তৃণমূলের অনেকে বিএনপির সাথে একটি বোঝাপড়ার চেষ্টা করছে।
তবে আওয়ামী লীগের মতো একটি রাজনৈতিক দলকে সাংবিধানিক পথ ছাড়া অন্য কোনো সহিংস পন্থায় বিজয়ী হওয়া অসম্ভব একটি ব্যাপার। আরেকটি বিষয় ভাবতে হবে, শত ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও বাংলাদেশ গত ৫৪ বছরে নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যথেষ্ট সক্ষমতা অর্জন করেছে। তা ছাড়া বাংলাদেশ একা নয়, আক্রান্ত হলে পাশে দাঁড়ানোর মতো বন্ধু দেশও আছে। সুতরাং বাংলাদেশে কখনো সিকিম, কম্বোডিয়া কিংবা আফগানিস্তান হবে না।